এক দশক ধরে বৈশ্বিক শিরোপা জিততে পারছে না ভারত। সর্বশেষ ২০১৩ সালে মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে ভারত চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতেছিল। এরপর ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি এবং ২০২১ ও ২০২৩ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে হেরেছে দলটি।
ভারতীয়দের বৈশ্বিক ট্রফির দীর্ঘ খরা ঘোচানোর সুবর্ণ সুযোগ আসতে যাচ্ছে এ বছরই। অক্টোবর-নভেম্বরে নিজেদের দেশে ওয়ানডে বিশ্বকাপ আয়োজন করবে ভারত। ক্রিকেট মহাযজ্ঞের ঠিক দুই মাস আগে বিসিবিকে নতুন অধিনায়ক বেছে নেওয়ার পরীক্ষায় পড়তে হলেও স্বাগতিক ভারত ও অন্য ৮ দলের এ ধরনের চিন্তা নেই। সব ঠিক থাকলে রোহিত শর্মার নেতৃত্বেই ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ খেলবে ভারত। সেটা হলে ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথমবার রোহিতকে অধিনায়ক হিসেবে দেখা যাবে। এর আগে ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও এ বছর বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে রোহিত নেতৃত্ব দিয়েছেন।
দলের অধিনায়ক হওয়ায় বিশ্বকাপে রোহিত ‘অটো চয়েস’ হিসেবে থাকছেন, সেটা না বললেও চলে। তবে ভারত বিশ্বকাপ জিততে চাইলে রোহিতকে বড় ম্যাচে ভালো করতে হবে বলে মনে করেন সালমান বাট। পাকিস্তানের সাবেক এই অধিনায়কের দাবি, রোহিত আইসিসি আয়োজিত টুর্নামেন্টের নকআউট ম্যাচগুলোতে চাপের মুখে ভেঙে পড়েন।
২০১০ সালে স্পষ্ট ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার দায়ে নিষিদ্ধ হওয়া বাট তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে বলেছেন, ‘আমি মানছি যে রোহিত বড় মাপের খেলোয়াড়। কিন্তু (রোহিতসহ) আরও কজন খেলোয়াড় আছে, যারা দীর্ঘ সময় ধরে খেললেও চাপের মুখে পারফর্ম করতে পারে না। বিশেষ করে নকআউট পর্যায়ে। বিষয়টা নিয়ে ভারতকে কাজ করতে হবে।’ রোহিতকে নিয়ে বাটের মন্তব্য এটাই প্রথম নয়। এর আগে ভারতীয় অধিনায়ককে ‘আনফিট’ ও অলস ক্রিকেটার বলেছিলেন বাট।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সম্প্রতি টেস্ট অভিষেক হয়েছে ভারতের উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান ঈশান কিষানের। ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণে তাঁর শুরুটা ভালোই হয়েছে। প্রথম টেস্টে একবারই ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। ১ রানে ছিলেন অপরাজিত। তবে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে তুলে নিয়েছেন ঝোড়ো ফিফটি। এরপর ওয়ানডে সিরিজের ৩ ম্যাচেও করেছেন ফিফটি। সিরিজসেরার পুরস্কারটাও কিষানের হাতে উঠেছে। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফরের শেষ ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরিও করেছেন। অথচ ওই ইনিংসের পরেই দল থেকে বাদ পড়েন।
সালমান বাটের মতে, দারুণ প্রতিভাবান কিষান ধারাবাহিকভাবে ভালো করলেও তাঁকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপে কিষানকে বাদ দিয়ে রোহিতের ওপেনিং সঙ্গী হিসেবে হয়তো শুবমান গিলকেই বেছে নেওয়া হবে, ‘ঈশানকে নিয়ে ভারতের পরীক্ষাটি বিভ্রান্তিকর ছিল। ২০০ রান করার পরও একজন খেলোয়াড়কে বাদ দেওয়া হচ্ছে...এর কারণ কী হতে পারে? তাদের (ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট) ব্যাপারটি স্বীকার করতে হবে, সে (কিষান) দ্বিতীয় বিকল্প। এমনকি সে এক ইনিংসে ১০০০ রান করলেও ধারাবাহিকভাবে সুযোগ দেওয়া হবে না। এটি কখনোই আপনাকে সেরা হওয়ার অনুভূতি দেয় না। এটি কখনোই এ অনুভূতি দেয় না যে আপনি আপনার পারফরম্যান্সের জন্য পুরস্কৃত হবেন। বর্তমানে তার অনুভূতি এমন যে আপনি যা–ই করুন না কেন (যত ভালোই খেলুন না কেন), আপনি হবেন দ্বিতীয় বিকল্প। কিন্তু আমার চোখে সে আর বেঞ্চ শক্তি পরখ করে দেখার মতো খেলোয়াড় নয়। তার চেয়ে বেশি কিছু।’
