বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে লিটনের সঙ্গে কোহলির করমর্দন
বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে লিটনের সঙ্গে কোহলির করমর্দন

বাংলাদেশের বিপক্ষে কোহলির শতক নিয়ে পূজারার যুক্তি ‘আগে দলের কথা মাথায় রাখা উচিত’

পুনেতে পরশু বাংলাদেশকে একরকম উড়িয়ে দিয়েছে ভারত। তবু ম্যাচের শেষটা বেশ জমে উঠেছিল। ক্ষণিকের জন্য দর্শকেরাও রোমাঞ্চিত হয়ে পড়েছিলেন। শেষ দিকে ম্যাচটা যে হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের সঙ্গে বিরাট কোহলির একার লড়াই!

নাসুম আহমেদ–হাসান মাহমুদরা কোহলিকে শতকবঞ্চিত করতে পারেন কি না, এ নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ উঠেছিল তুঙ্গে। শেষ পর্যন্ত নাসুমের বলে ছক্কা মেরে শতক পূরণ করেছেন কোহলি; যা তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৪৮তম। ওয়ানডেতে আর একটি শতক পেলেই শচীন টেন্ডুলকারকে ছুঁয়ে ফেলবেন কোহলি।

ম্যাচের একপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছিল যে ভারতের জিততে দরকার ২৬ রান; কোহলিরও শতক পেতে চাই ২৬! মাইলফলক ছুঁতে পরের সবকটি বল নিজেই খেলার সিদ্ধান্ত নেন। এই ২৬ রান তুলতে তাঁর লেগেছে ১৯ বল। বলা যায়, আরেক প্রান্তের সঙ্গী লোকেশ রাহুলকে স্ট্রাইক না দিলেও রানের চাকা সচল রেখেই শতক পূর্ণ করেছেন।

তবু কোহলির ওই শতকে ‘ব্যক্তিস্বার্থ’ দেখছেন চেতেশ্বর পূজারা। টেস্ট বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত পূজারা মনে করেন, কোহলির শতক পূরণের জন্য ভারতের রানের গতি কমে গিয়েছে। ক্রিকইনফোকে পূজারা বলেছেন, ‘বিরাট কোহলির শতকের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো খেলা যত দ্রুত শেষ করে আসা যায়। শীর্ষে উঠতে হলে নেট রান রেট বাড়াতে হবে। যখন আপনি নেট রান রেটের কথা চিন্তা করবেন, তখন অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই।’

পূজারার (ডানে) কথায় মনে হয়েছে, দলের নয়; কোহলি নিজের জন্য খেলেছেন

পূজারার আরেকটি কথায় বোঝা গেছে দলের জন্য নয়, নিজের জন্য খেলেছেন কোহলি, ‘আগে দলের কথা মাথায় রাখা উচিত। আমি এটাই মনে করি। আপনি নিজের মাইলফলক গড়তেই পারেন। কিন্তু দলের মূল্য চোকানোর বিনিময়ে নয়। আপনাকে একটু ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। খেলোয়াড় হিসেবে আপনার কাছে সব সময় একটা বিকল্প থাকে। তবে কিছু কিছু খেলোয়াড় মনে করেন এই ম্যাচের শতক তাঁকে পরের ম্যাচে সাহায্য করবে। এটা নির্ভর করে আপনার মানসিকতা কী রকম, তার ওপর।’

বাংলাদেশের বিপক্ষে কোহলি দলের চেয়ে নিজের মাইলফলক নিয়ে ভেবেছেন—পূজারার এমন প্রচ্ছন্ন অভিযোগের পর বিতর্ক বেশ ভালোভাবেই জেঁকে বসেছে। পরশু যাঁরা কোহলির শতক দেখার পর তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো এখন ভাবছেন কোহলি কি তাহলে সত্যিই বল নষ্ট করেছেন?

কোহলি যেখানে ২৮৫টি ওয়ানতে খেলে ফেলেছেন, সেখানে পূজারা এক যুগের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ভারতে ওয়ানডে দলের একাদশে ছিলেন মাত্র ৫ বার। সেই ৫ ইনিংস মিলিয়ে তাঁর রান মাত্র ৫১; গড় মাত্র ১০.২০। ওয়ানডের স্ট্রাইক রেট তাঁর টেস্ট স্ট্রাইক রেটের চেয়েও কম—৩৯.২৩! পূজারা ‘টেস্ট বিশেষজ্ঞ’ হলেও ওয়ানডেতে তাঁর সামর্থ্যটা এই পরিসংখ্যানেই পরিষ্কার। কিন্তু প্রশ্ন তাঁর সামর্থ্য নিয়ে নয়, প্রশ্ন উঠেছে পূজারা যে বিতর্কটা তুলেছেন, সেটা নিয়ে।

২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনাল স্মরণ করতে পারেন। মহেন্দ্র সিং ধোনির অপরাজিত ৯১ রানের ইনিংসটাই সবাই মনে রেখেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করলে গৌতম গম্ভীরের ৯৭ রানের ইনিংসটা তো ধোনির চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে হওয়ার কথা। কিন্তু সেদিন সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গম্ভীর শতক পূরণ করতে পারেননি আর ধোনির শতক পূরণের কোনো সুযোগই ছিল না। দিন শেষে তাই ধোনিই নায়ক।

২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালে গৌতম গম্ভীরের ৯৭ রানের ইনিংসটি সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না

কিন্তু পরশু কোহলির সামনে যখন শতক পূরণের সুযোগ ছিল, তাহলে তিনি ছাড়বেন কেন? শতকের জন্য না খেলে ৯০ রানে অপরাজিত থাকলেই কি ভারত আরও বেশি বল বাকি রেখে জিতত? সেটা কি আদৌ সেমিফাইনালে তোলার পথে ভারতকে অতিরিক্ত কোনো সাহায্য করত? উত্তর—অবশ্যই না।

কারণ, নিউজিল্যান্ডের (‍+১.৯২৩) চেয়ে কিঞ্চিৎ পিছিয়ে থাকলেও ভারতের (‍+১.৬৫৯) নেট রান রেট যথেষ্ট ভালো, তা ছাড়া তালিকার শীর্ষে থেকে সেমিতে ওঠার ক্ষেত্রে নেট রান রেটের চেয়ে বেশি ম্যাচ জেতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর স্ট্রাইক রেটের প্রসঙ্গ যদি তোলা হয়, তাহলে কোহলি ও তাঁর সঙ্গী রাহুল বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রায় একই স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করে যাচ্ছিলেন।

রাহুল নিজেও তো চেয়েছিলেন কোহলি শতক করুক। প্রতিপক্ষ যথেষ্ট রান করায় শতকবঞ্চিত হওয়ার সর্বশেষ শিকার তো রাহুল নিজেই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপেই ৯৭ রানে অপরাজিত থাকতে হয়েছে তাঁকে। কোহলির মতো হিসাব কষে খেললে শতক পেয়ে যেতে পারতেন তিনিও। কিন্তু দিন দশেক আগে নিজে যা পারেননি, সতীর্থ কোহলিকে সেটাই করানোর সুযোগ দিয়েছিলেন রাহুল। এমন উদারতা দেখাতে পারেন কজন?

সেঞ্চুরি পেতে কোহলিকে সহায়তা করেছেন রাহুল

ভারতকে জেতানোর পাশাপাশি শতকও করতে হবে—এমনটা কিন্তু কোহলির পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। হাসান মাহমুদের বলে ছক্কা মেরে যখন ৮০ তে পৌঁছালেন, তখন ভারত জয় থেকে ২০ রান দূরে। শতক পূরণ করতে কোহলিরও তখন দরকার ২০! এরপর নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া সেরেছেন কোহলি–রাহুল। শেষ ১৯ বল নিজেই খেলেন। এ সময়ে তিনবার সিঙ্গেল নেওয়ার সুযোগ থাকলেও নেননি। ওই ৩ রান না নেওয়ায় কী এমন ক্ষতি হয়েছে ভারতের, পাল্টা প্রশ্ন পূজরাকে করাই যায়।

এই প্রশ্নের পিঠে আরেকটা প্রশ্ন করা যায়। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৭০তম থেকে ৭১তম শতকে পৌঁছাতে কোহলির লেগেছিল ১০২০ দিন। ২০১৯–এর পর শতক পেয়েছেন ২০২২ সালে। এ সময়ে তিনি ১২ বার ৭০ রানের বেশি করেছেন, ৬ বার করেছেন ৮০ রানের বেশি। তবু সবার মন খুঁতখুঁত করত, শতক পাচ্ছে না কোহলি কিংবা শতক করতে ভুলে গেছেন কোহলি। আসলে সবাই কোহলিকে নিয়মিত তিন অঙ্ক ছুঁতে দেখে অভ্যস্ত। দীর্ঘদিন সেটা না হওয়াতে ৭০–৮০ রানের ইনিংসগুলোর পরও মনে হয়েছে কোহলি ফর্মে নেই!

কোহলির কাছে সমর্থকদের চাওয়া ও প্রত্যাশা এমনই। কোহলিও সেটা ভালো করেই জানেন। তাই এবার যখন শতকের সুযোগ এসেছে, সেটা লোকেশ রাহুলের পরামর্শে তিনি হাতছাড়া হতে দেননি। হিসাব কষে খেলেও যে মাইলফলক ছোঁয়া যায়, এই শতকে সেটাও দেখিয়েছেন রানতাড়ার ‘মাস্টার’।

বাংলাদেশের বিপক্ষে শতক পূরণের পর বিরাট কোহলি

কোহলির পাশে আছেন ওয়াসিম আকরামের মতো কিংবদন্তি। ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক হয়েও কোহলিকে বলেছেন ‘ভিনগ্রহে’র খেলোয়াড়। দল নয়, নিজের জন্য খেলেছেন—এমন অভিযোগও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন আকরাম। বলেছেন, ‘ভারত এমনিতেও হেসেখেলে জিতত। শতক যখন হবারই ছিল, তাহলে হতে দাও।’

কোহলি হতে দিয়েছেন। সামনে যে আরও হবে, সেটা না বললেও চলছে।