সিডনি, বেঙ্গালুরু, ম্যানচেস্টার, সেঞ্চুরিয়ন, মোহালি, অ্যাডিলেড, ম্যানচেস্টার... ম্যানচেস্টার নামটা দুবার দেখে ভাববেন না যে ভুল হয়েছে। ম্যানচেস্টার দুবারই হবে। চার দেশের এই ছয় শহরের মধ্যে মিল কোথায়, জানেন তো? শিরোনামই বলে দিচ্ছে লেখাটা ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে। উত্তরটা তাই আপনার অনুমান করে ফেলার কথা। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান মহারণের সাক্ষী এই ছয় শহরের স্টেডিয়াম। যেটিতে আজ যোগ হচ্ছে আহমেদাবাদের নাম।
এই বিশ্বকাপে ভারতের ম্যাচ ছাড়া দর্শকে ভরা গ্যালারির দেখাই মিলছে না। ক্রিকেট–পাগল দেশ হিসেবে এমন সুনাম, অথচ বিশ্বকাপের ম্যাচ নিয়ে কিনা এমন অনাগ্রহ! যদিও রহস্য হয়ে থাকছে টিকিট বিক্রির ওয়েবসাইট। গ্যালারি ফাঁকা থাকলেও সেখানে যে দেখাচ্ছে, ম্যাচের টিকিট ‘সোল্ড আউট’! আহমেদাবাদেও যদি তা হয়, তাহলে একটা কেলেঙ্কারিই হবে। কারণ, চেন্নাইয়ে বসেও এই ম্যাচ নিয়ে যে উত্তাপ টের পাচ্ছি, তাতে মনে হতেই পারে, ভারতের সব মানুষই আজ আহমেদাবাদের গ্যালারিতে থাকতে চায়।
আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম প্রথম দিন থেকেই একটা ক্ষেত্রে অনন্য হয়ে আছে। পৃথিবীতে আর কোনো ক্রিকেট স্টেডিয়াম আছে, যেটি দুজন রাষ্ট্রপ্রধান মিলে উদ্বোধন করেছেন? যাঁদের একজন আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। অথচ কত বলে ওভার হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প সেটাও জানেন কি না, সন্দেহ!
শুরুর দিন থেকেই সঙ্গী আরেকটা রেকর্ডও। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। দর্শক ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৩২ হাজার। এই ম্যাচের দিন-তারিখ চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই টিকিটের জন্য যে হাহাকার, তাতে সেটিকেও মনে হচ্ছে যথেষ্ট নয়। রেকর্ড গড়েই জন্ম যে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের, আজ কি সেখানে আরেকটা রেকর্ডও ভেঙে যাবে? বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়ে সম্ভবত খেলাধুলার ইতিহাসেই সবচেয়ে বড় এক রহস্যের নাম হয়ে আছে। সেই রহস্য কি ঘুচে যাবে আজ?
