সাকিব আল হাসান নিজেও জানেন ওটা কোনো অজুহাত নয়। বৃষ্টির পর যখন খেলা শুরু হয়, তখনো ম্যাচটা বাংলাদেশের হাতে। ডিএলএসে নতুন লক্ষ্য, জিততে হলে ৯ ওভারে ৮৫ রান করতে হবে। হাতে ১০ উইকেট। এমন ম্যাচ কেউ হারে!
কিন্তু সাকিবরা হারলেন। শেষ বল পর্যন্ত সম্ভাবনা বাঁচিয়ে ৫ রানে হারলেও তাঁরা আসলে হেরে গেছেন আগেই। চার ম্যাচ পর ওপেনিংয়ে ফিরেই বৃষ্টির আগে ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছেন লিটন দাস। বৃষ্টির পর ভেজা মাঠে দুবার পা পিছলে সেই লিটনই রানআউট। লিটন তো নন, যেন বাংলাদেশই ‘আউট’ হয়ে গেল ম্যাচ থেকে! টি-টোয়েন্টির বিচারে সহজ এক ম্যাচকেই ক্ষণে ক্ষণে কঠিন করে ভারতের হাতে তুলে দিল জয়। এমন হারের পর কোনো অজুহাতই টেকে না। সাকিব তাই অজুহাত দিলেনও না।
হ্যাঁ, ভেজা মাঠ হারের একটা অজুহাত হতে পারে। আম্পায়াররা যে সময়ে বাংলাদেশকে ১৬ ওভারে ১৫১ রানের নতুন লক্ষ্য দিয়ে মাঠে নামতে বললেন, সাকিব যে শুরুতে তাতে আপত্তিই জানিয়েছিলেন! আবার এটাও ঠিক, ভেজা মাঠে ফিল্ডিং দলের সমস্যাই বেশি হওয়ার কথা। ব্যাটসম্যানরা রান নেবেন উইকেটের ওপর দৌড়ে। বৃষ্টির সময় সেটা তো কাভারে ঢাকাই থাকে। তারপরও লিটনের সমস্যা হয়েছে হয়তো তিনি উইকেটের পাশের ঘাসের ওপর দিয়ে দৌড়েছিলেন বলেই।
কাজেই সাকিব শুরুতে আপত্তি জানিয়ে থাকলেও পরে যখন তাঁরা মাঠে নেমে যান, তখন জয় সম্ভব ধরেই নেমেছিলেন।
কিন্তু লিটনের ওই আউটের পর বাংলাদেশ দল ধীরে ধীরে ম্যাচ থেকে ছিটকে যেতে থাকে ব্যাটসম্যানদের অনাবশ্যক তাড়াহুড়ায়। পরিণতি, লিটনের আউটের পর ৪০ রানের মধ্যে পাঁচ ব্যাটসম্যান ফিরে যান ড্রেসিংরুমে। এর মধ্যে শেষ চার ব্যাটসম্যান আফিফ হোসেন, সাকিব নিজে, ইয়াসির আলী ও মোসাদ্দেক হোসেন আউট হয়েছেন মাত্র ৯ রানের মধ্যে।
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে সাকিব বেশ কয়েকবারই বলেছেন, ম্যাচটা তাঁদেরই জেতা উচিত ছিল। এমনকি ম্যাচ শেষ হওয়ার ৫ ওভার আগেও মনে হচ্ছিল এই ম্যাচ নিশ্চিত বাংলাদেশের। ৮ উইকেট হাতে, শেষ ৫ ওভারে দরকার ৫২ রান। খুব বড় দুর্ভাগ্যে না পড়লে এখান থেকে ম্যাচ হারা কঠিন। সবাইকে হতাশ করে বাংলাদেশ দল যেন সেই ‘অসাধ্য’ই সাধন করে দেখাল।
বৃষ্টিতে মাঠ ভেজা থাকলে ব্যাটসম্যানদের কী সমস্যা বা আদৌ সমস্যা হয় কি না, সেটা ক্রিকেটাররাই ভালো বলতে পারবেন। তবে বৃষ্টিবিরতির পর অঙ্কের হিসাবে খুব বেশি সমস্যা তৈরি হয়নি বাংলাদেশের জন্য। বাংলাদেশ যখন প্রথমে ভারতের ১৮৪ রান তাড়া করতে নামে, তখন ওভারপ্রতি প্রয়োজন ছিল ৯.২৫ রান করে। লিটনের ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে ৭ ওভারে বাংলাদেশ করে ফেলে ৬৬ রান।
বাকি ১৩ ওভারে ওভারপ্রতি নিতে হতো ৯.১৫ রান করে। কিন্তু এরপরই নামে বৃষ্টি, বৃষ্টির পর বাংলাদেশের নতুন লক্ষ্য ১৬ ওভারে ১৫১ রান। অর্থাৎ পরের ৯ ওভারে করতে হবে ৮৫, ওভারপ্রতি প্রয়োজন ৯.৪৪ রান করে। বৃষ্টির বাধা বাংলাদেশের কাজটা কঠিন করে তুলেছিল, এটা বলার তাহলে সুযোগ কোথায়!
