বিশ বছর আগে এই দিনে সাউদাম্পটনে ইতিহাসের প্রথম টি–টোয়েন্টি ম্যাচে টসের আগে দুই অধিনায়ক হ্যাম্পশায়ারের ক্রিস অ্যাডামস ও সাসেক্সের জন ক্রলি
বিশ বছর আগে এই দিনে সাউদাম্পটনে ইতিহাসের প্রথম টি–টোয়েন্টি ম্যাচে টসের আগে দুই অধিনায়ক হ্যাম্পশায়ারের ক্রিস অ্যাডামস ও সাসেক্সের জন ক্রলি

উৎপল শুভ্রর লেখা

টি–টোয়েন্টির জন্মদিনে স্টুয়ার্ট রবার্টসনকে স্মরণ

ক্রিকেটের রং বদলে দেওয়া ২০ ওভারের ক্রিকেটের ২০তম জন্মদিন আজ। টি–টোয়েন্টির জন্মের ইতিহাস লিখতে গিয়ে স্টুয়ার্ট রবার্টসনকে স্মরণ করলেন উৎপল শুভ্র

স্টুয়ার্ট রবার্টসন এখন কোথায় আছেন, কী করেন কিছুই জানি না। গুগল নামের আশ্চর্য প্রদীপের শরণাপন্ন হলে দশমিক ৩৮ সেকেন্ডে স্টুয়ার্ট রবার্টসনের নামসংবলিত ১ কোটি ৪৮ লাখ লেখা-ছবি-ভিডিও চোখের সামনে হাজির করছে। আমি যে স্টুয়ার্ট রবার্টসনকে খুঁজছি, গুগল তো আর শুধু তাঁকেই খুঁজছে না। নামটাও এমন কোনো আনকমন নয়, এই নামে কত মানুষই তো আছে! গুগলে আসা সব তো আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব নয়। যতটুকু পারলাম, দেখলাম। কোনোটাতেই স্টুয়ার্ট রবার্টসনের হালহকিকতের খবর নেই।

আপনার মনে নির্ঘাত প্রশ্ন জেগেছে, এই স্টুয়ার্ট রবার্টসনটা আবার কে? তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, তা জানতেই–বা কেন এত কৌতূহল! বিষয়টা যেহেতু খেলা, অনুমান করে নেওয়া স্বাভাবিক, এই স্টুয়ার্ট রবার্টসন কোনো ক্রিকেটার–ফুটবলারই হবেন বা অন্য খেলার কেউ। নামটা শুনতেও বেশ ক্রিকেটার ক্রিকেটার লাগে। এই নামে জিম্বাবুয়ের একজন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটার আছেও দেখলাম। কিন্তু আমি যে স্টুয়ার্ট রবার্টসনকে খুঁজছি, তিনি কোনো ক্রিকেটার নন। শখে হয়তো ক্রিকেট খেলেছেন বা খেলেন। তবে তা বলার মতো কিছু নয়। তাহলে তিনি কে?

টি–টোয়েন্টির জন্মের ইতিহাস বলতে গেলে স্মরণ করতেই হবে স্টুয়ার্ট রবার্টসনকে

প্রশ্ন তো এটাই এবং এই প্রশ্নটা যে আপনি করছেন, এ নিয়ে স্টুয়ার্ট রবার্টসনের একটু দুঃখ হতেই পারে। ক্রিকেটার নন, কিন্তু ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার পেছনে যে বড় ভূমিকা আছে তাঁর। ক্যারি প্যাকারের পর ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় বিপ্লবটা এই ভদ্রলোকের কল্যাণেই।

ক্রিকেট নামের জটিল কিন্তু আনন্দময় খেলাটি নিশ্চয়ই কারও একক আবিষ্কার নয়। টেস্ট ক্রিকেট নামের বটবৃক্ষ থেকে ঝুরি হয়ে নেমে আসা ওয়ানডে ক্রিকেটও নয়। টি-টোয়েন্টি এখানেই ব্যতিক্রম। স্টুয়ার্ট রবার্টসনও এখানেই অনন্য। সাদা বল, কৃত্রিম আলো আর রঙিন পোশাকে ক্রিকেটকে বদলে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া মোগল ক্যারি প্যাকার। সেই ‘বিপ্লব’-এর মূলে ছিল ব্যবসা। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের টিভিস্বত্ব না পেয়ে চ্যানেল নাইনের মালিক বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের কিনে নিয়ে নিজেই শুরু করে দিয়েছিলেন ‘বিদ্রোহী’ এক সিরিজ। সেই উদ্ভাবন ছিল প্রতিহিংসাপ্রসূত ব্যবসায়িক উচ্চাভিলাষ। আর স্টুয়ার্ট রবার্টসনেরটা চাকরির দায়।

কাউন্টি ক্রিকেটে ক্রমহ্রাসমান দর্শকসংখ্যাই ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডকে নতুন কিছু ভাবতে বাধ্য করেছিল। সেটি ভাবার দায়িত্ব তো ইসিবির বিপণন ব্যবস্থাপকেরই।

