অনুশীলন শেষে হাসিমুখে মাঠ ছাড়ছিলেন অধিনায়ক সাকিব। গ্যালারিতে থাকা বাংলাদেশের এক সমর্থক সে সময় ওড়ালেন জাতীয় পতাকা। কলকাতায় আজ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ শেষেও নিশ্চয় এমন দৃশ্য দেখতে চাইবেন বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা
অনুশীলন শেষে হাসিমুখে মাঠ ছাড়ছিলেন অধিনায়ক সাকিব। গ্যালারিতে থাকা বাংলাদেশের এক সমর্থক সে সময় ওড়ালেন জাতীয় পতাকা। কলকাতায় আজ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ শেষেও নিশ্চয় এমন দৃশ্য দেখতে চাইবেন বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা

যে ম্যাচ বাংলাদেশের জন্য ‘ফাইনাল’

ইডেন গার্ডেনের সামনে সেই পরিচিত জটলা। টিকিটপ্রার্থীদের ভিড়। হইচই, চিৎকার, চেঁচামেচি। ম্যাচের আগের দিনের ইডেনের অবধারিত অনুষঙ্গ তুমুল বচসাও হচ্ছে। এসব উপেক্ষা করে মূল প্রবেশদ্বারের পাশের ফুটপাতে শুভজিৎ সাহা নামের এক তরুণ মন দিয়ে ছবি ঝোলাচ্ছেন ইজেলে। তাঁর নিজের আঁকা ছবিই। একটা ছবি একটা বাচ্চা কোলে হার্দিক পান্ডিয়ার। আরেকটা অবশ্যই সাকিব আল হাসানের।

অবশ্যই সাকিব। কারণ, পরদিন ইডেন গার্ডেনে এই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের একটা দল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ম্যাচ হিসেবে খুব বড় নয়। তবে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড়। বলতে পারেন ‘ফাইনাল’! আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে জয়ের পর টানা চার পরাজয়ে ‘জেতা উচিত’ ট্যাগ লাগানো ম্যাচটার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। ‘ফাইনাল’ মানে এই নয় যে এটা জিতলেই বাংলাদেশ বড় কিছু পেয়ে যাবে। যা পাবে, তা হলো পরের তিন ম্যাচে একটু উজ্জীবিত হয়ে নামার রসদ।

এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কঠিন ম্যাচও হয়তো এটাই। বিশ্বকাপে যেখানে এত বড় বড় দল, সেখানে সহযোগী সদস্য একমাত্র দেশের বিপক্ষে ম্যাচটা সবচেয়ে কঠিন হয়ে কীভাবে! কঠিন, কারণ বাংলাদেশের জন্য এই ম্যাচ অনেকটা ফুটবলে পেনাল্টি মারার মতো! কেন, এমন মনে হচ্ছে কেন?

বাংলাদেশ–নেদারল্যান্ডস ম্যাচ দিয়েই ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেনের এবারের বিশ্বকাপ–যাত্রা শুরু হতে চলেছে

পেনাল্টিতে কী হয়, ভেবে দেখুন। গোল করলে কেউ তা বেশিক্ষণ মনে রাখে না। আর মিস করলে, বিশেষ করে সেই মিস যদি ম্যাচের নির্ধারক হয়ে যায়, ওই ফুটবলারকে অনেক দিন, কখনো কখনো বাকি জীবনই সেই গঞ্জনা শুনে যেতে হয়।

মিলটা কি এবার বুঝতে পারছেন? বাংলাদেশ যদি আজ নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে জেতে, তাহলে সবাই বলবে, এ আর এমন কি! এই ম্যাচ তো জেতারই কথা। আর হেরে গেলে রীতিমতো সর্বনাশ। শুধু সর্বনাশে কুলাচ্ছে না, বলা উচিত মহাসর্বনাশ।

কাগজে-কলমে বাংলাদেশের সেমিফাইনাল খেলার যে ক্ষীণ সম্ভাবনা এখনো বেঁচে আছে, পরাজয়ে তা কলকাতায় দুর্গা প্রতিমার মতো গঙ্গায় বিসর্জিত হবে। এই বিসর্জন নিয়েই কাল সরগরম শহর কলকাতা। শহরে যত পূজা হয়েছে, সব প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয়েছে এক রাস্তায়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে সেই কার্নিভ্যাল নিয়ে শহরে সাজ সাজ রব। অবধারিত প্রতিক্রিয়া হিসেবে তুমুল যানজটও।

