দুটি ঘটনাই গত শনিবারের। অ্যান্টিগা টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাহমুদুল হাসান যখন স্লিপে ক্যাচ দিয়ে মাত্র ৫ রান করে আউট হন, বাংলাদেশে তখন ভোররাত।
অ্যান্টিগা থেকে ১৮ হাজার ৩৩৩ কিলোমিটার দূরের শহর অস্ট্রেলিয়ার পার্থে সেদিন সকাল–সকাল সেঞ্চুরি পেয়ে যান যশস্বী জয়সোয়াল। সেঞ্চুরির পরপরই আত্মতৃপ্তিতে ভোগেননি। ১৬১ রানের ঝলমলে ইনিংস উপহার দিয়ে তবেই থেমেছেন। ভারতও ততক্ষণে পার্থ টেস্টে চালকের আসনে।
গতকাল দুপুরে তো পার্থ টেস্ট জিতেই নিয়েছে ভারত। আর অ্যান্টিগা টেস্টে বাংলাদেশ টেনেটুনে ফলো–অন এড়ালেও আরেকটি পরাজয়ের শঙ্কায়। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের চেয়ে ভারত কতটা এগিয়ে, সেটার ‘হালনাগাদ সংস্করণ’ গত সেপ্টেম্বর–অক্টোবরেই দেখে ফেলেছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। তবু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবধান যদি আরেক দফা দেখানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে অ্যান্টিগা ও পার্থে মাহমুদুল ও জয়সোয়ালের পারফরম্যান্সের ফারাকই কি যথেষ্ট নয়?
বাংলাদেশ ও ভারতের এত ক্রিকেটার থাকতে মাহমুদুল ও জয়সোয়ালকে নিয়ে আলোচনার কারণ দুজনই টেস্ট ওপেনার। এর চেয়েও বড় কারণ ২০২০ অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ, বিশ্ব ক্রিকেট যাঁদের প্রথম চিনেছে চার বছর আগের সেই টুর্নামেন্ট দিয়ে। আসরের ফলও সবার জানা। পচেফস্ট্রুমের ফাইনালে ডিএলএস পদ্ধতিতে ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ, যা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসেই সবচেয়ে বড় দলীয় সাফল্য।
এরপর মাহমুদুলদের বিশ্বজয়ী দলকে নিয়ে কত স্বপ্ন, কত প্রতিশ্রুতি...। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়েছে সামান্যই। বিসিবিও যেমন সেই দলটার সম্ভাব্য সেরা পরিচর্যা করতে ব্যর্থ, মাহমুদুলরাও ব্যর্থ সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিতে। অথচ চার বছর আগের সেই ফাইনালে হারের বেদনা নিয়ে মাঠ ছাড়া জয়সোয়াল আজ বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম বড় তারকা হওয়ার পথে!
জয়সোয়ালরা ভুল থেকে তৎক্ষণাৎ শিক্ষা নেন। আর মাহমুদুলরা দিনের পর দিন একই ভুল করে যান। কিন্তু তাঁদের শিক্ষা সফর কখনোই শেষ হয় না।
অস্ট্রেলিয়ার পূর্ণশক্তির বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির পিচে ১৬১ রানের ইনিংস দেখার পর ভারতীয় মিডিয়া জয়সোয়ালকে ‘নতুন রাজা’ ডাকতে শুরু করেছে। আর সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে কদিন আগে তাঁর কোচ জোয়ালা সিং জানিয়ে দিয়েছেন, ‘এখন ওর (জয়সোয়ালের) লক্ষ্য শুধু ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করা নয়; বরং পরবর্তী কিংবদন্তি হওয়া।’
বাল্যকাল থেকেই নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে এত দূর আসা জয়সোয়াল কিংবদন্তি হওয়ার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন। যখন যে ‘গিয়ারে’ খেলা দরকার, দ্রুতই সেটার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন এই ওপেনার।
মাত্র ২২ বছর বয়সেই এতটা পরিণত ক্রিকেট খেলার পেছনে অবশ্যই তাঁর কোচ জোয়ালা সিংয়ের অশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে রান করে যেতে বিশেষ প্রতিভার সঙ্গে যে সক্ষমতা দরকার, তা জয়সোয়ালের মধ্যে আছে বলেই সম্ভব হচ্ছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে অল্পতেই তুষ্ট থাকা কিংবা ইনিংস বড় করতে না পারার যে ‘পুরোনো রোগ’, তা জয়সোয়ালের মধ্যে নেই বলেই যেকোনো মাঠে, যেকোনো পরিস্থিতিতে, যেকোনো বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে নিয়মিত রান পাচ্ছেন।
জয়সোয়ালের সেই ১৬১ রান পার্থ টেস্টে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে, মাহমুদুল ৫ রানে আউট হন অ্যান্টিগা টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে। মাহমুদুলের মতো জয়সোয়াল প্রথম ইনিংসে ‘ডাব্বা’ মারেন। মিচেল স্টার্কের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ০ রানে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জেন–জির অবদানই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু মাহমুদুল–শাহাদাত–শরীফুলদের জেন–জি দেশের ক্রিকেটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারবে কবে?
