মহীশ তিকশানার ক্যারম বলটা ভয়ংকর। বোলিংয়ে গতির বৈচিত্র্যও। শ্রীলঙ্কার এই রহস্য স্পিনার আইপিএলে খেলেন চেন্নাই সুপার কিংসে। ২৩ বছর বয়সী তিকশানার ক্রিকইনফো প্রোফাইলে ঝলমল করে এম এস ধোনির দলের নামটি। কিন্তু দারুণ সম্ভাবনাময় এই স্পিনারের একটা দুর্বলতা বাংলাদেশ দল খুঁজে বের করেছে। এই স্পিনারের নাকি সাহস একটু কম। দু-একটা ছক্কা মারলেই স্পিনার থেকে হয়ে যান ‘থার্ড সিমার’। এরপর ব্যাটসম্যানের পা তাক করে একের পর এক জোরের ওপর ইয়র্কার করতে থাকেন।
গতকাল সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের ইনিংস যখন ধ্বংসস্তূপ, সেখানে দাঁড়িয়ে সেই তিকশানাকে পেয়েছিলেন রিশাদ হোসেন। তিকশানার ২ ওভারের স্পেলে ১১টি বলই খেলেছেন রিশাদ, ছক্কা মেরেছেন ৪টি। তিকশানার ওপর চড়াও হওয়ার আগেই দুটি ছক্কা মেরেছেন আরেক লঙ্কান তারকা স্পিনার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গাকে। তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে রিশাদের সাত ছক্কার আরেকটি বাঁহাতি পেসার বিনুরা ফার্নান্ডোর বলে। এক ইনিংসে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের সবচেয়ে বেশি ছক্কার রেকর্ডটাও রিশাদের হয়ে গেছে। ৩০ বলে রিশাদের ৫৩ রানের ইনিংসটি আট বা এরপর নেমে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ইনিংস।
বাংলাদেশ ম্যাচটা ২৮ রানে হারলেও রিশাদের ছক্কাগুলো যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের তা চোখে লেগে থাকার কথা। কারণ, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের এমন রূপ মনে হয় না আগে কখনো দেখা গেছে। এই সিরিজের প্রথম ম্যাচেই জাকের আলী ৬টি ছক্কা মেরেছেন। তবে সেখানে পাওয়ার হিটিং টেকনিকের বড় ভূমিকা ছিল। যেখানে ৬ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতার রিশাদের ছক্কাগুলো সব গায়ের জোরে। রিশাদ অবশ্য এমন ঝোড়ো ইনিংস খেলে আসছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই। ছক্কা মারার সামর্থ্যের সঙ্গে তাঁর ফিল্ডিংও দুর্দান্ত। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ফিল্ডিংয়ের ‘হট স্পট’ মিডউইকেট, লং অন, লং অফের দিকে তাকালেই দেখবেন, সেখানে দীর্ঘদেহী রিশাদ দাঁড়িয়ে।
এতক্ষণ যা বলা হলো, তার সবই ক্রিকেটার রিশাদের দ্বিতীয় পরিচয়। তাঁর মূল পরিচয় তো লেগ স্পিনার। গত বছর আয়ারল্যান্ড সিরিজে টি-টোয়েন্টিতে অভিষিক্ত রিশাদ গত ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকেই ২০ ওভারের খেলায় নিয়মিত, নিউজিল্যান্ডে ২টি ওয়ানডেও খেলেছেন। শ্রীলঙ্কা সিরিজে ৩ ম্যাচে ওভারপ্রতি ৮ রান দিয়ে রিশাদের শিকার ৩ উইকেট। উইকেটগুলো এসেছে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে। সিরিজের শেষ ম্যাচে আউট করেছেন উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়া দুই ব্যাটসম্যান কামিন্দু মেন্ডিস ও অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে। প্রথম ম্যাচে ৫৯ রানে থামিয়েছেন কুশল মেন্ডিসকে। টি-টোয়েন্টি দলে লেগ স্পিনারদের বাড়তি কদর তো এ কারণেই। খরুচে বোলিং করলেও লেগ স্পিন উইকেট এনে দেয়।
লেগ স্পিন ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন শাখা বলে লেগ স্পিনারদের বাড়তি পরিচর্যা লাগে। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাস্তবতায় সেটিরই বড় অভাব। কারণ, কন্ডিশনের কারণে দলগুলো লেগ স্পিনার একাদশে রাখার প্রয়োজনই বোধ করে না। রিশাদই এর আদর্শ উদাহরণ। এবারের বিপিএলে রিশাদ খেলেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের হয়ে। লিগ পর্বের যে চারটি ম্যাচে তিনি সুযোগ পেয়েছেন, এর সব কটি চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম মানেই ব্যাটিং-স্বর্গ। যেখানে ফিঙ্গার স্পিনের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই বেশি কার্যকর লেগ স্পিন, কুমিল্লা তাই শুধু সেখানেই তাঁকে খেলিয়েছে।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও তিনি খুব বেশি ম্যাচ পান না। কারণ, যে সময় ঢাকা লিগ হয়, তখন ঢাকার বেশির ভাগ উইকেট অতি ব্যবহারে ক্লান্ত। স্বাভাবিকভাবেই এসব উইকেটে ফিঙ্গার স্পিনারেরই চাহিদা বেশি। বাকি রইল প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, যেখানে স্পিনার গড়ে তোলার চেয়ে পেসার তৈরিতে বিসিবির এখন বেশি মনোযোগ।
পরিসংখ্যানেও হতাশার গল্পটা স্পষ্ট। ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত রিশাদ এখন পর্যন্ত দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ১৯টি, লিস্ট ‘এ’ ৩টি এবং ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি ১৮টি। বাকি রইল বিসিবির বয়সভিত্তিক দল, হাই পারফরম্যান্স প্রোগ্রাম, টাইগার্স ও ‘এ’ দল। রিশাদকে এসব প্রোগ্রামে রেখেই একটু একটু করে গড়ে তোলা হয়েছে।
রিশাদের ভাগ্য ভালো, দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেওয়া চন্ডিকা হাথুরুসিংহে লেগ স্পিন বোলিংয়ের মহিমাটা খুব ভালো বোঝেন। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে প্রথম মেয়াদে তিনি জুবায়ের হোসেন, তানভীর হায়দারকে জাতীয় দলে সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের ক্যারিয়ার নানা কারণে দীর্ঘ হয়নি। এবার এসে পেয়েছেন রিশাদকে। দীর্ঘদেহী, ছক্কা মারতে পারেন, দুর্দান্ত ফিল্ডার—সব মিলিয়ে আদর্শ ‘হোয়াইট বল প্যাকেজ’। যে কারণে রিশাদের ওপর আস্থা রাখছেন হাথুরুসিংহে। তবে মনে রাখতে হবে, দিন শেষে রিশাদকে বিচার করা হবে উইকেট দিয়েই, চার-ছক্কা দিয়ে নয়।
তবে শেষ টি-টোয়েন্টির ব্যাটিং থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাস হয়তো সঞ্চারিত হবে তাঁর বোলিংয়েও। ১৩ মার্চ শুরু ওয়ানডে সিরিজের দলেও আছেন। তাঁর দিকে একটু বাড়তি নজর তো থাকবেই সবার।