দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ১৯ ঘণ্টার ফ্লাইট। এমন দীর্ঘ সফরের পর সারাটা দিন বিশ্রামে কাটাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু ডেভিড মিলার তা করলেন কই! ফরচুন বরিশালের হয়ে বিপিএল খেলতে আজ সকালে ঢাকায় পৌঁছে বিমানবন্দর থেকে হোটেলে গেলেন। বিশ্রাম নিলেন দুই ঘণ্টার মতো। এরপর দলের সঙ্গে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের অনুশীলনে হাজির এই প্রোটিয়া তারকা! একাডেমি মাঠে অবশ্য মিলারকে বেশিক্ষণ অনুশীলন করতে দেখা গেল না।
থ্রো ডাউন স্পেশালিস্ট রমজানের বলে নক করেছেন কিছুক্ষণ। এরপর মেহেদী হাসান মিরাজ ও তাইজুল ইসলামের বলে ব্যাটিং করেছেন মিনিট বিশেক। বাকি সময়টা তিনি কাটিয়েছেন আড্ডায় আড্ডায়। অধিনায়ক তামিম ইকবালের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা সময় নিয়ে কথা বলেছেন, বরিশালের অন্য বিদেশিদের সঙ্গেও কথা বলতে দেখা গেল। একাডেমি মাঠে দৌড়াতে আসা বাংলাদেশ জাতীয় দলের ফিল্ডিং কোচ নিক পোথাসের সঙ্গে কিছুক্ষণ খুনসুটি করলেন। পোথাস দক্ষিণ আফ্রিকান, সে জন্যই হয়তো দুজনের আড্ডাটা বেশ জমল।
বরিশাল দলে মিলারের সতীর্থ পেস বোলিং অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনও। মিলারের সঙ্গে তাঁর আবার অন্য রকম স্মৃতি আছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে সাইফউদ্দিনের বলে ৫টি ছক্কায় এক ওভারে ৩১ রান নিয়েছিলেন মিলার। আজ মাঠে যাওয়ার সময় টিম বাসে ওই স্মৃতি নিয়েও দুজন মিলে হাসাহাসি করেছেন।
বোঝাই যাচ্ছিল, আগামীকাল চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে এলিমিনেটর ম্যাচের আগে নিজ দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হতেই মিলারের মাঠে যাওয়া। তাদের সঙ্গে আড্ডায় আড্ডায় কন্ডিশনের তথ্যও জোগাড় করে নিলেন এই বাঁহাতি।
অনুশীলন শেষে মিলার সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘ক্লান্ত লাগছে, বিশ্রাম প্রয়োজন। তবে মানসিকভাবে বুঝতে হবে শরীরের কী প্রয়োজন। আজ বেশ গরম। কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ারও ব্যাপার আছে। সবার সঙ্গে পরিচিতও হওয়া দরকার। দলটাকে ভালোভাবে জানা দরকার। দিন শেষে নিজের শরীরকে বোঝার ব্যাপার আছে।’
আরেক প্রশ্নের উত্তরে মিলার আরেকটু ব্যাখ্যা করলেন, ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে অনেক চাহিদা থাকে। শরীরের ওপর চাপও পড়ে যায়। কিন্তু আমার মনে হয় মানসিকভাবে আপনাকে বুঝতে হবে আপনার শরীর কীভাবে কাজ করছে, কী চায়। আমি আজ খুব বেশি অনুশীলন করতে চাইনি। অল্প অনুশীলনের পর কিছু বল খেলে অনুভূতিটা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে, সতীর্থদের সঙ্গেও পরিচিত হতে হবে। যেটা বললাম, আমি সকালে এসেছি। আগে আমার দলকে জানতে হবে। কিছুটা সময় লাগে এতে। প্রায় দুই ঘণ্টা হলো এখানে এসেছি। কালকের ম্যাচের দিকে মনোযোগ দিতে চাই। আমার কাছে বিষয়টা হলো, শরীর কীভাবে কাজ করে। প্রত্যেকের ধরনটা ভিন্ন। তারা ভিন্ন ভিন্নভাবে নিজেদের মানিয়ে নেয়।’
