ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা
ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা

উৎপল শুভ্রর লেখা

রোহিত শর্মা: শুরুতেই চ্যাম্পিয়ন, শেষেও কি

রোহিত গুরুনাথ শর্মার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের চক্রপূরণ কি তাহলে সম্পন্ন হলো, নাকি কিছুটা এখনো বাকি! 

বাকি যা আছে, তা আলাদা থাকুক। একটা চক্রপূরণ তো হয়েই গেছে। অ্যাডিলেডের জবাব দেওয়া হয়ে গেছে গায়ানায়। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই সেমিফাইনাল প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল রোহিত শর্মার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার নিয়েই। ২৮ বলে করেছিলেন ২৭। ভারতের ৬ উইকেটে ১৬৮ টপকাতে ইংল্যান্ডের দুই ওপেনারের পর আর কাউকে নামতে হয়নি। পরের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলতে রোহিতকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় ১৪ মাস। আর কখনো খেলতে পারবেন কি না, এ প্রশ্নও উঠেছিল। 

সঙ্গী ছিলেন বিরাট কোহলিও। রোহিতের চেয়ে একটু ভালো করেছিলেন। ৪০ বলে ৫০। তারপরও কোহলির ভারতের টি-টোয়েন্টি দলে ফেরা আরও চার দিন পরে। তা এই বছরের শুরুতেই। গায়ানায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এবারের সেমিফাইনালটা রোহিত শর্মার জন্য তাই শুধুই ফাইনালে ওঠার ম্যাচ ছিল না। ওই যে চক্রপূরণের কথা বলছিলাম, সেটি সম্পন্ন করার ম্যাচও। তা সুসম্পন্ন করায় তাঁর ৩৯ বলে ৫৩ রানেরও বড় ভূমিকা।

অ্যাডিলেডের ওই সেমিফাইনাল শুধু রো-কো জুটির ক্যারিয়ারের গতিপথই বদলে দেয়নি, বদলে দিয়েছে ভারতীয় দলের টি-টোয়েন্টি দর্শনও। ১০ উইকেটে পরাজয়ের লজ্জায় ডাগআউটে মুখ ঢেকে বসে থাকা রোহিত সেদিনই সহ-ওপেনার কেএল রাহুলকে বলেন, ‘এভাবে চলবে না। ভারতকে খেলার ধরন বদলাতে হবে।’

২০২২ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০ উইকেটে পরাজয়ের পর

তা বদলাতে হলে তো খেলতে হবে। গত জানুয়ারিতে অধিনায়ক হয়ে টি-টোয়েন্টি দলে ফেরার পর থেকে সেই বদলানোর কাজটাই করে যাচ্ছেন। তবে সেটি যত না টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে, তার চেয়ে বেশি ওয়ানডেতে। বিশ্বকাপের আগে এ বছর ভারত টি-টোয়েন্টিই তো খেলেছে মাত্র ৩টি। রোহিতের ফেরাটা টানা দুই শূন্য দিয়ে। পরের ম্যাচে অপরাজিত ১২১। রোহিতের নতুন দর্শনে অবশ্য রানসংখ্যাটা মুখ্য নয়। মুখ্য হলো, ইনিংসটার প্রভাব। স্ট্রাইক রেটে যার কিছুটা প্রতিফলন ঘটে। সেটি ‘মাত্র’ ১৭৫.৩৬।

ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে বলের রঙে যেমন মিল, তেমনি এই দুটিতে রোহিত শর্মার ব্যাটিংয়েও। পাওয়ারপ্লের সুযোগ নিয়ে শুরুতেই ঝড় তুলে পরের ব্যাটসম্যানদের কাজ সহজ করে দেওয়া। গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিয়মিতই তা করেছেন। করছেন এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও। অন্যদের কাছ থেকে চাওয়াটা বুঝিয়ে দিতে অধিনায়ক নিজে তা করে দেখাতে পারলে সবচেয়ে ভালো। তবে রোহিতের যে দর্শন, তাতে নিঃস্বার্থ হতে হয়। নিজের উইকেট মায়া ছাড়তে হয়। তা ছেড়েছেন বলেই তাঁর প্রতি সতীর্থদের এমন শ্রদ্ধা, ভারতের সত্যিকার অর্থেই ‘রোহিত শর্মার দল’ হয়ে ওঠা।

আহমেদাবাদে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের না জেতার কারণ হিসেবে একেকজন একেকটা বলতে পারেন। তবে একটা কারণ মনে হয় ‘কমন’ থাকবে। ট্রাভিস হেড। ব্যাটিংয়ে যা করেছেন, তা তো পরে। এর আগেই তো ট্রাভিস হেড ওই ফাইনালের সুর বেঁধে দিয়েছেন দারুণ এক ক্যাচে রোহিত শর্মাকে দ্রুত ফিরিয়ে দিয়ে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালেও ভারতের পারা না-পারাটাও হয়তো লেখা আছে অধিনায়কের ব্যাটেই।

