তিন দিন পরই বয়স ৩২ পূর্ণ হবে তাঁর, পা রাখবেন ৩৩-এর ঘরে। পেসারদের জন্য এই বয়সকে ধরা হয় শেষবেলা। বলে গতি কমে, ধার কমে, সেই সঙ্গে কমে শরীরের তেজ আর মনের জোরও। আর এমন পড়ন্তবেলাতেই কিনা পাকিস্তান জাতীয় দলে নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে মোহাম্মদ আমিরের।
১৮ এপ্রিল শুরু হচ্ছে পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। এই সিরিজে ‘ম্যাচ জেতানো খেলোয়াড়’ আমিরের ওপর আস্থা রেখে তাঁকে দলে রেখেছেন পাকিস্তানের নির্বাচকেরা। দূরদৃষ্টিতে আছে জুনের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, নির্বাচকেরা জানিয়ে রেখেছেন এমনটাও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া আমিরের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় অবশ্য একটাই বাক্য, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’, যার অর্থ—‘পরম করুণময় স্রষ্টার নামে শুরু করছি’।
আমিরের এই শুরু আসলে ঠিক শুরু নয়, তৃতীয় অধ্যায়ের সূচনা।
প্রথম অধ্যায়ের শুরুটা সবারই জানা, ২০০৯ সালে ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখার মাধ্যমে। দ্বিতীয় পর্ব অবশ্য প্রথম পর্বের চেয়েও আলোচিত, আলোড়িত। মাত্র ১৭ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে হইচই ফেলে দেওয়া আমির এক বছরের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলেন স্পট ফিক্সিংয়ে, যার শাস্তি হিসেবে কারাগারে গেছেন, পাঁচ বছর ছিলেন নিষিদ্ধও। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অকল্যান্ডে আমিরের ফেরাটা তাই বেশ আলোচনারই জন্ম দিয়েছিল। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি দিয়ে রাঙিয়ে তোলা পর্বটির ইতি ঘটে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে, অবসর ঘোষণার মাধ্যমে।
যেভাবে সামনে এগিয়ে চলার পথটা নিজেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তাতে অনেকেই ২৯ বছরে বয়সে আমিরের ক্যারিয়ারে ফুলস্টপ দেখে ফেলেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিতে গিয়ে তৎকালীন বোর্ড ও টিম কোচিং স্টাফের সদস্যদের দিকে আঙুল তুলে গিয়েছিলেন আমির। বলেছিলেন, ‘মানসিক অত্যাচার’ই সরে যাওয়ার কারণ, ‘ক্রিকেট ছাড়ছি, কারণ মানসিকভাবে অত্যাচারিত হয়েছি। আমার মনে হয় না এসব সহ্য করে যেতে পারব। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি। শাস্তিও পেয়েছি। পিসিবি আমার জন্য অনেক বিনিয়োগ করেছে—এসব বলে অত্যাচার করা হয়েছে আমার ওপর।’
আমিরের অভিযোগের আঙুল ছিল পিসিবি চেয়ারম্যান রমিজ রাজা, কোচিং স্টাফে থাকা ওয়াকার ইউনিস ও মিসবাহ-উল-হকদের দিকে। তাঁরা সরে গেলেই কেবল জাতীয় দলে ফেরার কথা বিবেচনা করবেন বলে জানিয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ মহলে।
এক এক করে পরে তাঁদের সবাই পিসিবি ছেড়েছেন বা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু আমির আর ফেরেননি। স্রেফ ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টিই খেলে গেছেন। এর মধ্যে পাকিস্তান দলেও আবির্ভাব হয় হারিস রউফ, নাসিম শাহদের মতো নতুন পেসারদের। সর্বশেষ গত নভেম্বরে পাকিস্তানের নতুন টিম ডিরেক্টর মোহাম্মদ হাফিজ জানান, দায়িত্ব নিয়েই আমিরের সঙ্গে তাঁর ফেরার বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। কিন্তু আমির হাফিজকে জানিয়েছেন, তাঁর জীবনের গুরুত্ব পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন আর পাকিস্তান নিয়ে ভাবছেন না।
