জহির খানকে পোর্ট অব স্পেনে এভাবেই সেই ছক্কাটি মেরেছিলেন তামিম
জহির খানকে পোর্ট অব স্পেনে এভাবেই সেই ছক্কাটি মেরেছিলেন তামিম

পোর্ট অব স্পেন থেকে লর্ডস—তামিমের স্মরণীয় যত ইনিংস

আচমকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন তামিম ইকবাল। প্রায় ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে তামিম খেলেছেন স্মরণীয় সব ইনিংস। এর কয়েকটির দিকে ফিরে তাকালে যা সামনে আসে—

ত্রিনিদাদে আগমনী বার্তা

৫৩ বলে ৫১, ৭ চার, ২ ছক্কা; বিপক্ষ ভারত, পোর্ট অব স্পেন, বিশ্বকাপ ২০০৭
জহির খান লেংথ কমিয়ে এনেছিলেন, হয়তো তামিম ইকবালকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখেই। তামিম দমলেন না। তামিমের তখন দমে যাওয়ার বয়স নয়, ভারতের সবচেয়ে অভিজ্ঞ পেসারকে সমীহ করার চিন্তাও হয়তো ছিল না। জহিরের বলটা তামিম পাঠালেন লং অনের ওপর দিয়ে, সেটি গিয়ে লাগল গ্যালারির দ্বিতীয় তলার কার্নিশে। ধারাভাষ্যে ‘অহ হো’ করে হেসে উঠলেন ইয়ান বিশপ, তখনো তামিমকে তিনি ডাকছিলেন ‘সারনেম’ ইকবাল বলে। ৪ ম্যাচের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তামিম যেন দেখালেন নতুন কিছু—এমন মঞ্চে এমন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে এমন ভয়ডরহীন ব্যাটিং। যে শটে ফিফটি হয়েছিল, সেটি ক্যাচের মতো উঠেছিল, মিড অফে রাহুল দ্রাবিড় নিতে পারেননি সেটি। তাতে কিছু আসে–যায়নি তামিমের। ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় পর্বে যাওয়ার পথটা পরিষ্কার করেছিল বাংলাদেশ। আর এর পর থেকে তামিম ইকবাল নামটা শুনলেই হয়তো ইনিংসটা, জহিরকে মারা ওই শট চোখে ভাসে অনেকের।

২০০৭ বিশ্বকাপে নিজেকে চিনিয়েছিলেন তামিম

ম্লান যখন বিশ্ব রেকর্ডও

১৩৮ বলে ১৫৪, ৭ চার, ৬ ছক্কা, বিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, বুলাওয়ে ২০০৯
বেচারা চার্লস কভেন্ট্রি! সাঈদ আনোয়ারের ১৯৪ রানের রেকর্ড ছুঁয়েছিলেন, হয়েছিলেন ম্যাচসেরা। অথচ তাঁকে সেদিন থাকতে হয়েছিল পরাজিত দলেই! কারণ—তামিম ইকবাল। বুলাওয়েতে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল ৩১৩ রান, তখন পর্যন্ত ৩০০ বা এর বেশি রান তাড়া করে জেতেনি তারা। তামিম সেখানে দাঁড়িয়ে করলেন ১৩৮ বলে ১৫৪ রান। তার আগে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের ১৫০ রানের ইনিংসই ছিল না ওয়ানডেতে। ৬১ বলে ফিফটি করেছিলেন তামিম, সেঞ্চুরি করতে লেগেছিল ১০৫ বল। ৪৫তম ওভারে যখন আউট হন, তামিম খেলে ফেলেছেন অন্যতম স্মরণীয় এক ইনিংস। ২০২০ সালে এসে একই প্রতিপক্ষের সঙ্গে নিজের রেকর্ডটিই ভাঙেন তামিম, এবার করেন ১৫৮ রান। যদিও ঠিক পরের ম্যাচেই সে রেকর্ড ভেঙে দেন লিটন দাস।