ওয়ানডে বিশ্বকাপের মতো এই বিশ্বকাপও দেখছে ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মার পরিণত রূপ। আয়ার‍ল্যান্ডের বিপক্ষে নিউইয়র্কের ওই ব্যাটিং-দুরূহ উইকেটে অপরাজিত হাফ সেঞ্চুরি যদি ব্যাটসম্যানশিপের এক প্রদর্শনী হয়, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪১ বলে ৯২ শিল্পিত এক তাণ্ডব। নাসের হুসেইন যেটিকে বলছেন সাদা বলের ক্রিকেটে তাঁর দেখা সেরা ইনিংসগুলোর একটি। এই স্বীকৃতি মনে হয় সর্বজনীনই হবে। ২৯ রানপ্রসবা মিচেল স্টার্কের ওই একটা ওভারই তো এমন মনে করানোর জন্য যথেষ্ট।

এই বিশ্বকাপে তাঁর চেয়ে বেশি রান আছে দুজনের। তবে তাঁদের কেউই আর বিশ্বকাপে নেই। শীর্ষে থাকা রহমানউল্লাহ গুরবাজকে ছাড়িয়ে যেতে মাত্র ৩৪ রানই লাগে। রোহিত শর্মা নিশ্চয়ই ফাইনালে এর চেয়েও বেশি রান করতে চান। তবে তা বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হতে নয়। ৯০-এর ঘরে গিয়েও সেদিন সেঞ্চুরির কথা ভাবেননি। এই খুচরো রেকর্ড নিয়ে তিনি কেন ভাববেন! বড় ইনিংস খেলতে চাইবেন শুধু একটা কারণেই। তাহলে যে চক্রপূরণটা পুরোপুরি সম্পন্ন হয়।

সব কটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা দুই ক্রিকেটারের একজন তিনি। এটাই হয়তো শেষ। ট্রফিটা হাতে নিতে পারলে শুরু আর শেষটাও মিলে যায়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের একমাত্র শিরোপাটা ২০০৭ সালে সেই প্রথম আসরে। ২০ বছরের তরুণ রোহিত শর্মার আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষেকও সেখানেই। যুবরাজ সিংয়ে ছয় বলে ছক্কার ওই ম্যাচে অবশ্য ব্যাটিং করার সুযোগই হয়নি। পরের তিনটি ইনিংসেই অপরাজিত; রান ৫০, ৮ ও ৩০। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তাঁর প্রথম ইনিংস অপরাজিত ৫০ আবার আজকের ফাইনালের প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই। আর অপরাজিত ৩০ পাকিস্তানের বিপক্ষে মহানাটকীয় ওই ফাইনালে। সেটিও মাত্র ১৬ বলে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তখন একেবারেই নতুন। তিন মাস আগে ওয়ানডে অভিষেক হয়েছে। খেলেছেন মাত্র দুটি ম্যাচ। ১৭ বছর পর রোহিত শর্মা ক্যারিয়ারের অস্তবেলায় দাঁড়িয়ে আরেকটি শিরোপার সামনে। মাত্র সাত মাসের মধ্যেই দ্বিতীয়বার। ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালে হারার জ্বালা মেটানোর ব্যাপার আছে, আছে ভারতের দীর্ঘ শিরোপা–খরার অবসান ঘটানোর তাড়না, সঙ্গে বোধ হয় আরেকটা ছোট্ট ব্যাপারও। রাহুল দ্রাবিড়কে একটা বিদায়ী উপহার দেওয়া।

ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও কোচ রাহুল দ্রাবিড়

এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরই দায়িত্ব ছাড়ছেন ভারতীয় দলের কোচ। বর্ণাঢ্য খেলোয়াড়ি জীবনে যাঁর অনেক অর্জনের মধ্যেও একটা শূন্যতার হাহাকার বাজে। বিশ্বকাপ যে জেতা হয়নি। খেলোয়াড় হিসেবে সুযোগ এসেছিল, কোচ হিসেবেও। দুবারই অস্ট্রেলিয়ায় রাহুল দ্রাবিড়ের স্বপ্নভঙ্গ।

এ কারণে জিততে চাইবেন, ও কারণে জিততে চাইবেন—এসব কথার অবশ্য কোনো অর্থ হয় না। বিশ্বকাপ জিততে চাওয়ার জন্য এত কারণ লাগে নাকি!