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথমবার ব্যাটিংয়ে নেমেছেন। এ কারণে হয়তো শুরুতে কিছুটা অস্বস্তিতে ছিলেন জয়সোয়াল। কিন্তু ভুল থেকে যে তিনি দ্রুত শিক্ষা নেন, সেটার প্রমাণ দ্বিতীয় ইনিংসেই ১৬১ রান।
বিপরীতে মাহমুদুলকে দেখুন। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে ৫ রানের পর গত রাতে দ্বিতীয় ইনিংসে করতে পারলেন ৬ রান। এর চেয়েও দৃষ্টিকটু হয়ে রইল তাঁর আউট হওয়ার দৃশ্য।
অ্যান্টিগা টেস্টে মাহমুদুল বোধ হয় স্লিপে দাঁড়ানো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফিল্ডারদের ক্যাচিং অনুশীলন করাতে ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন। প্রথম ইনিংসে আলজারি জোসেফের বলে অ্যালিক অ্যাথানেজকে ক্যাচ দেন দ্বিতীয় স্লিপে। গত রাতে জেইডেন সিলসের বলে তৃতীয় স্লিপে ধরা পড়েন জাস্টিন গ্রিভসের হাতে।
এতে একটা বিষয় আরও স্পষ্ট—জয়সোয়ালরা ভুল থেকে তৎক্ষণাৎ শিক্ষা নেন। আর মাহমুদুলরা দিনের পর দিন একই ভুল করে যান। কিন্তু তাঁদের শিক্ষা সফর কখনোই শেষ হয় না।
বাংলাদেশের টেস্ট দলে মাহমুদুলকে বিবেচনা করার বড় কারণ দীর্ঘক্ষণ টিকে থাকতে পারা বা অনেক বেশি বল খেলতে পারা, যা টেস্টে যেকোনো দলের ইনিংসের শুরুতে আশীর্বাদস্বরূপ। জয়সোয়ালকেই বরং বেশি বল খেলার চেয়ে বেশি রান তোলার জন্য উপযুক্ত ওপেনার মনে হয়। কিন্তু বাস্তবতা আলাদা।
টেস্টে এখন পর্যন্ত ২৮ ইনিংসে ২৩১১ বল খেলেছেন জয়সোয়াল; ইনিংসপ্রতি গড়ে ৮২ বল সামলেছেন। মাহমুদুল জয়সোয়ালের চেয়ে দুটি ইনিংস বেশি খেললেও প্রতিপক্ষের বল সামলাতে পেরেছেন ৫৪৩টি কম (৩০ ইনিংসে ১৭৬৮ বল)। অর্থাৎ ইনিংসপ্রতি গড়ে ৫৮ বলের বেশি টিকতে পারেনি বাংলাদেশের এই ওপেনার।
এখানেই শেষ নয়। টেস্টে মাহমুদুলের ব্যাটিংয়ের বৈশিষ্ট্য একটাই—ধরে খেলা। কিন্তু জয়সোয়াল মেরে খেলতেও ওস্তাদ। যেখানে টেস্ট ক্যারিয়ারে মাহমুদুলের ছক্কা মাত্র ৩টি, সেখানে জয়সোয়ালের ৩৮টি। ভারতের বাঁহাতি ওপেনার ২০২৪ সালেই মেরেছেন ৩৫ ছক্কা, যা টেস্ট ইতিহাসে এক পঞ্জিকাবর্ষে কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ!