লর্ডসে সেঞ্চুরির পর তামিম

অনার্স বোর্ডের সম্মান

১০০ বলে ১০৩, ১৫ চার, ২ ছক্কা, বিপক্ষ ইংল্যান্ড, লর্ডস, ২০১০
প্রথম ইনিংসে ৬২ বলে ৫৫ রান করে রানআউট হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে অনার্স বোর্ডের দেখভাল করা ব্যক্তিকে তামিম ইকবাল অনুরোধ করেছিলেন, ‘প্লিজ ফিফটির জন্য একটা বোর্ড বানাও। লাগলে আমি খরচ দেব।’ লর্ডসের সেঞ্চুরি, অনার্স বোর্ডের নামটি তুলতে তামিম এতটাই মরিয়া ছিলেন! তামিমের সেই অদ্ভুত অনুরোধে স্বাভাবিকভাবেই রাজি হননি সে ব্যক্তি। ফলো-অনে পড়ে দ্বিতীয় ইনিংসে যখন টিম ব্রেসনানকে মিড অনের ওপর দিয়ে তুলে চার মারলেন, তামিমের নামটি উঠে গেল অনার্স বোর্ডে।

৯৪ বলে সেঞ্চুরি—যে ইনিংস ছিল বিনোদনে ঠাসা। উদ্‌যাপনের শেষটা তামিম করেছিলেন হাত দিয়ে কল্পিত বোর্ড এঁকে, এরপর জার্সির পেছনে নিজের কল্পিত নাম (তখনো টেস্ট জার্সিতে নাম বা নম্বর থাকত না) দেখিয়ে। শেষ দিনে গিয়ে বাংলাদেশ হেরেছিল সে টেস্ট, হেরেছিল ওল্ড ট্রাফোর্ডে পরের টেস্টটিও। তবে তামিম ম্যানচেস্টারেও প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ১১৪ বলে ১০৮ রান, ব্যাটিংয়ের জন্য কঠিন এক কন্ডিশনে। ক্যারিয়ারে ইংল্যান্ডের মাটিতে দুটি টেস্ট খেলেছেন তামিম, দুটিকেই স্মরণীয় করে রেখেছেন ব্যক্তিগত অর্জনে।

২০১২ এশিয়া কাপে তামিমের সেই বার্তা

এক, দুই, তিন, চার

২০১২ এশিয়া কাপ, টানা চার ফিফটি
২০১২ সালের এশিয়া কাপ হয়তো বাংলাদেশের হৃদয়ভঙ্গের তালিকায় থাকবে ওপরের দিকেই। দেশের মাটিতে ফাইনালে ওঠা, সেখানে এত কাছে গিয়ে হেরে যাওয়া পাকিস্তানের কাছে। সেই এশিয়া কাপ স্মরণীয় তামিমের জন্যও। প্রাথমিকভাবে ঘোষিত দলে বাদ পড়েছিলেন, সে সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়েছিল বিতর্ক। পরে ফেরানো হয় তাঁকে। তামিম সেটার জবাব দেন টানা চারটি ফিফটি করে, যার শেষটি এসেছিল ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে। সেই ফিফটির উদযাপন তামিম করেছিলেন একে একে চারটি আঙুল তুলে বিশেষ এক বার্তা দিয়ে।

খুলনায় ডাবল

২৭৮ বলে ২০৬, ১৭ চার, ৭ ছক্কা, বিপক্ষ পাকিস্তান, খুলনা ২০১৫
বাংলাদেশের কাঁধে তখন ২৯৬ রানের লিডের বোঝা। খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে বাংলাদেশকে চোখ রাঙাচ্ছিল বড় হার। তবে ইমরুল কায়েসকে নিয়ে তামিম ইকবাল ভেবেছিলেন ভিন্ন কিছু। দ্বিতীয় ইনিংসে ওপেনিংয়ে তামিম ও ইমরুল যোগ করেছিলেন রেকর্ড ৩১২ রান, যেটি এখনো টেস্টে ওপেনিংয়ে সর্বোচ্চ ও যেকোনো উইকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটি বাংলাদেশের। তামিম করেছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ও একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরিটি। পাঁচ সেশনের বেশি সময় ব্যাটিং করে স্মরণীয় এক ড্র পেয়েছিল বাংলাদেশ।

এমন বাহারি সব শটে সাজানো ছিল তামিমের ৬৩ বলে অপরাজিত ১০৩ রানের ইনিংসটি

বিশে একশ

৬৩ বলে ১০৩ *, ১০ চার, ৫ ছক্কা
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় বলেছেন আজ, যদিও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছিলেন আগেই। সেটিও ফেসবুকের একটি পোস্টের মাধ্যমে। এ সংস্করণে তামিমের স্মরণীয় দিনটি এসেছিল ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। ধর্মশালায় ওমানের বিপক্ষে তামিম করেছিলেন সেঞ্চুরি, যেটি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এখনো বাংলাদেশের একমাত্র তিন অঙ্কের ইনিংস। ধর্মশালায়ই এ বছরের ওয়ানডে বিশ্বকাপ শুরু করবে বাংলাদেশ, হয়তো আচমকা অবসর না নিলে সে ম্যাচে নেতৃত্বে থাকতেন তামিমই!

