রাত পোহালেই ফুরাচ্ছে অপেক্ষার পালা। কাল সকালেই মাঠে গড়াচ্ছে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি। অস্ট্রেলিয়া-ভারতের পাঁচ ম্যাচের সিরিজটা শুরু হচ্ছে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস নিয়ে। দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ের সাম্প্রতিক ইতিহাসই এই সিরিজ নিয়ে আগ্রহের পারদ চড়িয়েছে।
অথচ একটা সময় ছিল অস্ট্রেলিয়া-ভারত সিরিজ মানেই ছিল অস্ট্রেলিয়ার নিরঙ্কুশ প্রাধান্য। অস্ট্রেলীয় দাপটের সেই ছবিটা পাল্টেছে ১৯৯৬ সালে দুই দলের সিরিজের বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি নামকরণের পর।
এরপর যতই সময় গড়িয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজ শুধু বেড়েছেই। এতটাই যে ১৯৯১-৯২ মৌসুমের পর আবারও পাঁচ ম্যাচের সিরিজ খেলতে যাচ্ছে দুই দল। প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজে অ্যাশেজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যাওয়া বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে ম্যাচ বেড়েছে দর্শক আগ্রহ ও ক্রিকেট বাণিজ্যকে মাথায় রেখেই। ২০০৯ সালের পর অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড ও ইংল্যান্ড-ভারতের বাইরে এই প্রথম আরেকটি পাঁচ ম্যাচের দ্বৈরথ দেখতে যাচ্ছে ক্রিকেট।
বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফির শুরু
১৯৯৬ সালে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি চালুর কথা আগেই বলা হয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটে ১০ হাজার ও ১১ হাজার রানের ক্লাবের পত্তন করা দুই ব্যাটসম্যানের সম্মানে সিরিজের নামকরণের পর সে বছরের অক্টোবরে দিল্লিতে একটি টেস্ট খেলে দুই দল। ভারত ম্যাচটি জিতেছিল ৭ উইকেট। ১৯৮১ সালের পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতের সেটিই ছিল প্রথম টেস্ট জয়। ভারতের উইকেটকিপার নয়ন মঙ্গিয়ার প্রথম ইনিংসে করা ১৫২ রানই পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল সেই ম্যাচে।
বদলে যাওয়া ইতিহাস
খ্রিষ্টের জন্মের আগে-পরের মতোই অস্ট্রেলিয়া-ভারত টেস্ট লড়াইটাকেও ১৯৯৬ সালের আগে ও ১৯৯৬ সালের পরে পরিষ্কার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ভারত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলে ১৯৪৭ সালে। সেই সিরিজ থেকে ১৯৯৬ সালে আগে দুই দলের ১২টি সিরিজে মাত্র একবারই সিরিজজয়ী দলের নাম ছিল ভারত। অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল সাতবার।
১৯৯৬ সালের পর পরিসংখ্যানটা বদলে গিয়ে ভারী করেছে ভারতের পাল্লা। ১৯৯৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দুই দলের ১৫টি সিরিজের ৯টিই জিতেছে ভারতীয়রা। এ সময়ে অস্ট্রেলিয়া জিতেছে পাঁচবার। তবে অস্ট্রেলিয়ার সর্বশেষ সিরিজ জয়ের পর কেটে গেছে ১০ বছর। ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়া সর্বশেষ সিরিজ জেতার পর দুই দলের চারটি টেস্ট সিরিজই জিতেছে ভারত। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ ও ২০২০-২১ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ায় টানা দুটি সফরে সিরিজ জিতেছে ভারত। অথচ এই দুই সিরিজের আগে ১১ বারের চেষ্টায় ভারতের সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল তিনবার সিরিজ ড্র করা।
