বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন
বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন

নাজমুল এ রকম অখুশি থাকলে দলেরই লাভ

অল্পতেই তুষ্ট—ব্যাপারটিকে অনেক ক্ষেত্রেই মহৎ গুণ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু ক্রিকেটে একটু ভালো করলেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ‘মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা’র ব্যাপারটিকে শুধু বদভ্যাস নয়, একধরনের রোগও বলতে পারেন।

বড় দলের ব্যাটসম্যানদের যখন টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি, ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি কিংবা টি–টোয়েন্টিতে বিস্ফোরক ফিফটি পাওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে আক্ষেপ নিয়ে মাঠ ছাড়তে দেখা যায়, তখন সংস্করণভেদে দেশি ব্যাটসম্যানরা এর অর্ধেক করতে পারলেই যেন খুশি! কিন্তু কাল রাতে নাজমুল হোসেনের কথাগুলো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের তৃপ্তি–অতৃপ্তি নিয়ে মানুষের ধারণা কিছুটা হলেও পাল্টে দেয়নি কি?

দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আফগানিস্তানকে ৬৮ রানে হারিয়ে সিরিজে সমতা ফিরিয়েছে বাংলাদেশ, শারজায় ৩৪ বছরে ১১ বারের চেষ্টায় যা বাংলাদেশের প্রথম জয়ও।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে সমতা এনেছে বাংলাদেশ

তবে মাঠে থেকে মনে রাখার মতো এই জয়ের সাক্ষী হতে পারেননি অধিনায়ক নাজমুল। ফিল্ডিংয়ের সময় বল থামাতে গিয়ে কুঁচকিতে চোট পাওয়ায় ড্রেসিংরুমে লম্বা সময় দর্শক হয়ে থাকতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু এর আগে নাজমুলের ৭৬ রানের ইনিংসই বাংলাদেশের সংগ্রহ ২৫০ পেরোতে সহায়তা করেছে।

গত এক বছরে ওয়ানডেতে শীর্ষ ১০ রান সংগ্রাহকের মধ্যে নাজমুলের ব্যাটিং গড় সবচেয়ে বেশি; ৬১.৬২। এ সময়ে কমপক্ষে ৪৫০ রান করেছেন—এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শুধু বিরাট কোহলির ব্যাটিং গড় তাঁর চেয়ে বেশি; ৬৭.০০।

১১৯ বলে ৭৬ রান, স্ট্রাইক রেট ৬৫–এর নিচে। আধুনিক যুগে একজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের জন্য মোটেও আদর্শ ইনিংস নয়। কিন্তু শারজার মন্থর ও ব্যবহৃত পিচে ব্যাট করার চ্যালেঞ্জটা নিতে হয়েছে বলেই নাজমুলের ইনিংসটা যেন ‘অমূল্য রতন’। এক বছর পর প্রত্যাবর্তন ম্যাচে নাসুম আহমেদের ৩ উইকেট ও শেষ দিকে ব্যাটিংয়ে নেমে ২৪ বলে ২৫ রানের পরও তাই ম্যাচসেরার পুরস্কারটা নাজমুলের হাতেই উঠেছে।

বাংলাদেশ জিতেছে, তার চেয়েও বড় ব্যাপার দল সিরিজ জয়ের আশা বাঁচিয়ে রেখেছে। সেই ম্যাচে নাজমুল পেয়েছেন সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি। সব মিলিয়ে তাঁর তো খুশিই হওয়ার কথা। কিন্তু ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সঞ্চালক রমিজ রাজাকে নাজমুল যা বলেছেন, তা এ দেশের আপামর জনতা শুনে অভ্যস্ত নয়। তিনি দলের পারফরম্যান্স নিয়ে খুশি, নিজের ব্যাটিং নিয়ে নন, ‘সত্যি কথা বলতে, আমি খুব একটা খুশি নই। এই উইকেটে স্পিনের বিপক্ষে ব্যাটিং করা কঠিন। আমার আরেকটু লম্বা ইনিংস খেলা উচিত ছিল।’

কাল ম্যাচসেরা হয়েছেন নাজমুল হোসেন

গতকালের ৭৬ রানের আগে তিন সংস্করণ মিলিয়ে সর্বশেষ ৩৬ ইনিংসে তাঁর ফিফটি ছিল শুধু একটি; ভারত সফরে চেন্নাই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৮২। সেই রান আবার বাংলাদেশের কোনো কাজে আসেনি, হারের ব্যবধান কমিয়েছে মাত্র। কিন্তু ওই ৩৬ ইনিংসের ৩২টিই যে ছিল টেস্ট ও টি–টোয়েন্টি, তা কতজন খেয়াল করেছেন!

