ম্যাচ জয়ের পর বাংলাদেশের দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান তাওহিদ হৃদয় ও শরীফুল ইসলামের উচ্ছ্বাস
ম্যাচ জয়ের পর বাংলাদেশের দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান তাওহিদ হৃদয় ও শরীফুল ইসলামের উচ্ছ্বাস

শেষ ওভারে বাংলাদেশের নাটকীয় জয়

জিততে দরকার ৬ বলে ৬ রান, হাতে ৫ উইকেট—টি-টোয়েন্টিতে এর চেয়ে সহজ সমীকরণ আর কী হতে পারে! সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে আজ আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে এমন সহজ কিছুর সামনেই দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ দল। কিন্তু শেষ ওভারে যা হলো, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য!

শেষ ওভারে হ্যাটট্রিক করে ম্যাচ জমিয়ে তোলেন আফগান পেসার করিম জানাত। ক্ষণিকের জন্য মনে হচ্ছিল ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বেঙ্গালুরুর সেই ম্যাচটাই বুঝি ফিরে আসছে সিলেটে! সে ম্যাচ বাংলাদেশ হেরেছিল ২ রানে, কিন্তু আজ চূড়ান্ত নাটকীয়তার পর বাংলাদেশই ম্যাচটা জিতেছে ২ উইকেটে। দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশ এখন এগিয়ে ১-০ তে।

মেহেদী হাসান মিরাজ করিম জানাতের প্রথম বলটা কাভার উড়িয়ে পাঠালেন বাউন্ডারিতে, ৪ রান। গ্যালারিভর্তি দর্শকেরা তখন জয়ের উৎসব শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু পরের বলেই পুরো স্টেডিয়ামকে হতাশায় ডুবিয়ে শর্ট মিড উইকেট ক্যাচ তোলেন মিরাজ। পরের বলে তাসকিন আহমেদও আউট! বাংলাদেশের জিততে তখন দরকার ৩ বলে ২ রান। তখনো সহজ ম্যাচ, কিন্তু এ কী করলেন নাসুম আহমেদ! ক্রিজে এসেই জানাতের আরও একটি বাউন্সারে এলোপাতাড়ি ব্যাট চালিয়ে থার্ড ম্যানে ক্যাচ। ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাটট্রিক আর অবিশ্বাস্য এক জয়ের সম্ভাবনায় জানাতের উন্মাদনা তখন দেখে কে!

৩২ বলে অপরাজিত ৪৭ রান করেছেন তাওহিদ হৃদয়

বাংলাদেশের জিততে তখন প্রয়োজন ২ বলে ২ রান, স্ট্রাইকে শরীফুল ইসলাম। তিনিও ক্রিজে এসেই মিরাজ, তাসকিন, নাসুমের মতোই ব্যাট চালালেন। কিন্তু এবার আর আউট নয়, বাউন্ডারি মেরে নায়ক হয়ে গেলেন শরীফুল। তাঁর কাট শট চলে গেল পয়েন্টের ফাঁকা জায়গায়। বাউন্ডারিতে মেরেই বুনো উদ্‌যাপনে মাতেন শরীফুল। দৌড়ে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন তাওহিদ হৃদয়। কয়েক বলের জন্য চুপসে যাওয়া দর্শকেরাও তখন আবার মেতেছেন উৎসবে। নাটকীয়তায় ঠাসা ম্যাচে ১ বল বাকি থাকতে আসা জয়টাই এখন টি-টোয়েন্টিতে আফগানদের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ (১৫৪) রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড। এর আগের রেকর্ড ছিল ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে ১৩৮ রান টপকে পাওয়া জয়।

আফগানদের দেড় শর ওপর রান করা মানেই রান তাড়া সহজ করতে পাওয়ারপ্লেতে দ্রুত রান তুলতে হবে। সে জন্য মুজিব উর রেহমান ও ফজলহক ফারুকির বলে মেরে খেলতে হবে। তাতে আউট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে এবং হয়েছেও তা-ই। রনি তালুকদার ও নাজমুল হোসেন আউট হয়েছেন ফারুকি ও মুজিবের বলে।

পাওয়ারপ্লেতে ২ উইকেট হারিয়ে রান আসে মাত্র ৩৭। সেটাও লিটন দাসের এক-দুই রানের সৌজন্যে। কিন্তু পাওয়ারপ্লের পরের ওভারেই ওমরজাইয়ের লেংথ বল পুল করতে গিয়ে ক্যাচ তোলেন লিটন (১৮)। ৩৯ রান তুলতেই বাংলাদেশের ৩ উইকেট নেই। বৃষ্টিতে প্রায় ২০ মিনিট খেলা বন্ধ থাকার পর সাকিবের ৩টি বাউন্ডারি ঝিমিয়ে পড়া গ্যালারিকে যেন নতুন করে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু ১৭ বলে মাত্র ১৯ রান করেই ফরিদ আহমেদের বলে পয়েন্টে ক্যাচ তোলেন সাকিব। ১০.১ ওভারে ৬৪ রানে বাংলাদেশের ৪ উইকেট নেই।

