গ্যারেজে কখনো ক্রিকেট খেলা দেখেছেন? গ্যারেজ বলতে বাসাবাড়ির পার্কিং এরিয়ার কথা বলছি। শুধু ক্রিকেট দেখা কেন, অনেকে নিশ্চয়ই গ্যারেজে খেলেছেনও। ঢাকা শহরে খেলার মাঠের কত অভাব। তাই বলে ক্রিকেটপ্রিয় একটা দেশের শিশু–কিশোরেরা তো ক্রিকেট না খেলে থাকতে পারে না!
আশপাশে মাঠ নেই। বৈকালিক বিনোদনে গ্যারেজই ভরসা। অনেক অ্যাপার্টমেন্টেই বিকেল হলে গ্যারেজে ব্যাট বল নিয়ে নামে শিশু–কিশোরেরা। সেটা দেখে আবার ফ্ল্যাট মালিক সমিতির চোখ কপালে ওঠে। কী সর্বনাশ! গ্যারেজে খেলা! গাড়ির কাচ না ভেঙে যায়! মিটিং ডেকে খেলা বন্ধ। নয়তো আচরণবিধি বেঁধে দাও। গ্যারেজে খেললে এই–এই করা যাবে, ওই–ওই করা যাবে না।
তো এভাবেই গ্যারেজ বা পার্কিং এরিয়া আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। সেই অংশীদারত্ব বাড়তে বাড়তে এখন এমন এক জায়গায় যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও ‘শাখা’ হয়ে গেছে একটা গ্যারেজ।
বিশ্বাস হচ্ছে না? বাংলাদেশের ক্রিকেটের অতি সাম্প্রতিক দুটি আলোচিত সংবাদ সম্মেলন দেখুন। দুটিই হয়েছে একটা বিশেষ গ্যারেজে। একটি সংবাদ সম্মেলনের কয়েক ঘণ্টা আগে ঘোষণা দিয়ে, সর্বশেষ আজকেরটি কোনো ঘোষণা ছাড়াই। আলোচিত সেই গ্যারেজ বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের বাসভবনের।
গুলশান–২–এর ১০৮ নম্বর সড়কের এই বাসভবনের গ্যারেজটি হয়তো একদিন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেরই অংশ হয়ে যাবে। শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকা কেন, ক্রিকেট বিশ্বের আর কোন বোর্ড সভাপতির গ্যারেজ নিজেকে এমন কীর্তিধন্য বলে দাবি করতে পারে! ইতিহাস সংরক্ষণের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের উদাসীনতার দুর্নাম আছে। ইতিহাসের সাক্ষী অনেক কিছুই তাই হারিয়ে গেছে। বিসিবি সভাপতির বাসভবনের গ্যারেজটিকে অবশ্যই তা হতে দেওয়া উচিত হবে না। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী কেউ তো এটি দেখতে চাইতেই পারেন!
গত বছর মে মাসে মুমিনুল হক টেস্ট অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন এই গ্যারেজে। গত ৩ আগস্ট তামিম ইকবাল আর ওয়ানডে অধিনায়কত্ব না করার কথাও জানিয়ে দিলেন সেখানেই। আর আজ বিসিবি সভাপতি জানালেন, বিশ্বকাপ পর্যন্ত সাকিব আল হাসানই ওয়ানডে অধিনায়ক, সেটাও তিনি বলেছেন নিজের গ্যারেজে দাঁড়িয়ে। এভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের বহু ঘটনারই সাক্ষী হয়ে যাচ্ছে বিসিবি সভাপতির গ্যারেজ।
এই ভবনের শিশু–কিশোরদের ভাগ্য বলতে হবে। অন্য জায়গায় গ্যারেজে খেলতে বাচ্চাদের কত কাঠখড় পোড়াতে হয়। অথচ তাদের গ্যারেজে প্রতিনিয়ত পা পড়ছে দেশের ক্রিকেট তারকাদের, একটার পর একটা ইতিহাস লেখা হয়ে যাচ্ছে সেখানে। সব তো আর এই মুহূর্তে মনে করে লেখা যাচ্ছে না। কষ্ট করে একটু গুগলে ‘নাজমুল হাসানের বাসভবন’ লিখে সার্চ দিয়ে দেখুন। ইতিহাসের তালিকা চলে আসবে সামনে।
ভেবে ‘গর্ব’ হয় যে আমারও সৌভাগ্য হয়েছে কয়েকবার ওই গ্যারেজ–ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার। মুমিনুল আর তামিমের অধিনায়কত্ব ছাড়ার দিনের কথা তো বললামই, যত দূর মনে পড়ে, এর বাইরেও দু–একবার পেশাগত কারণে ওই গ্যারেজে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।
তবে যে কয়বারই সেখানে গিয়েছি, ওই ভবন এবং ওই এলাকার বাসিন্দাদের প্রতি একটা গোপন মায়া অনুভব করেছি। খারাপ লেগেছে ভবনের নিরাপত্তারক্ষীদের জন্যও। দেশের ক্রিকেটের জন্য তাঁদের ত্যাগ স্বীকার কখনো ভুলবার নয়। উপলক্ষ বিশেষে কয় দিন পরপরই সেখানে এত এত সংবাদকর্মী আর ক্যামেরার ভিড়, সেসব দিনে স্বাভাবিক জীবনযাপনই তো অসম্ভব হয়ে পড়ার কথা অ্যাপার্টমেন্টের অন্য বাসিন্দাদের। রাস্তার পাশে রাখা গাড়ির সারি বাধিয়ে দিচ্ছে যানজট। কী আর করা, ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থে এসব তো সহ্য করে নিতেই হয়।