ক্রিকেটের তিন সংস্করণের মধ্যে বাংলাদেশকে যেটিতে সবচেয়ে শক্তিশালী মনে করা হয়, সেই ওয়ানডে তো আসলে নাজমুলেরও শক্তির জায়গা; ব্যাট হাতে নিজেকে ধারাবাহিক প্রমাণ করার যথাযথ মঞ্চও।

৯০, ৪৫, ১৫, ৬, ৫১*, ১২২*, ৪০, ১, ৪৭, ৭৬—সর্বশেষ ১০ ওয়ানডেতে তাঁর রান ৪৯৩। সেঞ্চুরি একটি, ফিফটি তিনটি, ৪০ ছোঁয়া ইনিংসও আছে তিনটি। অপরাজিত ছিলেন দুবার। যে ৪ ম্যাচে তিনি কমপক্ষে ৫০ রান করেছেন, সব কটিতেই জিতেছে বাংলাদেশ।

২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে এ বছরের নভেম্বর—গত ১২ মাসের হিসাব করলে নাজমুলকে অনেক উঁচুতেই রাখতে হয়। এই সময়ে ওয়ানডেতে শীর্ষ ১০ রানসংগ্রাহকের একজন তিনি, অবস্থান করছেন সাতে। আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর ব্যাটসম্যানদের হিসাবের বাইরে রাখলে শ্রীলঙ্কার পাতুম নিশাঙ্কা (৬৯৭ রান), চারিত আসালাঙ্কা (৬৬৯ রান) ও কুশল মেন্ডিসের (৫৫১ রান) পরেই তাঁর স্থান। তবে তিন লঙ্কান নাজমুলের চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন।

একটা জায়গায় নাজমুলই সবার ওপরে। গত এক বছরে ওয়ানডেতে শীর্ষ ১০ রান সংগ্রাহকের মধ্যে বাংলাদেশ অধিনায়কের ব্যাটিং গড় সবচেয়ে বেশি; ৬১.৬২। এ সময়ে কমপক্ষে ৪৫০ রান করেছেন—এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শুধু বিরাট কোহলির ব্যাটিং গড় তাঁর চেয়ে বেশি; ৬৭.০০।

ওয়ানডেতে ধারাবাহিকভাবে রান করে যাচ্ছেন নাজমুল হোসেন

অথচ ওয়ানডেতে আগের ৩৬ ইনিংসে তাঁর গড় ছিল ২৮.৪২। টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যান হয়েও কিছুটা মন্থর গতিতে ব্যাট করা নিয়ে যে অভিযোগ, সেখানেও আছে উন্নতির ছোঁয়া। গত এক বছরে ওয়ানডেতে তাঁর স্ট্রাইক রেট ৮৪.৭০, যা ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেটের (৭৯.৯৫) চেয়ে বেশি।

নাজমুলের এই বদলে যাওয়ার শুরু ২০২৩ এশিয়া কাপ দিয়ে। পাল্লেকেলেতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে করেছিলেন ৮৯ রান। এরপর লাহোরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১০৪ রান, যা বাংলাদেশকে এশিয়া কাপের সুপার ফোরে নিয়ে যেতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। সে বছর এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের মাঝে আরেকটি ম্যাচ খেলেছেন নাজমুল। মিরপুরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সে ম্যাচেও করেন ৭৬। ওই ম্যাচ দিয়েই বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে তাঁর অভিষেক।

নেতৃত্বের বাড়তি চাপ মাথায় নিয়েও রান পাওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে তাঁকে যে পাকাপাকিভাবে তিন সংস্করণের অধিনায়ক করা যায়—বিসিবির সেই সময়ের হর্তাকর্তাদের মাথায় এমন ভাবনা হয়তো তখনই এসেছিল।