ম্যাচ শেষে মিক্সড জোনে আসা সহ–অধিনায়ক নুরুল হাসান অবশ্য বৃষ্টিবাধার একটা নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলেছেন। সেটা হলো ছন্দপতন। দুই ওপেনার লিটন দাস ও নাজমুল হোসেনের ব্যাটিং একটা ভালো ধারার মধ্যে ছিল। বৃষ্টির কারণে প্রায় এক ঘণ্টা ড্রেসিংরুমে কাটিয়ে আবার মাঠে ফিরে হয়তো সেই ধারাটা তাঁরা ধরে রাখতে পারেননি।
হতেই পারে। আর সেটা হলে এই ধারা ধরে রাখতে না পারাটাই বাংলাদেশের ব্যর্থতা। লিটনের অমন রাজকীয় শুরুর পরও বাকিরা যে ব্যাটনটা নিয়ে বাকি পথটুকু পাড়ি দিতে পারলেন না, সেটি ব্যর্থতা।
বিশ্বকাপের মতো জায়গায় ভারতকে হারানোর এ রকম সুযোগ আবার কবে আসবে কে জানে! বা এলেও আবারও নিশ্চয়ই বাংলাদেশ পারবে না। ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বেঙ্গালুরুতে হারানো সুযোগের পর অ্যাডিলেডেও তো তাই করল বাংলাদেশ!
ভালো কথা, বৃষ্টির ওই ৫২ মিনিট এবং ইনিংসের মাঝে ব্যাটসম্যানদের অকারণ তাড়াহুড়ায় আউটের মিছিল একটা জিনিস ভুলিয়েই দিচ্ছে। গতকাল বাংলাদেশের বোলিংটা মনে করে দেখুন তো একবার। উইকেট না পেলেও তাসকিন আহমেদ ভালো বোলিংয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে টানা ৪ ওভারের স্পেলে দিলেন মাত্র ১৫ রান।
তরুণ হাসান মাহমুদ এদিনও নিয়েছেন ৩ উইকেট। পাওয়ার প্লেতে ভারত করল মাত্র ৩৭। কিন্তু নবম ওভারে ২৪ রান দিয়ে শরীফুল ইসলাম যেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের হাতের বাঁধনটাই খুলে দিলেন। ৪ ওভারে শেষ পর্যন্ত ৫৭ রান দিয়েছেন গতকালই এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম খেলতে নামা শরীফুল। সঙ্গে ক্যাচও পড়েছে কিছু। সবকিছুর যোগফলে ভারত করে ফেলে ১৮৪ রান, যেখানে বিশেষ দ্রষ্টব্য বলতে কে এল রাহুলের ৩২ বলে ৫০, বিরাট কোহলির ৪৪ বলে অপরাজিত ৬৪ এবং সূর্যকুমার যাদবের ১৬ বলে ৩০ রানের ঝড়।
ঝড় তো লিটনও তুলেছিলেন, কিন্তু ঝড়ের পর আসা বৃষ্টিতে লিটনের সতীর্থরা মনে মনে এতটাই ভিজে গেলেন যে বৃষ্টি থামার পরও তাঁরা আর গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারলেন না। অ্যাডিলেডের এ হার সুপার টুয়েলভে এক ম্যাচ বাকি থাকতেই বিশ্বকাপের বহির্গমন পথটা দৃশ্যমান করে তুলল বাংলাদেশের সামনে।