আফগানিস্তানের আরও একটি উইকেটের পতন। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাস

তখনো রশিদের তিন ওভার বাকি। সেখান থেকে আফগান বোলিংয়ের বিপক্ষে জয়ের আশা করা বাড়াবাড়িই মনে হচ্ছিল। কিন্তু ২০ ওভারের খেলাটা খুব দ্রুতই রং বদলায়। ১৩তম ওভারে ওমরজাইয়ের ওভারে যখন তাওহিদ হৃদয় ও শামীম হোসেন ২২ রান তুলে ফেলেন, তখন হুট করেই রান রেট চলে আসে নাগালে।

দুজনই আক্রমণাত্মক হয়েছেন ১৭তম ওভার, ফারুকিকে চার-ছক্কায় উড়িয়ে সে ওভারে ১৬ রান নিয়ে জয়ের সমীকরণটা নামিয়ে আনেন ১৮ বলে ১৯ রানে। যে ওভারটি নিয়ে ভয় ছিল, সেই রশিদের শেষ ওভারে শামিম লেগের দিকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট হন। তবে ২৫ বলে ৩৩ রানের ইনিংসে শামীম নিজের কাজটা করে দিয়ে যান। ৪টি চার ছিল তাঁর ১৩২ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসে। শামীমের আউটে হৃদয়ের সঙ্গে ৪৩ বলে ৭৩ রানের জুটিও ভাঙে। পরের গল্পটা তো সবার জানা। বাংলাদেশের ২ উইকেটের জয়ে সর্বোচ্চ ৩২ বলে ৪৭ রান আসে হৃদয়ের ব্যাট থেকে।

বাংলাদেশের বোলিংয়ে শুরুটা ভালো হয়েছে সিলেটের ঘরের ছেলে নাসুমের হাত ধরে। ইনিংসের প্রথম ওভারে মাত্র ২ রান দেওয়ার পর দ্বিতীয় ওভারেই উইকেট! সেটাও বিস্ফোরক ব্যাটসম্যান হযরতউল্লাহ জাজাইয়ের (৮)। নাসুমের নতুন বলের সঙ্গী তাসকিন আহমেদও বেশিক্ষণ উইকেটশূন্য ছিলেন না। ঠিক পরের ওভারেই তাসকিনের স্লোয়ার বল স্কয়ার লেগে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ আউট হন গুরবাজ। আফগান টপ অর্ডারের আরেক ব্যাটসম্যান ইব্রাহিম জাদরানের জন্য শরীফুল ইসলাম তো ছিলেনই। এর আগে ওয়ানডে ও টেস্টে শরীফুলের বলে চারবার আউট হয়েছেন ইব্রাহিম। তরুণ এই বাঁহাতি পেসারের আজ ইব্রাহিমকে আউট করতে লেগেছে চার বল। এবারও আগের চারবারের মতো কট বিহাইন্ড ইব্রাহিম (৮ রান)।

চোখের পলকে তিন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের উইকেট হারিয়ে আফগান ব্যাটিং যখন ধুঁকছিল, তার মধ্যেই সাকিবের বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে লং অফে ক্যাচ আউট হন করিম জানাত। মেহেদী হাসান মিরাজের বল কাট করতে গিয়ে লিটনের গ্লাভসে ধরা পড়েন নজিবুল্লাহ জাদরান। আফগান ইনিংসের এই ভঙ্গুর দশায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মোহাম্মদ নবী। এক-দুই রানে মাঝের কঠিন ওভারগুলো কাটিয়ে আফগান ইনিংসকে তিনি নিয়ে যান নিরাপদ জায়গায়। ৪টি চার ও ১টি ছক্কায় তিনি অপরাজিত ছিলেন ৪০ বলে ৫৪ রানে। ওদিকে ওমরজাই খেলেছেন ১৮ বলে ৩৩ রানের বিস্ফোরক ইনিংস, ৪টি ছক্কা ছিল তাতে। দুজনের জুটিতে ৩১ বলে এসেছে ৫৬ রান। ইনিংসের শেষ ৫ ওভারে ৬০ রান তুলে আফগানদের রানটাকে দেড় শর ওপারে নিয়ে যায় এই জুটি।