মিরপুর জয়

১৪৭ বলে ১০৪, ১২ চার, বিপক্ষ ইংল্যান্ড, মিরপুর, ২০১৬
তিন দিনে শেষ হয়েছিল টেস্ট। স্পিন স্বর্গে ব্যাটসম্যানদের জন্য মিরপুরের উইকেট ছিল ‘মাইনফিল্ড’। দুই দলের চার ইনিংস মিলিয়ে ফিফটি বা তার বেশি রানের ইনিংস ছিল মাত্র ছয়টি। তবে তামিম ইকবাল প্রথম ইনিংসে খেলেছিলেন যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক উইকেটে। দলীয় ১৭১ রানে দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়েছিলেন তামিম, বাংলাদেশ এরপর গুটিয়ে যায় ২২০ রানেই। ব্যাটিংয়ের জন্য কতটা কঠিন ছিল সে উইকেট, অনেকটা বোঝা যায় তাতেই। শেষ পর্যন্ত ১২ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তবে তামিমের প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিই আসলে গড়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্মরণীয় জয়ের ভিতটা। দ্বিতীয় ইনিংসেও ৪৭ বলে ৪০ রানের ইনিংসে বাংলাদেশকে ভালো সূচনা এনে দিয়েছিলেন তিনি।

মিরপুর জয় (২)

১৪৪ বলে ৭১ ও ১৫৫ বলে ৭৮ রান, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, মিরপুর, ২০১৭
ইংল্যান্ডকে হারানোর পরের বছর মিরপুরে এবার অস্ট্রেলিয়া বধ বাংলাদেশের। স্পিনসহায়ক উইকেটে প্রথম ইনিংসে ১৪৪ বলে ৭১ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫৫ বলে ৭৮ রান তামিমের। সেটিও নাথান লায়নের মতো স্পিনার, জশ হ্যাজলউড, প্যাট কামিন্সদের মতো পেসারদের সামলে। ঐতিহাসিক জয়ে অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। তবে তামিমের ওই দুটি ইনিংস বাদ দিলে বাংলাদেশের জয়টাও তো মিলিয়ে যায়!

দলের প্রয়োজনে এক হাতে ব্যাট করে আলোড়ন তুলেছিলেন তামিম

এক হাতেই দুর্বার

৪ বলে ২ *, বিপক্ষ শ্রীলঙ্কা, দুবাই, এশিয়া কাপ ২০১৮
ক্যারিয়ারে ২৫টি সেঞ্চুরি, ৯৪টি ফিফটি, ১৫ হাজারের বেশি আন্তর্জাতিক রান। তবু কেন তামিমকে আলাদা করে মনে রাখা হবে ২ রানের অপরাজিত এক ইনিংসের জন্য? কারণ, সেদিন এক হাতে এক বল খেলেছিলেন তামিম। সুরঙ্গা লাকমলের বাউন্সারে আঘাত পেয়ে তিন বল খেলেই উঠে গিয়েছিলেন এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচে।

৪৭তম ওভারের পঞ্চম বলে মোস্তাফিজুর রহমান যখন নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন, মুশফিকুর রহিম তখন অপরাজিত ১১২ রানে। মোমেন্টাম তাঁর পক্ষে স্বাভাবিকভাবেই। তামিম এক হাতে প্লাস্টার নিয়ে নেমে গেলেন, এক হাতে ব্যাটিং করে এক বল খেলে স্ট্রাইক ফিরিয়ে দিলেন মুশফিককে। ১৬ বলে ৩২ রানের জুটিতে আপাতদৃষ্টে তামিমের অবদান এক রানও নয়, তবে তিনি নামার পর একলাফে বাংলাদেশ গেল ২৬১ পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত আরেকটি ফাইনাল খেলা টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচটি বাংলাদেশ জিতেছিল ১৩৭ রানের বড় ব্যবধানে। তবে তামিম যে সাহস দেখিয়েছিলেন, সেটি ছিল যেন তার চেয়ে অনেক বড়!