ওয়ানডে বিশ্বকাপেও শুরুটা দারুণ হয়েছিল নাজমুলের। ধর্মশালায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ৬ উইকেটের জয়ের দিনে উপহার দেন অপরাজিত ৫৯ রানের ঝলমলে ইনিংস। বিশ্বকাপে এর পরের ৬ ম্যাচে ‘সুপার ফ্লপ’—০, ৭, ৮, ০, ৯, ৪। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবার তাঁকে নিয়ে শুরু হয় ট্রল। সেটা এতটাই জেঁকে বসে যে এরপর দিল্লিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৯০ ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪৫ রানের ইনিংস দুটিকে আড়াল করে দেয়।

বিশ্বকাপের ম্যাচে ম্যাথুসকে ‘টাইমড আউট’ করার পরামর্শ নাজমুলই সাকিবকে দিয়েছিলেন

৯০ রানের ইনিংসটি আড়ালে পড়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ সাকিব আল হাসান। সেদিন ২ উইকেট নেওয়ার পর ৬৫ বলে ৮২ রান করে সাকিব ম্যাচসেরা হওয়ায় নাজমুলের পাদপ্রদীপের আলোয় না আসারই কথা। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ‘টাইমড আউট’ করার ঘটনায় যখন সাকিবের নাম জড়িয়ে যায়, তখন তো আলোর সান্নিধ্যই পাওয়ার কথা নয় নাজমুলের। কিন্তু অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে ‘টাইমড আউট’ করার বুদ্ধিটা তো সেদিন নাজমুলই সাকিবকে দিয়েছিলেন!

ব্যর্থতার সেই ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশ গত বছর একটি ওয়ানডে সিরিজ খেলেছে নিউজিল্যান্ড সফরে। তবে শারজায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে এই সিরিজের আগে এ বছর ৩২ ম্যাচ খেলে ফেললেও সবই ছিল টেস্ট অথবা টি–টোয়েন্টি।

যে সংস্করণে বাংলাদেশ সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ত, সেই সংস্করণ থেকেই প্রায় ১১ মাস দূরে। ব্যাপারটা নিশ্চয় নাজমুলকেও তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। এই সময়ে তিনি তিন সংস্করণেরই নেতৃত্ব পেয়েছেন, তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছে, টেস্টে পাকিস্তানকে তাদেরই মাটিতে বাংলাদেশ ধবলধোলাই করেছে। কিন্তু নাজমুলের বলার মতো খুব বেশি ইনিংস নেই হয়তো প্রিয় সংস্করণ ওয়ানডে ছিল না বলেই!

টেস্ট আর টি–টোয়েন্টিতে রানখরা দেখে ‘নাজমুল আর চলে না’ রবও উঠেছিল। কিন্তু ‘অধিনায়ক কোটায়’ খেলেন বলে তিনি তো অটোমেটিক চয়েস। তার মানে, তাঁকে বাদ দেওয়ার একমাত্র উপায় নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া। নানা মাধ্যমে এসব গুঞ্জন নিশ্চয় নাজমুলের কানেও পৌঁছেছিল। হয়তো এ কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ চলার মাঝপথে নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিসিবি শেষ পর্যন্ত তাঁর নেতৃত্বে আস্থা রেখেই আফগানিস্তান সিরিজ খেলতে শারজায় দল পাঠিয়েছে।

আর ওয়ানডে ফিরে আসায় নাজমুলও যেন হারানো ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন। বুধবার প্রথম ওয়ানডেতেও খারাপ করেননি। কিন্তু তিনি ৪৭ রানে আউট হওয়ার পরই বাংলাদেশের ইনিংসে অবিশ্বাস্য ধস নামে। অসময়ে আউট হওয়ায় নাজমুল সেদিন নিজেকেই দুষেছিলেন। এবার তাঁর ৭৬ রানের ইনিংসে দল জেতার পরও নেই কোনো আত্মতৃপ্তি।

নাজমুলের নেতৃত্বে এখনো আস্থা আছে বিসিবির

নিজেকে নিয়ে নাজমুলের এই নয়া দর্শন শুধু তাঁর নয়, বাংলাদেশের জন্যও তো ভালো দিক। দলের স্বার্থে–দেশের স্বার্থে নাজমুল না হয় এমন ‘অখুশি–অখুশি’ ভাব নিয়ে থাকুন!