দুর্গোৎসবে রঙিন কলকাতা দেখতে বিশ্বের নানা দেশ থেকে মানুষ আসেন এখানে। সেই উৎসব শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে যাচ্ছে আরেক উৎসব। প্রায় অর্ধেকটা পথ পেরিয়ে আসা বিশ্বকাপের কলকাতায় বোধন হচ্ছে বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস ম্যাচ দিয়েই। কাল দুপুরে ইডেনের সামনে ভিড়টায় বাংলাদেশেরও অনেক মানুষ। চার দিনে কলকাতায় বাংলাদেশের দুই ম্যাচ, ঘরের পাশের শহরেই তাই বাংলাদেশিদের বেশি ভিড় থাকবে স্বাভাবিক। আজ ইডেনের গ্যালারিতেও যেটির প্রতিফলন থাকবে।

অনুশীলনে মাহমুদউল্লাহ। তাঁর কাছে আরেকটি বড় ইনিংসের প্রত্যাশা করা যেতেই পারে

টানা পরাজয়ে বাংলাদেশের এখন এমন অবস্থা, যেকোনো কিছু থেকেই অনুপ্রেরণা খোঁজার চেষ্টা করতে হচ্ছে। তাসকিন আহমেদও যেমন অনুমিত দর্শক সমর্থনকে বাংলাদেশের জন্য বড় একটা টনিক মনে করছেন। কাঁধের সমস্যা আবারও জানান দেওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচটা খেলেননি। সংবাদ সম্মেলনে আসাটাই একরকম জানিয়ে দিয়েছিল এই ম্যাচে মাঠে ফেরার কথা। মুখেও তা নিশ্চিত করলেন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে এখন যা বলার কথা, সেটিই বললেন। বাকি চার ম্যাচে জিতলে এখনো সেমিফাইনাল খেলার সুযোগ থাকবে। বাংলাদেশ দল তাই আশা ছাড়ছে না।

এই ম্যাচটার গুরুত্ব আরও বেড়ে যাওয়ার কথা বলছিলাম। কারণ এটাই। নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে গেলে বাকি তিন ম্যাচেও কিছু না-কিছু পাওয়ার থাকবে। তবে সেমিফাইনালে খেলার সম্ভাবনা নিয়ে কথাবার্তা শেষ হয়ে যাবে এখানেই। বরং ম্যাচটা তখন কলঙ্কের একটা দাগ হয়ে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে। যেমন আছে ২০০৩ বিশ্বকাপে কানাডা ও কেনিয়া, ২০০৭ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ড।

নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা ইতিহাস আছে। তবে তা এতটাই পুরোনো যে এখন আর সেটি অনেকের মনেও থাকে না। কারণ, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের টেস্ট–পূর্ব সময়ে আইসিসি ট্রফিতে। বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর দুই দলের ক্রিকেট দ্বৈরথেও অবশ্য যথেষ্টই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছাপ। যেখানে জয়-পরাজয়ে সমতা। যদিও ম্যাচই হয়েছে মাত্র ২টি। ২০১০ সালে গ্লাসগোতে বাংলাদেশ হেরেছে, জিতেছে ২০১১ বিশ্বকাপে চট্টগ্রামে।

বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে একবারই মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। সে ম্যাচে জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন মুশফিকরা

পয়েন্ট তালিকায় এক দল আটে, দশে আরেক দল। তবে তা শুধুই নেট রান রেটের বিচারে। পয়েন্ট তো দুই দলেরই ২ করে। মানে একটি করে জয়। সব জয়েই ২ পয়েন্ট। তারপরও সব জয় সমান নয়। এই বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের একমাত্র জয়টাই যেমন বাংলাদেশের জয়ের চেয়ে একটু বেশি মহিমান্বিত। কারণ, সেটি এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। সর্বশেষ ম্যাচেই যে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে রীতিমতো উড়ে গেছে বাংলাদেশ।

উড়ে যাওয়ার কথা বললে অবশ্য নেদারল্যান্ডস আরও এগিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আগের ম্যাচটাতেই ৩০৯ রানের বিশাল পরাজয়ের কারণেই না পয়েন্ট তালিকায় সবার শেষে তাদের নাম। এক অর্থে আজকের ম্যাচটা তাই এই বিশ্বকাপের তলানিতে পড়ে থাকা দুই দলের লড়াই। তবে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড়। ওই যে বলছিলাম, ‘ফাইনাল’!