তামিমের ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছাড়ার রাতের ঘটনা বলি। একটু আগেই তামিমের কালো গাড়ি ঢুকেছে গ্যারেজে। আগে থেকেই সেখানে ভিড় করে থাকা সংবাদকর্মীদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। ক্যামেরার চোখ ঝলসানো আলো আর হুড়োহুড়ির মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে কোনোরকমে ভিড় ঠেলে তামিম লিফটের দিকে এগোলেন। প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কির মধ্যে দারুণ ফুটওয়ার্কের প্রমাণ দিয়ে সাংবাদিকেরা লাইভ দিচ্ছেন, ‘দর্শক, আপনারা দেখছেন…বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের গ্যারেজ… তামিম ইকবাল এসে গেছেন…এখন কী হবে…।’ এভাবে চলতেই থাকল।
একটু পর আরেকটা কালো গাড়ি। তামিম তবু সামনের সিটে বসেছিলেন বলে আগেই তাঁকে দেখা গেছে। এই গাড়িতে চালকের পাশের সামনের সিটে কেউ নেই। কালো কাচ তোলা থাকায় পেছনে কে, সেটাও দেখার উপায় ছিল না। তবে এমন ঘটনার রাতে যখন এসেছেন, নিশ্চয়ই ক্রিকেটের কেউই হবেন। আবারও গেটের সামনে ক্যামেরার হুড়োহুড়ি। অ্যাপার্টমেন্টের এক নিরাপত্তারক্ষী এগিয়ে গিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন, ‘এই বাসার…বাসার…।’ অর্থাৎ, গাড়িটা এই বাসার কারও। কিন্তু বানান করে কে কবে কথা শুনেছে! ‘এই বাসার…বাসার’টাকে তাই কেউ কেউ শুনলেন ‘এই…বাশার…বাশার…।’ মানে নির্বাচক হাবিবুল বাশারের গাড়ি। ব্যস, হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই। ভুল ভাঙল গাড়ি থেকে অন্য একজন বেরিয়ে আসার পর।
তামিমের সংবাদ সম্মেলনের আগে সে রাতের শেষ চমক ছিলেন নাজমুল হাসান নিজে। বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান জালাল ইউনুস সেখানে এসে গিয়েছিলেন আগেই, এরপর তামিম। তখনই জানা গেল, যাঁর কাছে তাঁদের আসা, যাঁর বাসায় এত সংবাদকর্মীর ভিড়; কোনো একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনিই তখনো বাসার বাইরে। তামিম আসার বেশ কিছুক্ষণ পর যখন নাজমুল হাসান এলেন, নিজের বাসায় তাঁর নিজের ঢোকাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। সাংবাদিকেরা ঘিরে ধরেছেন। সব ক্যামেরা, সব মোবাইল তাঁর দিকে তাক করা। কেউ কেউ বিসিবি সভাপতিকে তখনই কিছু বলতে বললেন। কেন অমন অনুরোধ, বুঝিনি। তামিমের সঙ্গে সভাপতির সভাটাই যে তখনো হয়নি!
সে যা–ই হোক, ওই গ্যারেজ যে এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে, তা তো আর অস্বীকার করার উপায় থাকছে না। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আধুনিক সংবাদ সম্মেলনকক্ষ পড়ে আছে। বড় সিদ্ধান্ত জানাতে ভাড়া করা কনফারেন্স হলে সংবাদ সম্মেলন করার মতো যথেষ্ট অর্থবিত্তও আছে বিসিবির।
তবু যখন দেশের ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘোষণার মঞ্চ হয়ে উঠেছে গুলশান–২–এর ১০৮ নম্বর সড়কের ওই গ্যারেজ, সেটিকে বোধ হয় এবার ক্রিকেটীয় সাজে সজ্জিত করারও সময় এসেছে। গ্যারেজেরই কোনো একটা অংশে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চ বানিয়ে তাতে বিসিবির একটা ব্যাকড্রপ লাগিয়ে দিলেই তা হয়ে যায়।
গুলশানের গ্যারেজকে বিসিবির শাখা ধরে নিয়ে সংবাদমাধ্যম তখন এখনকার চেয়েও বেশি প্রস্তুত থাকবে সেখানে যেতে। গ্যারেজে যত বড় ঘটনাই ঘটুক, বিসিবির আগে থেকে সংবাদমাধ্যমকে তা জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকবে না। কারণ, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সংবাদ সংগ্রহ করা মানে যে ওই গ্যারেজেও চোখ রাখা, সেই সংস্কৃতি তখন আনুষ্ঠানিকতা পেয়ে যাবে।
ওহ্, একটা সমস্যা তো আছে। ছোট ছোট বাচ্চারা বড়দের টিপ্পনী কেটে বলতে পারে, ‘কী…আমরা তো তবু গ্যারেজে খেলি। তোমরা যে বাংলাদেশের ক্রিকেটটাই চালাচ্ছ ওখান থেকে!’