আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম রূপান্তরিত খেলোয়াড় হতে যাচ্ছেন ড্যানিয়েলে ম্যাকগাহি। ২৯ বছর বয়সী এই ব্যাটার আগামী ৪ সেপ্টেম্বর শুরু হতে যাওয়া মেয়েদের ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আঞ্চলিক বাছাইপর্বে কানাডার হয়ে খেলবেন।
আগামী বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে মেয়েদের আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে।
আইসিসি জানিয়েছে, পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পেতে যে মানদণ্ড নির্ধারণ করা আছে, ম্যাকগাহি তা পূরণ করেছেন। তবে নারীদের লিঙ্গভিত্তিক অধিকার সুরক্ষায় কাজ করা ‘উইমেনস রাইটস নেটওয়ার্ক’ রূপান্তরিত খেলোয়াড়েরা ‘তাৎপর্যপূর্ণ সুবিধা’ পেয়ে থাকেন জানিয়ে বলছে, আইসিসির সিদ্ধান্ত ‘অন্যায্য ও অনিরাপদ’।
বর্তমানে জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে ফুটবল আর ক্রিকেটে রূপান্তরিত নারীদের মেয়েদের দলে খেলার সুযোগ আছে। অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, সাইক্লিং ও রাগবিতে মেয়েদের ইভেন্টে রূপান্তরিত নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ।
বিবিসির খবরে বলা হয়, ম্যাকগাহির জন্ম ও বেড়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়ায়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কানাডায় পাড়ি দেওয়ার আগপর্যন্ত মেলবোর্নের একটি ক্লাবে পুরুষ দলের হয়ে খেলতেন। কানাডায় যাওয়ার পর খেলতেন সাচকাচুয়ান প্রদেশের ক্যাভালিয়ার্স সিসির হয়ে। এরপর একই বছরের নভেম্বরে সামাজিকভাবে নারীতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেন, যার মেডিক্যালি-রূপান্তর শুরু হয় ২০২১ সালের মে মাসে।
এরই মধ্যে গত বছরের অক্টোবরে কানাডার হয়ে ব্রাজিলে সাউথ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপে চারটি ম্যাচও খেলেছেন ম্যাকগাহি। তবে সেসব ম্যাচ আইসিসি স্বীকৃত ছিল না। এখন ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আমেরিকা অঞ্চলের বাছাই দিয়ে অভিষেক হতে যাচ্ছে ম্যাকগাহির।
৪ সেপ্টেম্বর লস অ্যাঞ্জেলেসে প্রথম দিনে ব্রাজিলের মুখোমুখি হবে ম্যাকগাহির কানাডা। এই বাছাইয়ে অপর দুই দল যুক্তরাষ্ট্র ও আর্জেন্টিনা। আঞ্চলিক বাছাইয়ের বিজয়ী দল খেলবে বৈশ্বিক বাছাইয়ে। যেখান থেকে দুটি দল জায়গা করে নেবে চূড়ান্ত পর্বে। স্বাগতিক বাংলাদেশসহ মোট ১০ দল নামবে বিশ্বকাপ ট্রফির লড়াইয়ে।
২০১৮ সালে আইসিসি যে ‘খেলোয়াড় যোগ্যতা প্রবিধান’ প্রণয়ন করে, সেখানে রূপান্তরিত ব্যক্তির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ নিয়ে সংস্থাটির অবস্থান সম্পর্কে বলা আছে। ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা রূপান্তরিত নারীদের খেলার সুযোগ রেখেছে কিছু মানদণ্ড পূরণের ভিত্তিতে। এর মধ্যে আছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সিরামে টেস্টোস্টেরনের ঘনত্ব কমপক্ষে ১২ মাস ধরে ক্রমাগত নির্দিষ্ট একটি পর্যায়ে থাকা ও নারী পরিচয়ে লিখিত ঘোষণা প্রদান।
ম্যাকগাহির বিষয়ে আইসিসির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা নিশ্চিত করছি যে ড্যানিয়েল আইসিসির প্লেয়ার এলিজিবিলিটি রেগুলেশনসে বর্ণিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী ক্রিকেটে অংশগ্রহণের যোগ্য হয়েছেন।’
