‘নির্বাচকেরা কী চান, আমি নিশ্চিত নই। এ নিয়ে আমি একদমই বিচলিত নই। দলে নিলে থাকব, না নিলে থাকব না’—নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি–টোয়েন্টি সিরিজে ব্যাট হাতে ব্যর্থ হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বলেছিলেন স্টিভেন স্মিথ। কথাগুলো থেকেই স্পষ্ট, আগামী জুনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ–যুক্তরাষ্ট্রে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে না পারলেও তাঁর সমস্যা নেই। এ নিয়ে তিনি ভাবছেন না।
কিন্তু টেস্টে ভালো করতে না পারা স্মিথকে ভাবাতে বাধ্য। অস্ট্রেলিয়ার ৩৪ বছর বয়সী এই তারকা ব্যাটসম্যান ক্রিকেটের যে ‘ফ্যাবুলাস ফোর’–এর একজন হয়ে উঠেছেন, সেটা তো মূলত টেস্ট ক্রিকেটে বছরের পর বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে রান করে যাওয়ার কারণেই। কিন্তু বন্ধুপ্রতিম সতীর্থ ডেভিড ওয়ার্নারের অবসরের পর তাঁর জায়গা নিতে গিয়ে; মানে চার নম্বর ব্যাটিং পজিশন ছেড়ে ওপেনার হতে গিয়ে স্মিথকে আর স্বরূপে দেখা যাচ্ছে না।
১২, ১১*, ৬, ৯১*, ৩১, ০, ১১, ৯—এই হলো টেস্ট ওপেনার স্মিথের ব্যাটিং খতিয়ান। ৮ ইনিংসে ১৭১ রান, ব্যাটিং গড় ২৮.৫০; যা তাঁর ক্যারিয়ার গড়ের (৫৬.৯৭) প্রায় অর্ধেক। ‘ওপেনার’ স্মিথ যে ফর্ম নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন, সেটা তাঁর মুখাবয়ব দেখেই বোঝা যায়। নয়তো কি আর নিশ্চিত আউট হয়েছেন বুঝেও রিভিউ নিতে যান!
সর্বশেষ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গতকাল ক্রাইস্টচার্চ টেস্টের শেষ ইনিংসে ব্যক্তিগত ৯ রানে ম্যাট হেনরির বলে এলবিডব্লু হয়েছেন স্মিথ। প্রথম ইনিংসেও এলবিডব্লুর ফাঁদে পড়েছেন; নিউজিল্যান্ডের অভিষিক্ত পেসার বেন সিয়ার্সকে দিয়েছেন প্রথম টেস্ট উইকেটের স্বাদ। বল স্মিথের প্যাডে লাগতেই ধারাভাষ্যকাররা বলছিলেন, খুব সম্ভবত রিভিউ নষ্ট হতে চলেছে। স্মিথ এরপরও রিভিউ নিয়েছেন ‘কোনোরকমে যদি বেঁচে যাই’ জাতীয় মনস্তাত্ত্বিক দ্বিধা থেকে।
ব্যাটিং স্টান্সের সময় তিন স্টাম্প ছেড়ে দিয়ে রাখলেও ব্যাট চালানোর আগমুহূর্তে শাফল করে অফ স্টাম্পের বাইরে চলে আসেন স্মিথ। তাঁর এই কৌশল নিয়ে অতীতে অনেক কথা উঠলেও এভাবেই সাফল্য পাওয়ায় একসময় সমালোচকদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু চার নম্বর থেকে ওপেনিংয়ে উঠে আসার পর স্মিথের ব্যাটিংয়ের কৌশলগত দুর্বলতা স্পষ্ট ধরা পড়ছে। এ নিয়ে আবারও নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
আগে চার নম্বরে নামায় বেশির ভাগ সময় স্মিথকে কিছুটা পুরোনো বল সামলাতে হতো। তখন বলের মুভমেন্টও থাকত কম। কিন্তু ওপেনিংয়ে উঠে আসার পর প্রতিনিয়ত নতুন বল সামলানোর চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে। নতুন বলের সিম মুভমেন্ট বারবার পড়তে ভুল করছেন স্মিথ। বিশেষ করে ইনসুইং করে ভেতরে ঢোকা বলগুলো তাঁকে বড্ড ভোগাচ্ছে।
যাঁর ফল—১০৯ টেস্টের ক্যারিয়ারে এ নিয়ে তৃতীয়বার একই ম্যাচের দুই ইনিংসেই এলবিডব্লু। সর্বশেষ ২০১৪ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে আবুধাবি টেস্টের দুই ইনিংসেই এলবিডব্লু হয়েছিলেন স্মিথ। প্রথমবার দুই ইনিংসেই এভাবে আউট হয়েছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষেই, ২০১০ সালে লর্ডসে নিজের অভিষেক টেস্টে।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েলিংটনে আগের টেস্টেও দুই পেসার ম্যাট হেনরির সিম লেংথ ডেলিভারি আর টিম সাউদির আউট সুইংয়ে ভুগেছেন স্মিথ। এবারের নিউজিল্যান্ড সফর তিনি শেষে করতে যাচ্ছেন টেস্ট সিরিজে মাত্র ১২.৭৫ গড় নিয়ে। অথচ তাসমানপারের প্রতিবেশী দেশটিতে খেলা আগের তিন ইনিংসের একটিতে সেঞ্চুরি, দুটিতে ফিফটি ছিল তাঁর; ব্যাটিং গড় ১৩১!