বাটের কথাগুলোকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। বিশেষ করে সাবেক পাকিস্তানি অধিনায়ক ভারতের বর্তমান অধিনায়ক রোহিতকে নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, সেটার পক্ষে অতীত ইতিহাস সাফাই দিচ্ছে।
২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক (৬৪৮) রোহিত আইসিসি আয়োজিত আসরের বড় ম্যাচগুলোতে খুব একটা ভালো করতে পারেননি। ২০০৭ সালে ভারতের হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জেতা রোহিত এরপর আর কোনো বৈশ্বিক শিরোপা জিততে পারেননি। সেটার অন্যতম কারণ, নকআউট পর্বের ম্যাচগুলোতে তাঁর প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে না পারা।
২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে ২০২৩ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়ন ফাইনাল পর্যন্ত আইসিসি আয়োজিত টুর্নামেন্টের নকআউট পর্বে ১৭ বার ব্যাটিং করেছেন রোহিত। এর মধ্যে দুটি সেঞ্চুরি থাকলেও নেই কোনো ফিফটি।
দুটি সেঞ্চুরিই বাংলাদেশের বিপক্ষে; যার একটিতে আবার লেগে আছে কলঙ্কের দাগ। মেলবোর্নে ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের বিতর্কিত কোয়ার্টার ফাইনালের কথা কি নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হবে?
যাই হোক, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে মিডল অর্ডার ও লোয়ার মিডল অর্ডারে ব্যাট করতেন রোহিত। তাই দাবি করতে পারেন, বড় ইনিংস খেলার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাননি। কিন্তু সর্বশেষ এক দশকে সব বৈশ্বিক আসরে ওপেন করেছেন রোহিত। কিন্তু নকআউট পর্বের বেশির ভাগ ম্যাচেই হয়েছেন ব্যর্থ।
২০১৫ ও ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে রোহিত ব্যাট হাতে করেছিলেন যথাক্রমে ৩৪ ও ১। ম্যানচেস্টারে গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের ওই সেমিতে নিউজিল্যান্ডের ম্যাট হেনরি ও ট্রেন্ট বোল্ট ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপের ওপর দিয়ে ৩০ মিনিটের যে ঝড় বইয়ে দিয়েছিলেন, সেটার শুরুটা হয়েছিল রোহিতের আউট হওয়ার মধ্য দিয়ে।
ঢাকায় ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে ২৯ রান করলেও স্ট্রাইক রেট নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলা চারটি সেমিফাইনালেও আহামরি কিছু করতে পারেননি—২০০৭ সালে ৮*, ২০১৪ সালে ২৪, ২০১৬ সালে হাতের তালুর মতো চেনা মাঠ মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে ৪৩ এবং ২০২২ সালে ২৭ রান করেছিলেন।
২০১৩ ও ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালেও রোহিত ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ দুটির একটিতেও দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেননি—একটিতে ৯, অন্যটিতে করেছেন ০। বৈশ্বিক আসরের নকআউট পর্বে ম্যাচে একমাত্র ‘ডাক’টি মেরেছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে; মোহাম্মদ আমিরের সেই বিধ্বংসী স্পেলের প্রথম শিকার হয়ে।
২০১৩ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালেও বড় ইনিংস খেলতে পারেননি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে করেছিলেন ৩৩। আইসিসি আয়োজিত এই টুর্নামেন্টে সেরা ইনিংসটা খেলেছেন চার বছর পর আরেকটি সেমিফাইনালে; ২০১৭ সালে এজবাস্টনে বাংলাদেশের বিপক্ষে করেছিলেন অপরাজিত ১২৩ রান।
তবে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দুটি ফাইনালেই হতাশ করেছেন রোহিত। ৪ ইনিংস মিলিয়ে করেছেন ১২২ রান; গড় ৩০.৫০। নেই কোনো ফিফটি। ২০০৬ সালে ভারত অনূর্ধ্ব–১৯ দলের হয়েও বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছেন রোহিত। কলম্বোয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে সে ম্যাচেও ৪ রানে আউট হয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
‘রোহিত শর্মা চাপে ভেঙে পড়ে’—সালমান বাটের দাবিটা তাহলে অমূলক নয়!