উইমেনস রাইটস নেটওয়ার্কের মুখপাত্র জেন সুলাইভান বিবিসিকে বলেন, জন্মকালীন লিঙ্গের ভিত্তিতে খেলার ক্যাটাগরি করা উচিত। এ বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে এমন ১৭টি পিয়ার-রিভিউ গবেষণা আছে, যেখানে খেলার পারফরম্যান্সে পুরুষ বয়ঃসন্ধির প্রভাব কমানো যায় না বলে উঠে এসেছে। মোটের ওপর ছেলেদের মাসল, হাড়ের গঠন, ফুসফুসের ক্ষমতা সবই বেশি। এমনকি বিশ্বমানের নারী অ্যাথলেটের চেয়ে একটা ১৪ বছর বয়সী বালক গতিসম্পন্ন ও শক্তিশালী হয়ে থাকে। কোনো ক্রিকেট দলে একজন পুরুষ পিউভার্টির ব্যক্তি থাকা মানে নারী খেলোয়াড়ে ভরা দলের বিপক্ষে বাড়তি সুবিধা থাকা। আমরা খেলাধুলায় কাউকে নিষিদ্ধের পক্ষে নই, তবে মেয়েদের খেলা মেয়েদের অংশগ্রহণের জন্য ন্যায্য ও নিরাপদ হতে হবে।’
বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কানাডার প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষ ব্রাজিল। ম্যাকগাহির বিপক্ষে খেলা নিয়ে ব্রাজিল দলের অধিনায়ক রবার্তা মোরেত্তি অ্যাভেরি বলেন, ‘ক্রিকেটের আইনপ্রণেতারা যা ঠিক করে দেন, আমাদের সেটা মানতে হয়। আমার মনে হয় না নিয়মটা ঠিকঠাক। তবে এটা তো কোনো খেলোয়াড়ের দোষ নয়।’
অ্যাভেরির মতে একজন রূপান্তরিত নারীর বোলিংয়ের গতি স্বাভাবিক নারীদের চেয়ে বেশি হতে পারে, যা খেলায় প্রভাবও ফেলতে পারে, ‘এখানে বোলিং নিয়ে বলার আছে। মেয়েদের ক্রিকেটে কাউকে ঘণ্টায় ১৩৫-১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করতে দেখা যায় না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে (রূপান্তরিত নারী) ব্যাপারটা ভিন্ন হতে পারে। এই মুহূর্তে কোনো রূপান্তরিত নারীর বোলিংয়ের উদাহরণ আছে কি না, আমার জানা নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি পৃথিবী বদলাচ্ছে।’
ম্যাকগাহি অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে এসেছেন মূলত নারী রূপে জীবন যাপনের জন্যই। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, অস্ট্রেলিয়ায় থাকা পরিবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই, ‘তাদের সঙ্গে আমার সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছিল ২০২১ সালের অক্টোবরে। আমি নিজেকে অল্প বয়স থেকেই বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু পরিবারের কারণে ওই বয়সে ওই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। এ বিষয়ে তাদের অবস্থান কী আমি জানতাম। এখন যে পরিবারের সঙ্গে আছি, সেটা আমিই বানিয়ে নিয়েছি। ওদের সঙ্গে থাকলে আমি সুখী থাকতে পারি।’
কানাডায় মেয়েদের ক্রিকেটে অংশগ্রহণ শুরুর পর কারও কাছ থেকে নেতিবাচক আচরণের শিকার হননি জানিয়ে ম্যাকগাহি বলেন, ‘আমার মনে পড়ে না কোথাও নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়েছে কি না, বিশেষ করে মাঠে বা দলের সঙ্গে। সবাই অবিশ্বাস্য রকমের সহযোগিতাপূর্ণ।’
বিবিসি বলছে, কানাডার ১৫ বছর ঊর্ধ্ব প্রতি ৩০০ জন মানুষের ১৫ জনই রূপান্তরিত অথবা নন-বাইনারি। এরই মধ্যে দেশটির ক্রীড়াঙ্গন একজন বড়মাপের রূপান্তরিত খেলোয়াড় পেয়ে গেছে। সম্প্রতি শেষ হওয়া ফিফা নারী বিশ্বকাপে কানাডার হয়ে খেলেছেন রূপান্তরিত নারী কুইন। রূপান্তরিত ক্রীড়াবিদ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আইনি, বৈজ্ঞানিক ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে থাকে ফিফা। যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছিল কুইনের ক্ষেত্রে।
অবশ্য বেশির ভাগ বৈশ্বিক খেলা এখনো রূপান্তরিত নারীদের মেয়েদের বিভাগে খেলার অনুমোদন দেয়নি। যার মধ্যে এ বছরের মার্চে রূপান্তরিত নারীদের মেয়েদের ইভেন্টে নিষিদ্ধ করে ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিকস। এ ছাড়া সাইক্লিংয়ে গত ১৫ জুলাই, রাগবিতে ২০২০ সালের অক্টোবর ও সাঁতারে ২০২২ সালের জুনে একই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।