বিসিবির পরিচালকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর বার্তা—২১ আগস্ট (আগামীকাল) বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের জরুরি সভা। সভার ভেন্যু সচিবালয়ে অবস্থিত যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কনফারেন্স রুম। একই বিষয় চিঠির মাধ্যমেও পরিচালকদের জানানো হয়েছে।
চিঠিটি ছাড়া হয়েছে গতকাল ১৯ আগস্ট, যেটিতে সভার আলোচ্যসূচির তালিকায় আছে তিনটি বিষয়। ২ জুলাই অনুষ্ঠিত ১১তম বোর্ড সভার কার্যবিবরণী অনুমোদন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কার্যক্রম পরিচালনার পথে থাকা চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত এবং বিসিবির ব্যাংক হিসাব পরিচালনার জন্য স্বাক্ষর করার ক্ষমতা প্রদানের সিদ্ধান্ত। চিঠিতে সভা শুরুর সময় উল্লেখ না থাকলেও জানা গেছে, সেটি শুরু হতে পারে বেলা ১১টায়।
জরুরি সভার নোটিশ বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী স্বাক্ষরিত হলেও তার ওপরে লেখা আছে—‘বাই দ্য অর্ডার অব দ্য প্রেসিডেন্ট’ (সভাপতির আদেশক্রমে)।
এই সবই ঠিক আছে। প্রশ্ন হলো বিসিবির পরিচালনা পরিষদের সভা কেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে হবে? সরকার পরিবর্তনের পর এমনিতেই বাংলাদেশের ক্রিকেট স্পর্শকাতর সময় পার করছে। ক্রিকেট বোর্ডে সরকারি হস্তক্ষেপের ব্যাপারে আইসিসির বিধিনিষেধ আছে। সে রকম কিছু হলে আইসিসি থেকে নিষিদ্ধ হতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেট, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে আসন্ন আন্তর্জাতিক সিরিজগুলোয়।
অন্যদিকে বাস্তবতা এটাই যে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্রিকেট বোর্ডেও পরিবর্তন আসবে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া আগেই বলেছেন, যা করার আইসিসির নিয়ম মেনেই করা হবে।
আগামীকালের সভায় সেই নিয়ম মেনেই বিসিবিতে নতুন সভাপতি আনার পথ সুগম হওয়ার কথা। বিসিবি সূত্রে জানা গেছে, সরকারের নির্দেশনায় বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইংল্যান্ডে অবস্থানরত সভাপতি নাজমুল হাসানকে জরুরি বোর্ড সভার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে ই-মেইল করেছেন। সে ধারাবাহিকতায়ই আগামীকাল সভা ডাকা, যাতে সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে পারেন নাজমুল হাসান। এমনকি তিনিও ভার্চুয়ালি যোগ দিতে পারেন সভায়। নাজমুলের সঙ্গে এ সভায় পদত্যাগ করতে পারেন আরও কয়েকজন পরিচালক, যাঁরা আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে বোর্ডে নিষ্ক্রিয় আছেন।
এ রকম একটি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বোর্ড সভা মন্ত্রণালয়ে হওয়া মানে বিসিবিতে ‘সরকারি হস্তক্ষেপ’ হচ্ছে বলে দাবি তোলার সুযোগ করে দেওয়া। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সভাটির দিকে শুধু বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন নয়, তাকিয়ে থাকবে পুরো ক্রিকেট–বিশ্বই।
দেশে যত সমালোচনাই থাকুক, একজন সিনিয়র সদস্য হিসেবে আইসিসিতে ‘শ্রদ্ধাভাজন’ হিসেবে বিবেচিত নাজমুল হাসান। বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে তাঁর বিদায়টা কীভাবে হচ্ছে, তা নিয়ে ক্রিকেট–বিশ্বের কৌতূহল থাকা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন কিছুটা ঘোলাটে এবং সে কারণে এখন পর্যন্ত এটিও নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই যে অক্টোবরে নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, আইসিসির সভা এবং আইসিসির চেয়ারম্যান নির্বাচনসূচি মেনে বাংলাদেশেই হবে।
এ রকম একটা সময়ে, রীতি ভেঙে বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের সেই সভাটি, যাতে বর্তমান সভাপতি পদত্যাগ করবেন বলে জোর আলোচনা, সেটি কিনা হতে যাচ্ছে মন্ত্রনালয়ের মতো সরকারি কর্মপরিচালনার প্রাণকেন্দ্রে! বিসিবি স্বাধীন—এই কথা কি এরপর আর জোর গলায় বলার সুযোগ থাকবে কারও? এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে বিসিবির দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