ভারতীয় আধিপত্যের সূচনা
১৯৯৬ সালে দিল্লিতে একমাত্র টেস্ট জয়ের দেড় বছর পর প্রথম পূর্ণাঙ্গ সিরিজ জেতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ১৯৯৮ সালের সিরিজে চেন্নাইয়ে সিরিজের প্রথম টেস্টটা ভারত জেতে প্রথম ইনিংসে ৭১ রানে পিছিয়ে থাকার পরও। দ্বিতীয় ইনিংসে শচীন টেন্ডুলকারের অপরাজিত ১৫৫ রানের দুর্দান্ত একই ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে ৩৪৮ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দেয় ভারত। কুম্বলে-রাজু-চৌহান স্পিন ত্রিফলায় ১৬৮ রানে অলআউট হয়ে ১৭৯ রানে হারে অস্ট্রেলিয়া। ঘরের মাঠের ওই সিরিজে ভারত প্রথম দুই টেস্ট জেতার পর অস্ট্রেলিয়া জেতে শেষ টেস্টটি।
ইডেন–রূপকথা
তিন বছর পর আবার যখন অস্ট্রেলিয়া ভারতে গেল, তাদের নামের পাশে ‘অজেয়’ তকমাটা বসে গেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের টানা ১১ টেস্ট জয়ের বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে সংখ্যাটাকে ১৫ বানিয়ে ভারতে যায় অস্ট্রেলিয়া। মুম্বাইয়ে প্রথম টেস্টটা জিতে সংখ্যাটাকে ১৬ বানিয়ে ফেলে দলটি। এরপর যা হলো, সেটিকে অকল্পনীয় বললেও কম বলা নয়। যেটিকে এককথায় বলা যায় ‘ইডেন–রূপকথা’।
ভারতকে ফলোঅনে ফেলা অস্ট্রেলিয়া তিন দিনের মধ্যেই ম্যাচ জেতার খুব কাছে চলে গিয়েছিল। পরের গল্পটা ভিভিএস লক্ষ্মণ, রাহুল দ্রাবিড় ও হরভজন সিংয়ের। তৃতীয় দিনের পুরোটা ব্যাটিং করেন লক্ষ্মণ ও দ্রাবিড়। লক্ষ্মণের ২৮১ ও দ্রাবিড়ের ১৮০ রানে দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৫৭ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করে ভারত। এরপর হরভজন হ্যাটট্রিকসহ ৬ উইকেট নিয়ে ২১২ রানে অস্ট্রেলিয়াকে থামিয়ে ১৭১ রানের জয় এনে দেন ভারতকে। চেন্নাইয়ে পরের টেস্টেও নায়ক হরভজন, ভারত সেই ম্যাচটি ২ উইকেটে জিতে জিতে নেয় সিরিজও।
লাস্ট ফ্রন্টিয়ার জয়ের পর
স্টিভ ওয়াহ ভারত সফরের নাম দিয়েছিলেন ’লাস্ট ফ্রন্টিয়ার’, এটাই শুধু জেতার বাকি ছিল সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের। ২০০৪ সালে যখন তা জেতে অস্ট্রেলিয়া, সেই সিরিজে অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ভারত সফরে চার ম্যাচের সিরিজে ২-১ ব্যবধানে জেতে অস্ট্রেলিয়া। ওই সিরিজের পর খেলা দুই দলের ৯ সিরিজের সাতটিই জিতেছে ভারত। অস্ট্রেলিয়া জিতেছে শুধু ঘরের মাঠে ২০১১ ও ২০১৪ সালে।
অস্ট্রেলিয়া–দুর্গের পতন
অস্ট্রেলিয়ার ভারত জয় সম্পন্ন হলেও ভারতের অস্ট্রেলিয়া জয় বাকি ছিল। প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয়ের সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ২০১৮ সালে। বিরাট কোহলির ভারত ম্যাচের সিরিজটা জেতে ২-১ ব্যবধানে।
দুই বছর পর আবারও অস্ট্রেলিয়া জয় করে ভারত। এবারের গল্পটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। অ্যাডিলেডে প্রথম টেস্টে ৩৬ রানের অলআউট হওয়ার ধাক্কা সামলে চোটে জর্জরিত এক দল নিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক নিয়ে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জেতে ভারত।