সেই রহস্যকে অঙ্কে প্রকাশ করতে গেলে তা হয় ৭-০। সেই ১৯৯২ বিশ্বকাপ থেকে বাঁয়ের সংখ্যাটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, ডানের ‘শূন্য’টা অপরিবর্তিত। বিশ্বের চার দেশের ছয় শহরে ওই সাতটি ম্যাচের সাত রকম গল্প। সব গল্পের শেষটাই শুধু এক থেকেছে। বলতে গেলে পরিণত হয়েছে নিয়মে। বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে পাকিস্তান কখনো জেতে না।
কাল দুপুরে পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজমের সংবাদ সম্মেলনের শুরুও অবধারিতভাবে এই প্রশ্ন দিয়ে, যা করলেন এক পাকিস্তানি সাংবাদিকই। প্রশ্নটা যে হবে, বাবরও যেন তা জানতেন। উত্তরটাও মনে হয় ভেবে এসেছিলেন, ‘আমি অতীত নিয়ে ভাবি না, ভাবি ভবিষ্যৎ নিয়ে। এসব রেকর্ড হয় ভাঙবে বলেই।’
এই বিশ্বকাপে সশরীর উপস্থিত না থেকেও অ্যাক্রিডিটেড সাংবাদিকেরা যেকোনো সংবাদ সম্মেলন শুনতে বা দেখতে পারেন। পাসওয়ার্ড দিয়ে আইসিসি মিডিয়া জোনে ঢুকে পড়লেই হয়। সেখানেই বাবর আজমের সংবাদ সম্মেলন দেখতে দেখতে মিসবাহ-উল হকের কথা মনে পড়ছিল। ২০১৫ বিশ্বকাপে অ্যাডিলেডে ভারতের মুখোমুখি হওয়ার আগের দিনও একই প্রশ্ন করা হয়েছিল পাকিস্তান অধিনায়ককে। বাবর তো কাল একটু নরম-সরম উত্তরই দিয়েছেন। মিসবাহ তাঁর দলের মেজাজটা বুঝিয়ে দিতে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমাকে বলুন তো, পৃথিবীতে কোন ইতিহাসটা আছে, যেটা বদলায়নি? বদলাবে, এটাও বদলাবে।’
কবে বদলাবে, সুনির্দিষ্টভাবে তা না বললেও পরদিনের ম্যাচের কথাই বুঝেছিলেন সবাই। বদলানো বলতে ৫-০–এর জায়গায় ৬-০ হয়েছিল। ম্যাচের পর সেই মিসবাহ-উল হকের কথাবার্তাতেই মনে হচ্ছিল, বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে হারটাকে নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছেন। এই ‘ঝামেলা’টা শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি বরং খুশি, ‘যাক, ম্যাচটা শেষ হয়েছে, আমরা এখন বিশ্বকাপে মন দিতে পারব।’
বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপ ছাড়া এখন ভারত আর পাকিস্তানের দেখাই হয় না। বিশ্বকাপের ফিকশ্চার হওয়ার দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় এই ম্যাচের জন্য ক্ষণগণনা। খেলাটা বিশ্বের যে দেশেই হোক না কেন, উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে সীমান্তের দুই পারের দুই দেশ। তারপরও অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডে খেলা আর এই দুই দেশের কোনো একটিতে খেলার মধ্যে পার্থক্য তো আছেই। অ্যাডিলেডেই যদি মিসবাহ-উল হকরা ম্যাচটা শেষ হওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচে থাকেন, এখানে তো বাবর আজমদের ওপর আরও বেশি চাপ। প্রতিপক্ষের মাঠে খেলা, ভিসা জটিলতায় যে মাঠের গ্যালারিতে পাকিস্তানি পতাকা আদৌ উড়বে কি না, এ নিয়েই সন্দেহ। বাবর আজমদের জন্য গ্যালারিতে নীল সমুদ্রের ওই গর্জনও মাঠের ভারতের চেয়ে কম বড় প্রতিপক্ষ নয়।
তবে চাপের কথা যদি বলেন, তা হয়তো ভারতের ওপরই বেশি। ৩১ বছর ধরে অক্ষত গর্বের এক রেকর্ড নিজেদের দেশে বিসর্জন দিতে হওয়ার কথাটা ভাবলেও তো শরীরে কাঁটা দেওয়ার কথা। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের অদৃশ্য অনুষঙ্গ হয়ে ওই ‘চাপ’ সব সময়ই ছিল, সব সময়ই থাকবে। ম্যাচের দিন কোন দল তাতে বেশি ভেঙে পড়ে—প্রশ্ন হলো এটাই। বিশ্বকাপে এত বছরেও এই প্রশ্নের উত্তর বদলায়নি। দুই দলের শক্তি-দুর্বলতা, এই বিশ্বকাপে পারফরম্যান্স...এসব নিয়ে আলোচনাকে অর্থহীন বানিয়ে আজকের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের আগে বড় হয়ে উঠেছে ওই প্রশ্নটাই। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় রহস্যটা কি আজ ঘুচে যাবে, নাকি ৭-০ হয়ে যাবে ৮-০?