বাংলাদেশের বোলিং কোচের দায়িত্বও পালন করেছেন হিথ স্ট্রিক (১৯৭৪–২০২৩)
বাংলাদেশের বোলিং কোচের দায়িত্বও পালন করেছেন হিথ স্ট্রিক (১৯৭৪–২০২৩)

জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের ‘জমিদার’, আপনাকে বিদায়

বাড়ি, ফার্মহাউস নাকি রিসোর্ট! মনের মধ্যে যখন এমন প্রশ্নের ঘুরপাক, পাশ থেকে কেউ একজন বলল, জমিদারি। মনে হলো, এটাই তো সঠিক শব্দ!

২০১৩ সালের জিম্বাবুয়ে সফর। বুলাওয়েতে বাংলাদেশের খেলা। বুলাওয়ে মানে অবশ্যই ভিক্টোরিয়া ফলস দর্শন। আর যদি আপনি ক্রিকেটের কেউ হয়ে সেখানে যান, সুযোগ থাকলে নিশ্চয়ই যেতে চাইতেন বুলাওয়ে থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের টাকর্ মাইন এলাকায়। সেই সুযোগটাই নিয়েছিলাম আমরা বাংলাদেশ থেকে সিরিজ কাভার করতে যাওয়া কয়েকজন সাংবাদিক আর বিসিবির পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম।

তা টাকর্ মাইনে কী আছে? আছে বলব, নাকি ছিল! আছেই বলি। টাকর্ মাইনে আমরা যাঁর জমিদারি দেখতে গিয়েছিলাম তিনি এখন অনন্ত নক্ষত্র বিথিমালায় ঠাঁই নিয়েছেন, কিন্তু তাঁর সেই বিশাল সাম্রাজ্য তো এখনো আছে। বুঝতে নিশ্চয়ই পারছেন কার কথা বলা হচ্ছে—হিথ স্ট্রিক।

গত ২৩ আগস্টও একবার তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে স্ট্রিক জানিয়েছিলেন, তিনি বেঁচে আছেন, ভালো আছেন। তবে লিভার আর কোলন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে বেশি দিন থাকতে পারলেন না। এবার সত্যি সত্যি চলে গেছেন। স্ট্রিকের স্ত্রী নাদিনে গতকাল এক ফেসবুক পোস্টে  স্বামীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। পরে জিম্বাবুয়ের সংবাদমাধ্যম হেরাল্ডকে সন্তান হারানোর খবর নিশ্চিত করেছেন স্ট্রিকের বাবা ডেনিসও।

স্ট্রিকের সাম্রাজ্যের আতিথিয়েতা পেয়েছিলেন লেখকসহ বাংলাদেশের আরও কয়েকজন সংবাদকর্মী ও বিসিবি পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম

জিম্বাবুয়ের প্রথম ও একমাত্র বোলার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ১০০ উইকেট নেওয়া স্ট্রিক জীবনের একটা পর্যায়ে জড়িয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গেও। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুই বছর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বোলিং কোচের দায়িত্বে ছিলেন স্ট্রিক।

হিথ স্ট্রিকের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎও তিনি বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেওয়ার বেশ আগে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ দলের জিম্বাবুয়ে সফরের সময়। পাঁচ ওয়ানডের সব ম্যাচই সেবার হয়েছিল স্ট্রিকের ঘরের মাঠ বুলাওয়ে অ্যাথলেটিক ক্লাব গ্রাউন্ডে। যাওয়ার পর থেকেই তক্কে তক্কে ছিলাম হিথ স্ট্রিকের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। কিন্তু স্ট্রিক তত দিনে খেলা ছেড়ে টাকর্ মাইনে নিজের সাম্রাজ্য সামলাচ্ছেন। অবশ্য ঠিক ওই সিরিজের আগেই তখনকার প্রধান নির্বাচক অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের বিশেষ অনুরোধে নেটে জিম্বাবুয়ের বোলারদের টুকটাক পরামর্শ দিতে নেটে আসছিলেন স্ট্রিক।

সাক্ষাৎকার নিতে অ্যাথলেটিক ক্লাবেরই এক কোচের মাধ্যমে যোগাযোগ হলে স্ট্রিক আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বুলাওয়ে অ্যাথলেটিক ক্লাব গ্রাউন্ডের চেয়ারম্যানস লাউঞ্জে। স্ট্রিক তখনই বলেছিলেন, সুযোগ পেলে আরও ভালোভাবে ফিরতে চান জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে। দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলে অনেক পেয়েছেন, এবার দেশকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চান। পরে অন্য ভূমিকায় ফিরেছিলেনও দেশটির ক্রিকেটে। কিন্তু তত দিনে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট তার স্বর্ণ সময় হারিয়ে ফেলেছে। হিথ স্ট্রিকের মতো তাঁর খেলোয়াড়ি সময়ের আরও কয়েকজন ফিরেও দেশের ক্রিকেটকে ফিরিয়ে দিতে পারেননি সেই সময়।

হিথ স্ট্রিককে মনে রাখবে বাংলাদেশের ক্রিকেট

কিন্তু তাতে কি! জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট থেকে হিথ স্ট্রিকের নামটা হারিয়ে যেতে দেয়নি তাঁর কীর্তিই। স্ট্রিক এখন অতীত, কিন্তু জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে তিনি বা তাঁর সময়ের প্রতিনিধিরা যা দিয়ে গেছেন, তাই দিয়েই তো ক্রিকেটের মানচিত্রে এখনো টিকে আছে জিম্বাবুয়ের নামটা। টিকে থাকবে স্ট্রিকের শখের টাকর্ মাইনের সাম্রাজ্যও।

সেই ১৮৯৯ সাল থেকেই স্ট্রিকের পূর্বপুরুষেরা এর মালিক। পরে যার বেশির ভাগটাই তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন সরকারি অধিগ্রহণে। তবু ২০১৩ সালে গিয়ে আমরা যে সাম্রাজ্য দেখেছি, সেটারই পরিমাণ ছিল ১২ হাজার একরের মতো। গাড়িতে বড় রাস্তা থেকে পাথুরে পথ পেরিয়ে যেতে হয় আরও মিনিট তিরিশেক। এরপর আপনি যখন হিথ স্ট্রিকের ছবির মতো সুন্দর বাড়িতে পৌঁছাবেন, আপনিও হয়তো ওই প্রশ্নটাই করবেন—বাড়ি, ফার্মহাউস নাকি রিসোর্ট! শেষমেশ বলতে বাধ্য হবেন, না; এটা আসলে জমিদারি। ক্রিকেটীয় সামর্থ্য স্ট্রিকের সেই জমিদারিকে বিস্তৃত করে দিয়েছিল জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটেও। স্ট্রিক বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর অস্তিত্ব থেকে যাবে টাকর্ মাইনের পারিবারিক সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটেও।