যে উইকেটে স্বীকৃত ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ, নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নেমে সে উইকেটেই সর্বোচ্চ ৪৭ রানের ইনিংস খেলেছেন তাইজুল ইসলাম
যে উইকেটে স্বীকৃত ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ, নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নেমে সে উইকেটেই সর্বোচ্চ ৪৭ রানের ইনিংস খেলেছেন তাইজুল ইসলাম

তাইজুল-বীরত্বেই মূর্ত বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা

সিলেট টেস্ট: দ্বিতীয় দিন শেষেশ্রীলঙ্কা: ২৮০ ও ১১৯/৫বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ১৮৮

নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নেমে ইনিংসের সর্বোচ্চ স্কোরার হয়ে যাওয়া টেস্ট ক্রিকেটে এটাই প্রথম নয়। সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণটা তো বাংলাদেশের বিপক্ষেই। ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই চট্টগ্রাম টেস্ট। নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নেমে জেসন গিলেস্পির অপরাজিত ২০১ রান অবশ্য চাপা পড়ে যায় একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়।

ওই টেস্টের কথা বললে বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিকের প্রথমে গিলেস্পির কথা মনে পড়ে না, মনে পড়ে পুলিশের হাতে নির্বিচার মার খাওয়ার দুঃস্মৃতি। গিলেস্পির ওই কীর্তির কোনো বর্ণনাও আপনি বাংলাদেশের পুরোনো পত্রিকায় খুঁজে পাবেন না। কারণ, প্রথম দিন দুপুরে অভূতপূর্ব ওই ঘটনার পর সেই টেস্ট ম্যাচ বর্জন করেছিল বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম। ছাপা হয়েছে শুধু স্কোরকার্ড। ঘটনাচক্রে ওটাই গিলেস্পির শেষ টেস্ট ম্যাচ। মজা করে বলা হয়, বোলার থেকে ব্যাটসম্যান হয়ে যাওয়ার ‘অপরাধেই’ তাঁকে আর বিবেচনা করেননি অস্ট্রেলিয়ান নির্বাচকেরা।

প্রায় দেড় যুগ আগে নাইটওয়াচম্যান গিলেস্পির ওই ব্যাটিং-কীর্তিতে ফিরে যাওয়ার কারণটা আপনার অনুমান করে ফেলার কথা। যদিও তাইজুল ইসলামের সঙ্গে এটি মেলানো একটু কেমন কেমন লাগে। কোথায় গিলেস্পির অপরাজিত ২০১, আর কোথায় তাইজুলের ৪৭!

দ্বিতীয় দিনে ব্যাটিং–ব্যর্থতার শুরুটা মাহমুদুল হাসানের আউট দিয়ে

আবার অন্য দিক থেকে দেখুন। গিলেস্পি অমন ‌ব্যাটসম্যান হয়ে না গেলেও অস্ট্রেলিয়ার কিছু আসত যেত না। অন্য কেউ না কেউ ঠিকই রান করতেন। ওই ইনিংসেই তো মাইক হাসির ১৮২ ছিল। যেখানে সিলেট টেস্টে তাইজুল যদি ক্যারিয়ার-সর্বোচ্চ ৪৭ রান না করতেন, তাহলে ভেবে দেখুন, বাংলাদেশের অবস্থা আরও কত করুণ হতো! ইনিংসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তো মাত্র ২৫।

তা একজন ব্যাটসম্যানই (পড়ুন লিটন দাস) করেছেন। কিন্তু শুধু তাইজুলই একমাত্র ব্যতিক্রম হলে কথা ছিল। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে তৃতীয় ও পঞ্চম সর্বোচ্চ স্কোরারের মূল পরিচয়ও বোলার। ইনিংসের শেষ দিকে ছয়-টয় মেরে যা করেছেন দুই পেসার খালেদ (২২) ও শরীফুল (১৫)।

প্রেসবক্সে এক সাংবাদিক হিসাব করে বের করলেন, বাংলাদেশের পাঁচ বোলারের মোট রানের চেয়ে ছয় বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানের রান ২১ কম। বোলাররা যেখানে ৯৫ রান করেছেন, ব্যাটসম্যানরা ৭৪। টেস্ট-ওয়ানডে দুটিতেই সেঞ্চুরি আছে বলে মেহেদী হাসান মিরাজকে অলরাউন্ডার না বলাটা মনে হয় অন্যায়ই হয়। সেই বিবেচনায় মিরাজকে যদি আলাদা রাখতে চান, তাহলেও মোট রানে বোলারদের চেয়ে পিছিয়ে থাকেন ব্যাটসম্যানরা। তা এসব এমন বিস্তারিত কেন বলছি? কারণ, বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের দুরবস্থা বোঝাতে তাহলে আর বেশি কিছু বলতে হয় না।

গতকাল প্রথম দিনের শেষ বেলাতেই বাংলাদেশের ইনিংসের মাথাটা ভেঙে গেছে। তিন ব্যাটসম্যান সেদিনই আউট, আজ দ্বিতীয় দিনের প্রথম সেশনেই বাকি তিনজন। পার্থক্য বলতে কাল জাকির, নাজমুল আর মুমিনুল বলতে গেলে এসেছেন আর গেছেন। আজ মাহমুদুল, শাহাদাত ও লিটন তিনজনকেই যেখানে মোটামুটি সেট বলে মনে হচ্ছিল।

আউট হওয়ার আগপর্যন্ত ভালোই খেলছিলেন লিটন দাস

শুধু রানের জন্য নয়, সবচেয়ে ভালো লাগছিল লিটনকে। ঠিক লিটনের মতোই ছন্দময়। লাহিরু কুমারার যে বলটাতে বোল্ড হয়েছেন, তা অবশ্যই ‘ভালো বল’-এর স্বীকৃতি পাবে। তবে সেটি ‘খেলাই যায় না’ গোত্রভুক্ত হওয়ার মতো নয়। পা নড়লেই হয়তো সর্বনাশটা এড়ানো যেত। লিটন অবশ্য বলতেই পারেন, শচীন টেন্ডুলকারকেও এমন কত বোল্ড হতে দেখেছি! কথাটা মিথ্যাও নয়। শচীনকে আউট করার রেসিপি হিসেবে ঠিক এমন বলই করতে বলা হতো পেসারদের।

সেদিক থেকে লিটনের আউটটা হয়তো ব্যতিক্রমী কিছু নয়। তবে সিলেটের এই টেস্টে বাংলাদেশের মাটিতে ব্যতিক্রমী অনেক কিছুই হচ্ছে। একটা তো টেস্ট শুরুর আগেই। ২০০৬ সালের পর এই প্রথমবারের মতো সাকিব, তামিম ও মুশফিক তিনজনকে ছাড়াই দেশের মাটিতে বাংলাদেশের টেস্ট খেলতে নামা।

বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের ১০ উইকেটই শ্রীলঙ্কার পেসাররা নেওয়ার পর আবার ফিরে যেতে হলো অতীতে। বাংলাদেশের মাটিতে টেস্টে পেসারদের এমন দাপটের সর্বশেষ উদাহরণ খুঁজতে গিয়ে তা পাওয়া গেল সেই ২০০৮ সালে। যখন মিরপুর টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের ১০ উইকেটই নিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার পেসাররা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে স্টেইন, এনটিনি ও ক্যালিস।

নবম উইকেটে ৪০ রান যোগ করেছেন শরীফুল–খালেদ

১৪৭ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে ফেলার পর খালেদ-শরীফুলের কল্যাণে প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কার অগ্রগামিতাকে তিন অঙ্কের নিচে রাখা গেছে। প্রথম ইনিংসে ৯২ রানের পার্থক্য তারপরও অনেক। এই টেস্টে যেভাবে হুড়মুড় করে উইকেট পড়ছে, তাতে আরও বেশি। প্রথম দিন ১৩ উইকেট পড়েছিল, দ্বিতীয় দিন পড়ল ১২টি। টানা তৃতীয় দিন এই ধারা অব্যাহত থাকলে এই টেস্ট ম্যাচ স্বল্পায়ু হতে বাধ্য। বৃষ্টি তা বাড়িয়ে দিলে অবশ্য ভিন্ন কথা। পূর্বাভাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে আজ সারা দিন নির্বিঘ্নে খেলা হলেও রাত আটটার দিকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে।

এক কথায় ম্যাচের অবস্থা বোঝাতে হলে তা খুব সহজ। শ্রীলঙ্কাই একটু এগিয়ে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেটে ১১৯ রানে এরই মধ্যে লিড ২১১। উইকেটে বর্তমান অধিনায়ক ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা। প্রথম ইনিংসের আরেক সেঞ্চুরিয়ান কামিন্দু মেন্ডিস এখনো নামেনইনি। বাংলাদেশ ২৫০-এর বেশি তাড়া করতে চাইছে না। শ্রীলঙ্কা চাইছে, বাংলাদেশের লক্ষ্যটা যেন অন্তত ৩০০ হয়।

তৃতীয় দিনে ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় বাংলাদেশ

৩০০-এর তুলনায় ২৫০ সহজ, এটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং-ব্যর্থতার স্মৃতি এখনো এমনই সতেজ যে সেটিকেও খুব সহজ বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ দল শুধু ভালোটাই ভাবতে পারে। টানা দুই ইনিংসে ব্যাটসম্যানরা সবাই অমন বিবর্ণ হয়ে থাকবেন, এটা হয় নাকি!