অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগে অনুশীলনে বাংলাদেশ দল
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগে অনুশীলনে বাংলাদেশ দল

উৎপল শুভ্রর লেখা

এমন কেন বলছেন হাথুরুসিংহে

যুক্তি বলে, হবে না। কিন্তু আবেগ কবেই–বা যুক্তি মেনে চলেছে! যা হওয়ার তা তো হবেই, আগেই কেন আশা ছেড়ে দেওয়া। বাংলাদেশ দল হয়তো এই মন্ত্রেই দীক্ষা নিয়েছে।

বিশ্বকাপ-পূর্ব পারফরম্যান্স মনে রাখলে সুপার এইটে ওঠাটাই বড় ব্যাপার। সুপার এইট মানে কমপক্ষে আরও তিনটি ম্যাচের নিশ্চয়তা। সেমিফাইনালের হাতছানিও কি নয়!
গ্রুপে প্রবল দুই প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। আফগানিস্তানও হেলাফেলার দল নয়। চাইলে তিনটি ম্যাচের মধ্যে তুলনামূলক কঠিন কোনটি, এই আলোচনা হতে পারে। তবে সহজ কি বলা যায় কোনোটিকেই!

আফগানিস্তানকে একটু ‘কম কঠিন’ বলতে পারেন। অস্ট্রেলিয়া-ভারতের তুলনায় তো অবশ্যই। কিন্তু আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলাটা পড়েছে আবার সেন্ট ভিনসেন্টে। আর্নস ভেলের ওই উইকেটে অস্ট্রেলিয়াকে পেলে ভালো হতো। স্পিন শক্তিতে বলীয়ান আফগানিস্তানকে যেখানে অবশ্যই চায়নি বাংলাদেশ। স্পিন শক্তিতে বলীয়ান বলছি জানলে ফজলহক ফারুকি অবশ্য মাইন্ড করতেই পারেন। ৪ ম্যাচে বাঁহাতি পেসারের ১৫ উইকেট। এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

তিনটি ম্যাচই কঠিন। তা সুপার এইটে তো এমনই হওয়ার কথা। ২০ দল থেকে সেরা আটটি এসেছে এখানে। কোনো ম্যাচই সহজ হওয়ার কথা নয়। সুপার এইটের অন্য গ্রুপে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলবেন তো? বললে বুঝতে হবে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচটা আপনি দেখেননি। মোনাঙ্ক প্যাটেলের দল সুপার এইটের প্রথম ম্যাচেই বুঝিয়ে দিয়েছে, তাদের এত দূর আসাটা কোনো ফ্লুক নয়।

কোচ হাথুরুসিংহের সঙ্গে কী নিয়ে আলোচনা করছিলেন নাজমুল, তা অনুমান করাই যায়। হয়তো নিজের ব্যাটিং নিয়েই

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন সংবাদ সম্মেলনে আসেননি। ব্যাটে রানখরা কাটাতে সময়টা অনুশীলনে ব্যয় করাটাকেই তাঁর কাছে বেশি জরুরি বলে মনে হয়েছে। এলে কী বলতেন, তা অনুমান করা কঠিন নয়। অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের কথা উঠলেই এই যে বড় দল-বড় দল বলা হচ্ছে, এটা মানতেই চাইতেন না। সুপার এইটে ওঠার পরই তো বলে দিয়েছেন, ‘টি-টোয়েন্টিতে বড় দল-ছোট দল বলে কিছু নেই।’

তার মানে তো যেকোনো কিছুই সম্ভব। বাংলাদেশ দলে যে এই ভাবনার স্রোত বয়ে চলেছে, তা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। যাঁর ‘শাসনামলে’ই বাংলাদেশ একটি আইসিসি টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল খেলেছে, সেই চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও নিশ্চয়ই খেলোয়াড়দের সেমিফাইনালের কথা বলে উদ্দীপ্ত করছেন। অনুমানটা একেবারেই ভুল। নাজমুলের বদলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে আসা বাংলাদেশের প্রধান কোচ বরং একবারের জন্যও সেমিফাইনাল শব্দটা উচ্চারণ করলেন না।

সেমিফাইনালের কথা বললে অস্ট্রেলিয়া-ভারত কত কঠিন, নিশ্চয়ই এই লাইনে প্রশ্ন হতো। সেই আলোচনা শুরুই হতে পারল না, কারণ হাথুরুসিংহে তৃপ্ত মুখে যা বলছেন, তা অনেকটা এমন—বাংলাদেশ সুপার এইটের লক্ষ্য নিয়ে এই বিশ্বকাপে এসেছিল। সেই লক্ষ্য পূরণ হয়ে গেছে। বাকি যা পাওয়া যাবে, সেটি বোনাস। না পেলেও ক্ষতি নেই।