আগামীকালের জরুরি সভা নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে আছেন বর্তমান পরিস্থিতিতেও সক্রিয় বিসিবির একাধিক পরিচালক, যারা আগামীকাল সভায় যোগ দেবেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁদের একজন এই প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘এ রকম একটি সভা মন্ত্রণালয়ের কনফারেন্স রুমে করাটা ঠিক হচ্ছে না। যাঁরা এটা করছেন, তাঁদের তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের রীতিনীতিটা বুঝতে হবে।’
একই রকম অস্বস্তি প্রকাশ করে আরেক পরিচালক বলেছেন, ‘এটি অত্যন্ত বিব্রতকর। যেকোনো সিদ্ধান্ত তো বোর্ড কার্যালয়ে সভা করেই নেওয়া যায়।’ অন্য এক পরিচালক বিস্ময় নিয়ে বলেছেন, ‘আমি বুঝলাম না, কে এই বুদ্ধিটা দিল! এটা হয় নাকি? এতে তো দেশের ক্রিকেট নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।’ আরেকজন সিনিয়র পরিচালক এ বিষয়ে কোনো মন্তব্যই করতে চাননি।
এমন নয় যে বিসিবি কার্যালয়ের বাইরে এর আগে পরিচালনা পরিষদের সভা হয়নি। ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে তো হয়েছেই, ঢাকার বাইরে সিলেটেও হয়েছে একবার। আবার এমনও নয় যে মন্ত্রণালয়ে ক্রিকেট বোর্ডের সভা হতে কোনো বাধা আছে। কিন্তু বিষয়টা সময়ের, বিষয়টা সভার বিষয়বস্তু এবং গুরুত্বের। যে সময়ে ক্রিকেট–বিশ্বকে পরিষ্কারভাবে বার্তা দিতে হবে যে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সরকারি হস্তক্ষেপ নেই, তখনই পরিচালনা পরিষদের স্পর্শকাতর ও কৌতূহলোদ্দীপক জরুরি সভাটিকে মন্ত্রণালয়ের কনফারেন্স রুমে ঢুকিয়ে দেওয়া সবাইকে ভুল বার্তা দিতে পারে, যেটা হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যই নেতিবাচক।
সভা নিয়ে আরেক বিতর্ক, এতে নাকি আমন্ত্রণ জানানো হয়নি পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলমকে। সে রকম হয়ে থাকলে তা–ও নিয়মের লঙ্ঘন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) প্রতিনিধি হিসেবে বোর্ড পরিচালক হওয়া অভিজ্ঞ এই সংগঠককে গতকাল এনএসসি থেকে পদত্যাগ করতে বলা হলেও তিনি পদত্যাগ করেননি। এনএসসির সচিবকে সাজ্জাদুল আলম পাল্টা জানিয়েছেন, যেহেতু তাঁকে বোর্ড পরিচালক হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে এনএসসি, তাঁরাই যেন তাঁর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন এবং তাঁকে সেটা জানিয়ে দেন।
এনএসসি থেকে এরপর আজ দুপুর পর্যন্ত আর কোনো বার্তা পাননি সাজ্জাদুল আলম। তার মানে তো তিনি এখনো বোর্ড পরিচালক! তাহলে আগামীকালের সভায় তাঁকে কেন ডাকা হলো না, সেটা বোধগম্য নয়। একটি সূত্রে এটাও জানা গেছে যে পরিচালকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সাজ্জাদুল আলমকে। সেখান থেকেও তাই সভা সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়নি তাঁর। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সাজ্জাদুল আলম।
বিসিবির হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এরই মধ্যে চার-পাঁচজন পরিচালক নিশ্চিত করেছেন যে তাঁরা আগামীকালের জরুরি সভায় উপস্থিত থাকবেন। সব মিলিয়ে সভার উপস্থিতি কোরামপূর্ণ করার মতো সংখ্যায় উপনীত হবে নিশ্চিত। সভার যেটা মূল উদ্দেশ্য, নাজমুল হাসানের পদত্যাগও হয়ে যাবে হয়তো। পরিচালনা পর্ষদ থেকে গতকাল পদত্যাগ করা জালাল ইউনুসের জায়গায় এনএসসি মনোনীত পরিচালক হিসেবে বোর্ডে এসে নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ।
কিন্তু এই সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন তোলার সুযোগ রেখে দেবে শুধু একটা সিদ্ধান্ত। সভাটা যে হতে যাচ্ছে এমন এক ‘অ্যাওয়ে ভেন্যু’তে, যেটি ভ্রু কুঁচকে দিতে পারে আইসিসিরও।
সংযোজন: মঙ্গলবার রাত ১২টার পর বিসিবি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বিসিবির পক্ষ থেকেই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই সভার জন্য একটি নিরাপদ ভেন্যুর ব্যবস্থা করে দিতে।