বলতে পারেন, মাহমুদুল হার্ড হিটার নন। তাই ছক্কার সংখ্যা কম হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু চার মারাতেও জয়সোয়ালের চেয়ে যোজন–যোজন পিছিয়ে মাহমুদুল। ৩০ ইনিংসে মাহমুদুলের চার ৮৫টি, জয়সোয়ালের দ্বিগুণের বেশি—১৭৮টি।
টেস্টে জয়সোয়ালের বর্তমান রান ১৫৬৮; এর মধ্যে বাউন্ডারি থেকে এসেছে ৯৪০। মাহমুদুলের রান ৭২৫; বাউন্ডারি থেকে ৩৫৮। অর্থাৎ জয়সোয়াল তাঁর ক্যারিয়ারের ৫৯.৯৪% রান করেছেন চার–ছক্কা থেকে, যেখানে মাহমুদুলের ৪৯.৩৮%।
১৬ টেস্টের ক্যারিয়ারে মাহমুদুলের সেঞ্চুরি মাত্র একটি। জয়সোয়াল ১৫ টেস্টেই তিন অঙ্ক ছুঁয়েছেন চারবার, এর মধ্যে দুটি আবার ডাবল সেঞ্চুরি। ভারতের বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের ইনিংস রূপান্তরের হার বোঝাতে আরেকটি তথ্য যোগ করা যেতে পারে। তিনি এখন পর্যন্ত যে চারটি সেঞ্চুরি করেছেন, সব কটিতেই রান ১৫০ ছাড়িয়েছে। শনিবার পার্থে তাঁর ১৬১ রানই সেঞ্চুরি পেরোনো ইনিংসগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
দুজনের ব্যাটিং গড় তুলনায় আনতে না হলে ভালোই হতো। এখানেও যে আকাশ–পাতাল ব্যবধান! জয়সোয়ালের গড় ৫৮.০৭, মাহমুদুলের এর অর্ধেকেরও কম—২৪.১৬।
২০২০ অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপজয়ী বাংলাদেশ স্কোয়াডে ছিলেন ১৬ জন। এর মধ্যে ১১ জনের এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে। সেই টুর্নামেন্টেই ভারতের স্কোয়াডে থাকা ১৫ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জনের জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হয়েছে।
এর অর্থ এই নয় যে সামর্থ্য, সক্ষমতা, প্রতিভায় ভারতের ‘২০২০ ব্যাচের’ দলটা বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে। বরং ভারতের পাইপলাইন এতটাই সমৃদ্ধ যে অল্প বয়সেই তাঁদের জাতীয় দলে ডাকার প্রয়োজন পড়ছে না বিসিসিআইয়ের। এ সময়ে তাঁরা ঘরোয়া প্রতিযোগিতা ও ভারতের অন্য দলগুলোতে (‘এ’ দল, ইমার্জিং দল, অনূর্ধ্ব–২৩ দল ইত্যাদি) খেলে আরও পরিণত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের পাইপলাইন তেমন শক্তিশালী না হওয়ায় মাহমুদুলের মতো শরীফুল ইসলাম, শামীম হোসেন, তানজিদ হাসান, তানজিম হাসান, তাওহিদ হৃদয়, পারভেজ হোসেন, শাহাদাত হোসেনদের আরও পরিণত হওয়ার আগেই জাতীয় দলে খেলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
তবে বয়সভিত্তিক দল আর জাতীয় দল যে এক নয়, তা মাহমুদুল–তানজিদ–হৃদয়রা এরই মধ্যে বুঝতে শুরু করেছেন। ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের একাধিক খেলোয়াড় জাতীয় দলে খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না।
মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান শাহাদাত হোসেনের কথাই ধরুন। নিজের প্রথম ৪ টেস্টে ভালো করতে না পারায় দল থেকে বাদ পড়েন শাহাদাত। ছিলেন না পাকিস্তান ও ভারত সফর এবং ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে চলমান টেস্ট সিরিজের দলেও শাহাদাতকে প্রথমে রাখা হয়নি। কিন্তু কুঁচকির চোটে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন ছিটকে পড়ায় কপাল খোলে শাহাদাতের। অ্যান্টিগা টেস্টের একাদশেও রাখা হয়েছে তাঁকে। কিন্তু সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলেন কই? টেস্ট ব্যাটিং লাইন আপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পজিশন হিসেবে বিবেচিত চারে নেমে প্রথম ইনিংসে করতে পেরেছেন ১৮ রান, দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু থেকেই নড়বড়ে টেকনিক নিয়ে ভুগতে ভুগতে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়েছেন ৪ রান করে।
অথচ চার বছর আগে অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালে বাংলাদেশের কাছে হেরে যাওয়া ভারতীয় দলের আরেক সদস্য তিলক বর্মাকে দেখুন। সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে টি–টোয়েন্টি সিরিজে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি পেয়েছেন তিলক; দুটিতেই অপরাজিত।
এ নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে রসিকতা হচ্ছে। তিলক যেখানে তিন দিনের ব্যবধানে দুটি সেঞ্চুরি পেয়ে গেছেন, সেখানে ১৮ বছর ধরে আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি খেলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি মাত্র একটি! সেটাও ২০১৬ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তামিম ইকবালের। ট্রল হওয়াটাই তো স্বাভাবিক!
বিরাট কোহলি, জো রুট, স্টিভেন স্মিথ ও কেইন উইলিয়ামসনকে বিশ্ব ক্রিকেটের ‘ফ্যাবুলাস ফোর’ নামে ডাকা হয়। ক্রিকেটবিষয়ক ওয়েবসাইট ইএসপিএন ক্রিকইনফো জেন–জি প্রজন্মেরও ‘ফ্যাবুলাস ফোর’ তৈরি করে ফেলেছে। সেই তালিকায় ইংল্যান্ডের হ্যারি ব্রুক, নিউজিল্যান্ডের রাচিন রবীন্দ্র, শ্রীলঙ্কার কামিন্দু মেন্ডিসের সঙ্গে রাখা হয়েছে ভারতের যশস্বী জয়সোয়ালকে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জেন–জির অবদানই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু মাহমুদুল–শাহাদাত–শরীফুলদের জেন–জি দেশের ক্রিকেটে কবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে কিংবা আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন অনেক ক্রিকেটপ্রেমীরই।