এ কেমন কথা, হবে কি হবে না, সেটা পরের ব্যাপার। স্বপ্ন দেখতে দোষ কী! অ্যান্টিগার কুলিস ক্রিকেট মাঠে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ–পূর্ব সংবাদ সম্মেলনটা হলো বড় অদ্ভুত। চেয়ার-টেবিল কিছু নেই। সামনে টেলিভিশন ক্যামেরা। বাংলাদেশের ১২–১৩ জন সাংবাদিক, অস্ট্রেলিয়ার জনা চারেক। হাথুরুসিংহের পর অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মিচেল মার্শও মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বললেন।

যা বলার কথা, তা-ই বললেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মিচেল মার্শ

মার্শের যা বলার কথা, তা-ই বললেন। বাংলাদেশ ভালো দল, যাদের প্রতি তাঁর অনেক রেসপেক্ট আছে। এই দুই দলের সর্বশেষ ম্যাচে ১৭৭ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার এক সাংবাদিক তা মনে করিয়ে দেওয়ায় বললেন, ‘ওটা ভিন্ন ফরম্যাট, ভিন্ন উইকেট, ভিন্ন দেশ। তবে এটা তো আমার সুখস্মৃতিই।’

গত বছর ভারতে ওয়ানডে বিশ্বকাপে পুনেতে মার্শের ওই ১৭৭। যা নিয়ে তাঁর এমনই বলার কথা। কিন্তু চন্ডিকা হাথুরুসিংহের কথাবার্তা তো সব পূর্বানুমানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল। কেন সুপার এইটে উঠেই তিনি ‘সব পেয়ে গেছি’ তৃপ্তির ঢেকুর তুলবেন?

ভেবে ভেবে একটাই কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। মনের মধ্যে অবশ্যই সেমিফাইনাল আছে। তবে সেমিফাইনাল-সেমিফাইনাল রব তুলে চাপটা বাড়িয়ে তুলতে চাইছেন না। ভেবেচিন্তেই হয়তো ঠিক করেছেন, একটু অন্যভাবে ‘খেললে’ কেমন হয়! সুপার এইটে ওঠার আনন্দ নিয়ে ক্রিকেটাররা মাঠে নামুক। খেলুক মনের আনন্দে, উপভোগ করুক খেলাটা। আর কে না জানে, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে বেশি না ভাবলেই বরং কখনো কখনো বেশি পাওয়া যায়।

এখানেই মিলে যাচ্ছেন ডেভ হোয়াটমোর ও চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। ১৭ বছর আগে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজেই আরেকটি বিশ্বকাপের সুপার এইটে ওঠার পর বাংলাদেশের কোচ তো এমনই বলেছিলেন, সুপার এইটে উঠেছ, মাঠে যাও, প্রাণভরে উপভোগ করো।

তার মানে এই নয় যে, এই ম্যাচের আগে অস্ট্রেলিয়া দলের শক্তি-দুর্বলতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়নি। ঠিক করা হয়নি রণকৌশল। এই কাজটা হাথুরুসিংহের জন্য খুব একটা কঠিন হয়নি। নিউ সাউথ ওয়েলসের সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করার সময় এই অস্ট্রেলিয়া দলের অনেককেই পেয়েছেন। তাঁদের নাড়িনক্ষত্রও তাঁর জানা। তাতে বিরাট কিছু হয়ে যাবে, এটা অবশ্য তিনি নিজেও ভাবছেন না, ‘ওরা সবাই দারুণ ক্রিকেটার। যাঁর যাঁর খেলা নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসীও।’

চন্ডিকা হাথুরুসিংহে কি ভেবেচিন্তেই অমন বলছেন?

হাথুরুসিংহের কথার মানে এ-ও নয় যে উপভোগ করতে মাঠে নেমে ক্রিকেটাররা যা ইচ্ছা তা-ই করবেন। খেলতে খেলতে পেশাদার ক্রিকেটারদের একসময় ভুলে যাওয়ার উপক্রম হয়, ছোটবেলায় কেন খেলতে শুরু করেছিলেন। সেটি তো আনন্দের জন্য, উপভোগ করার জন্য। হাথুরুসিংহে সেটাই মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেশের হয়ে খেলা হোক, বা ক্লাবের জন্য বা পার্কে–উপভোগ করাটা সব সময়ই আমাদের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকে। তবে এর মানে এই না যে ক্রিকেটারদের ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেকের নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে দলে, সেটি তাদের পালন করতেই হবে।’

বোঝাই যাচ্ছে, আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই বলাটা আসলে হাথুরুসিংহের একটা কৌশল। ক্রিকেটারদের নির্ভার রাখার আরকি!