আমিরের ভাবনা কোন দিকে গড়াচ্ছে, সেটির আভাস গত বছরের মাঝামাঝিতেই পাওয়া গেছে। ২০১০ সালে লর্ডসে স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে আমির যখন কারাগারে, তখন আইনজীবী হিসেবে নারজিস খানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তাঁর। পরে এই নারজিসকেই তিনি বিয়ে করেন, যিনি যুক্তরাজ্যেই থাকেন। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলার পর যুক্তরাজ্যে থিতু হয়ে যান আমির। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে দ্য টেলিগ্রাফ জানায়, যুক্তরাজ্যে টানা থাকার সুবাদে পরের বছরই স্থানীয় খেলোয়াড় হয়ে যাবেন আমির, আর স্থানীয় হিসেবেই পরবর্তী মৌসুমে ডার্বিশায়ারে যোগ দেবেন।
আমির তখন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেও এটি স্পষ্ট করেন যে ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়ে ২০২৪ সাল থেকে ভারতের আইপিএলে খেলার কথা ভাববেন।
এরপর আট মাস পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে পাকিস্তান জাতীয় দলের পারফরম্যান্স ও অধিনায়ক বাবর আজমকে নিয়ে আমির যে ভাষায় প্রতিনিয়ত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে গেছেন, তাতে পাকিস্তান দলে তাঁর ফেরার সম্ভাবনা ‘ভ্যানিশ’ই মনে করা হচ্ছিল। গত নভেম্বরেই যেমন কোনো রাখঢাক না করেই বলেছেন, পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি দলে বাবরের জায়গা দেখেন না তিনি। বিশ্বকাপ ব্যর্থতার জন্যও দায় দেন বাবরকে।
ছয় মাসও পার হয়নি, সেই বাবরের নেতৃত্বাধীন দলের হয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরছেন আমির। এর মধ্যে খুব যে হইচই ফেলে দেওয়া বোলিং করেছেন, তা নয়। সর্বশেষ পিএসএলে উইকেটশিকারিদের তালিকায় আমিরের নাম ১৪ নম্বরে। কোয়েটা গ্লাডিয়েটরসের হয়ে ৯ ম্যাচে নিয়েছেন ১০ উইকেট, ওভারপ্রতি খরচ ৮.৪১ রান করে। তবু আমির আলোচনায় থেকেছেন ছোট ছোট ঝলকানির কারণে। প্রথম এলিমিনেটরে ইসলামাবাদ ইউনাইটেডের বিপক্ষে আমিরের প্রথম ওভারটি দেখে যেমন রীতিমতো মুগ্ধ ছিলেন ওয়াকার ও রমিজ। ধারাভাষ্যকক্ষে থাকা ওয়াকার তো শাহিন আফ্রিদিকে ওভারটি দেখে শিখতেও বলেছিলেন।
নাম দুটো নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন—ওয়াকার ও রমিজ, যে দুজনের ওপর সবচেয়ে বেশি খ্যাপা ছিলেন আমির! আমিরকে এবার জাতীয় দলে ফেরানোও হয়েছে তাঁর ম্যাচে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া পারফরম্যান্সের সামর্থ্যের কারণে। দল ঘোষণার সময় আমিরের নাম নেওয়ার নির্বাচক ওয়াহাব রিয়াজের কথায়ও যেটা উঠে এসেছে।
সংবাদ সম্মেলনে ওয়াহাবকে কথা বলতে হয়েছে আমিরের আরও একটি বিষয় নিয়ে। গত সপ্তাহেই আমিরের জাতীয় দলে ফেরার সম্ভাবনা আছে জেনে রমিজ রাজা বলেছিলেন, ‘ওর মতো ফিক্সারকে আমি পাকিস্তান দলে চাই না। আমার ছেলে হলেও এ ধরনের অপরাধের ক্ষমা নেই।’ সাবেক পিসিবি চেয়ারম্যান ও অধিনায়কের কথাকে ‘রূঢ় ও নেতিবাচক’ উল্লেখ করলেও সবারই কথা বলার স্বাধীনতা আছে বলে মন্তব্য করেছেন ওয়াহাব।
বহু বর্ণিল পাকিস্তান ক্রিকেটের মূল বৈশিষ্ট্যই যেন ফুটে উঠল এ কথায়, এমনকি আমিরের পুরো প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়াতেই। বোলার আমিরে মুগ্ধ রমিজ তাঁকেই ফিক্সিংয়ের কারণে জাতীয় দলে চান না, যাঁকে দোষারোপ করে আমির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়েছেন, সেই ওয়াকার তাঁকে অন্যদের জন্য আদর্শ বানিয়ে দেন। আর স্বয়ং আমির...? যাঁকে টি-টোয়েন্টি দলে দেখেন না, সেই বাবরের অধীনই ফিরছেন জাতীয় দলে। তা–ও মনোযোগ অন্য কিছুতে বলার মাস ছয়েক পরেই!