৩৪ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার জানেন ম্যাচে তাঁকে কী করতে হবে। সে জন্য তাঁর প্রস্তুতিটা কেমন হওয়া উচিত, সেটাও। মিলার বললেন দীর্ঘদিন শীর্ষ পর্যায়ে খেলার ইতিবাচক দিক নাকি এটাই, ‘১৬ বছর ধরে খেলছি, আমি আমার খেলাটাকে ভালো করে বুঝি। মন ভালো অবস্থায় আছে, এটা নিশ্চিত করা জরুরি।’
ফিনিশার হিসেবে তাঁর ব্যাটিং-দর্শনটাও জানালেন মিলান, ‘সময়ের সঙ্গে আপনি সবকিছু আরও ভালো বুঝতে থাকবেন। টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দ্রুত বদলে যায়, অনেক রকম পরিস্থিতি আসে। কন্ডিশন, রানরেট—এসব দেখে এগোতে হয়। হাতে কম ওভার থাকলে মারতে হয়। ভিন্ন পরিস্থিতি অনুযায়ী ভিন্নভাবে এগোতে হয়।’
ফিনিশার হিসেবে এমন পরিণতবোধ এসেছে গত কয়েক বছরে। এর আগে মিলার ছিলেন ‘কিলার-মিলার’। যেদিন ব্যাটে লাগবে, সেদিন প্রতিপক্ষের বোলারদের ওপর ঝড় বইবে। তবে ক্যারিয়ারের শুরুতে সেই দিনগুলো খুব বেশি আসেনি। অধারাবাহিকতার তকমা নিয়ে খেলতে হয়েছে অনেকটা সময়।
সর্বশেষ চার বছরে মিলারের ব্যাটিংয়ে যোগ হয়েছে ভিন্নমাত্রা; বিশেষ করে স্পিনের বিপক্ষে তাঁর ব্যাটিংয়ে উন্নতি মিলারকে আরও ধারাবাহিক করেছে। গত ৪ বছরে ৪৪টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচের মধ্যে ৩৯ ইনিংস ব্যাটিং করে মিলারের রান করেছেন ৯৫৯, গড় ৪১.৬৯, স্ট্রাইক রেট ১৫১, যেখানে ক্যারিয়ারের প্রথম ১০ বছর মিলারের গড় ছিল ৩৩, স্ট্রাইক রেট ১৪৪।
এত বড় পরিবর্তনের দারুণ একটা ব্যাখ্যা দিলেন মিলার, ‘আমি জানি না, এখানে কেউ ড্রিংক করে কি না। বলা হয়, যত সময় যায় রেড ওয়াইন তত ভালো হয়। যখন আপনার বয়স বাড়বে, আরও ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আপনি অতীত থেকে শিখবেন। অনেক ক্রিকেটারের মতো আমরা কেউই খেলাটা সম্পূর্ণভাবে বুঝি না। তাই আপনাকে শেখার মধ্যে থাকতে হবে। আপনাকে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে এবং যতটুকু সম্ভব শিখতে হবে।’
এই শিক্ষা বিপিএলেও বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটারদের শেখাতে চান মিলার। অল্প সময়ের জন্য হলেও বিপিএলে ছাপ রেখে চান এই দক্ষিণ আফ্রিকান, সেটা মাঠে ও মাঠের বাইরেও, ‘আমি দলে যতটা সম্ভব অবদান রাখতে চাই। আমি যেমন তরুণদের থেকে শিখতে পারি, তারাও তেমনি আমার থেকে শিখতে পারে। ছেলেরা ভালো খেলছে, আমি আমার ভূমিকা রাখতে চাই।’
টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের বড় ইতিবাচক দিক এটাই। বড় অঙ্কের টাকায় বিদেশি তারকারা শুধু পারফর্ম করতেই আসেন তা নয়; মাঠের বাইরেও স্থানীয়দের খেলায় ছোট্ট হলেও উন্নতি আনা তাঁদের অলিখিত দায়িত্ব। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সময়ে বেড়ে ওঠা মিলার একসময় সে শিক্ষা নিজের ক্যারিয়ারে কাজে লাগিয়েছেন। এবার তা বিলিয়ে দেওয়ার পালা।