কাউন্টি ক্রিকেটে ক্রমহ্রাসমান দর্শকসংখ্যাই ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডকে নতুন কিছু ভাবতে বাধ্য করেছিল। সেটি ভাবার দায়িত্ব তো ইসিবির বিপণন ব্যবস্থাপকেরই। স্টুয়ার্ট রবার্টসন ভেবে ভেবেই সমাধান বের করে ফেলেননি। যাঁরা ক্রিকেট মাঠে আসেন, তাঁরা কেন আসেন; আর আসেন না, কেন নয়—এই জরিপকেন্দ্রিক বাজার গবেষণায় আজ থেকে ২১ বছর আগেই ব্যয় করা হয়েছিল দুই লাখ পাউন্ড। যেটির ফলাফলই জানিয়ে দিয়েছিল দর্শকচাহিদা—বৈকালিক বিনোদনের জন্য সংক্ষিপ্ততর কিছু।

ঘণ্টা তিনেকের বিনোদন জোগাতে রবার্টসনের বিশ-বিশ ৪০ ওভারের ক্রিকেটের প্রস্তাব ২০০১ সালে কাউন্টি দলগুলোর চেয়ারম্যানদের সভায় পাস হলো ১০-৭ ভোটে। যার অর্থ, আর মাত্র দুজন চেয়ারম্যান বিপক্ষে ভোট দিলেই ক্রিকেটে যুগ-বদলের এই ঘটনা আর ঘটে না।

ভাবতে বিস্ময়করই লাগে, যে ইংল্যান্ড ক্রিকেট ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় পূজারি, সেই রক্ষণশীলতার দুর্গ থেকেই কি না জন্ম টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের! ২০০৩ সালে রোজ বোলে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক টি-টোয়েন্টি ম্যাচের দুই দল ছিল হ্যাম্পশায়ার ও সাসেক্স। যেটির শুরু লক্ষ্যভ্রষ্টতায়, জেমস কার্টলির প্রথম বলটিই ওয়াইড। কিন্তু সেটি প্রতীকী হয়ে ওঠার বদলে টি-টোয়েন্টি (তখন বলা হতো, Twenty20) প্রথম ম্যাচ থেকেই যাকে বলে ‘সুপারহিট’। লর্ডসে Twenty20 cup-এর মিডলসেক্স–সারে ম্যাচে দর্শক হয়েছিল ২৭ হাজার ৫০৯ জন। ওয়ানডে ফাইনাল বাদ দিলে ১৯৫৩ সালের পর কোনো কাউন্টি ম্যাচে যা সর্বোচ্চ।

কখনো ক্রিকেট মাঠে আসেন না, এমন একটা দর্শকশ্রেণিকে মাঠে টেনে আনার জন্য যে টি-টোয়েন্টির আবিষ্কার, তা এমন অর্থকরী হয়ে উঠবে, এটা তিনি কীভাবে ভাববেন!

ক্রিকেটের সঙ্গে এই যে ‘সুপারহিট’ কথাটা অবলীলায় ব্যবহার করে ফেললাম, এটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে টি-টোয়েন্টির চরিত্র! উইকেট এখানে সস্তা, চার-ছয় মুড়িমুড়কি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হুড়োহুড়ি…তাৎক্ষণিক আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফেরা এবং দ্রুতই সেই স্মৃতিতে ধুলা পড়ে যাওয়া। সময়টাই কি এখন এমন! কোনো কিছুরই গভীরে না গিয়ে ভাসা–ভাসা বোধ আর ক্ষণিকের উত্তেজনাই আমাদের জীবন!

তাঁর চিন্তাপ্রসূত টি-টোয়েন্টি এমন সর্বব্যাপী হয়ে উঠে ক্রিকেটের চেহারাই বদলে দেবে, স্টুয়ার্ট রবার্টসন সুদূরতম কল্পনাতেও তা ভেবেছেন বলে মনে হয় না। এটি যে এমন সোনার ডিম পাড়া হাঁস হয়ে উঠবে, সেটি তো নয়ই। টাকাকে খোলামকুচি বানিয়ে ফেলা আইপিএল নিলামের সময় একটু কি দীর্ঘশ্বাস পড়ে রবার্টসনের? পুরোনো একটা সাক্ষাৎকারে দেখেছি, মজা করে বলছেন, ‘এই যে টি-টোয়েন্টিতে এত টাকা, আমার কিন্তু এক টাকাও বাড়তি আয় হয়নি।’

চাকরির দায় বলেন বা কর্তব্য, তা থেকেই স্টুয়ার্ট রবার্টসনের এই আবিষ্কার। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কখনো দেখা হলে একটা প্রশ্ন করবই করব বলে ঠিক করে রেখেছি। ‘মিস্টার স্টুয়ার্ট, আপনার কি কখনো আফসোস হয়, আহা, ইসিবি থেকে বেরিয়ে গিয়ে টি-টোয়েন্টির আইডিয়াটা কেন প্যাটেন্ট করে ফেলিনি? তাহলে দাবি করা যেত, যেখানেই টি-টোয়েন্টি হবে, লাভের এত পার্সেন্ট আমাকে দিতে হবে। শুধু আইপিএল থেকে তা পেলেই তো স্টুয়ার্ট রবার্টসনের পরবর্তী কয়েক পুরুষ পায়ের ওপর পা তুলে আরামে জীবন কাটিয়ে দিতে পারত।

স্টুয়ার্ট রবার্টসনের হয়তো আফসোস হয়, হয়তো হয় না। চিন্তাটাই তো অবাস্তব। তার চেয়েও বড় কথা, কখনো ক্রিকেট মাঠে আসেন না, এমন একটা দর্শকশ্রেণিকে মাঠে টেনে আনার জন্য যে টি-টোয়েন্টির আবিষ্কার, তা এমন অর্থকরী হয়ে উঠবে, এটা তিনি কীভাবে ভাববেন! কেই–বা তা ভাবতে পেরেছিল!