ব্যাটিং পজিশন পাল্টালেও কৌশল না বদলানোই স্মিথ বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আরও আলোচনা হতে পারে। তবে টেস্টে এ বছরটা তাঁর একদমই ভালো কাটছে না। অভিষেকের পর ২০১২ সাল ছাড়া সব বছরেই টেস্ট খেলেছেন স্মিথ। এর মধ্যে কমপক্ষে ১০ ইনিংস খেলেছেন ভিন্ন ৯ বছরে। ২০২৪ সালে টেস্টে এখন পর্যন্ত ১০ ইনিংসে ২১৩ রান করেছেন স্মিথ, ব্যাটিং গড় ৩০.৪২; যা কমপক্ষে ১০ ইনিংস ব্যাট করা বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।
স্মিথকে অবশ্য টেস্টের আগে টি–টোয়েন্টিতে ওপেনারের ভূমিকায় দেখা গেছে। গত নভেম্বরে টি–টোয়েন্টিতে প্রথমবার ওপেনিংয়ে নেমে ফিফটি করলেও তা ছিল ভারতের দ্বিতীয় সারির দলের বিপক্ষে বিশাখাপট্টনমের ব্যাটিং–স্বর্গে। এর পর থেকে তাঁর ফর্ম পড়তির দিকে। এই সংস্করণে আরও তিনবার ওপেনিংয়ে নেমে করেছেন ১৯, ১১ ও ৪ রান।
অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নাইটলি’তে সম্প্রতি লেখা এক কলামে স্মিথকে তাই টি–টোয়েন্টি ছেড়ে টেস্ট ও ওয়ানডেতে মনোযোগী হতে বলেছেন একসময়ের সতীর্থ মিচেল জনসন। ‘ওপেনার’ স্মিথের পরিসংখ্যান জানা থাকলে জনসন হয়তো তাঁকে এই পজিশন ছেড়ে চারে ফিরে যাওয়ারও পরামর্শ দিতেন।
কোনো টেস্ট ওপেনারের ৮ ইনিংস দেখেই তাঁকে বিচার করা হয়তো একটু তাড়াহুড়ো হয়ে যায়। তা ছাড়া ব্যর্থতার ভিড়েও ‘ওপেনার’ স্মিথ তো একবার আলোও ছড়িয়েছেন। কিন্তু ব্রিসবেনে শামার জোসেফ বীরত্বের কাছে তাঁর অপরাজিত ৯১ রানের ইনিংসটা আড়ালে পড়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া সেই টেস্ট জিতলে স্মিথই হয়ে যেতেন মহানায়ক। কিন্তু একটুর জন্য তাঁকে হতে হয়েছে ট্র্যাজেডির নায়ক, টেস্ট ইতিহাসে ‘ক্যারি দ্য ব্যাটের’ সর্বশেষ কীর্তি গড়েও পুড়তে হয়েছে হারের যন্ত্রণায়।
তবে স্মিথকে যে ক্রিকেটপ্রেমীরা চারে দেখেই অভ্যস্ত। নতুন পজিশনে তিনি যেমন মানিয়ে নিতে পারছেন না, ভক্ত–সমর্থকেরাও হয়তো ‘ওপেনার’ স্মিথকে মেনে নিতে পারছেন না। তা না হলে তাঁর আউট হওয়ার একটি ভিডিওতে ‘স্মিথি, তুমি চারেই সবচেয়ে মানানসই’—এ জাতীয় মন্তব্য আসত না।
এ তো গেল ভক্তের চাওয়া। স্মিথ নিজেও নিশ্চয় উপলব্ধি করবেন জাভেদ মিয়াঁদাদ, শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা, জ্যাক ক্যালিসদের মতো কিংবদন্তিরা বছরের পর বছর ধরে টেস্টে চারে ব্যাটিং করেই সাফল্যের চূড়ায় উঠেছেন। তিনি নিজেও ছিলেন সেই পথে। টেস্টে চার নম্বর পজিশনে তাঁর ব্যাটিং গড় (৬১.৫০) ক্যারিয়ার গড়ের চেয়েও বেশি।
নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে গিয়ে স্মিথ তাই নিজেরই ক্ষতি করছেন না, একজন বিশেষজ্ঞ ওপেনারেরও জায়গা দখল করে আছেন—এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) তাঁকে নিজের পছন্দের জায়গায় খেলার যে স্বাধীনতা দিয়েছে, সেই স্বাধীনতা থেকেই তিনি চাইলে তো আবার চারে ফিরতেই পারেন।
স্মিথ কি তা ভেবে দেখবেন?