দেড়টা বেজে গেছে। খেলা তিনটায়। পাকিস্তান দলের ক্রিকেটাররা তখনো গ্র্যান্ড সিনামোন হোটেলের লবিতে। টিম বাস মাঠের উদ্দেশে ছাড়তে ছাড়তে ১টা বেজে ৪০ মিনিট।
বাইরে তখন বৃষ্টির ঝাপটা কিছুটা কমে এসেছে। তবে তার আগে কলম্বোয় ঘণ্টাখানেক ধরে যে ঝুম বৃষ্টিটা হয়ে গেছে, তাতেই সবাই তখন মোটামুটি নিশ্চিত যে রিজার্ভ ডেতেও খেলা যথাসময়ে শুরু হচ্ছে না। পাকিস্তান দল হয়তো সে কারণেই একটু আয়েশ করে হোটেল ছাড়ল।
বৃষ্টি থামলে নির্ধারিত সময়ের ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে খেলা শুরু হয় ওভার না কমিয়েই। খেলা না বলে বিরাট কোহলি–লোকেশ রাহুলের ব্যাটিং–ঝড় বলাই ভালো। দুই ঝড়ের কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন, সে আপনার সিদ্ধান্ত। কোহলি ৯৪ বলে অপরাজিত ১২২ রান করলে ইনিংসটা কেমন হতে পারে, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। প্রায় ছয় মাস পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে ১০৬ বলে খেলা অপরাজিত ১১১ রানের ইনিংসে রাহুল যা করলেন, তা–ও কম রোমাঞ্চকর ছিল না।
বৃষ্টিতে ইনিংসের ২৪.১ ওভার পর খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়া আগের দিন একই রকম শুরু করেছিলেন ভারতের দুই ওপেনার রোহিত শর্মা ও শুবমান গিল। রোহিত–রাহুল জুটি বাঁধতে না বাঁধতে খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল এই ভেবে যে ভারতের ‘ব্যাটিং–ধামাকা’য় একটা ছেদ তো পড়ল। তার আগে দুই ওপেনারকে ফেরাতে পারাটাও শুরু থেকে মার খেতে থাকা পাকিস্তানের বোলারদের আত্মবিশ্বাস কিছুটা ফিরিয়ে দিয়ে থাকবে।
কিন্তু রোহিত–গিল যেখানে ছেড়ে গিয়েছিলেন, পরশু ৭ ওভার একটু দম নিয়ে কাল যেন সেখান থেকেই শুরু করলেন কোহলি–রাহুল। গতকাল ২৪.১ ওভারে ভারতের ২ উইকেটে করা ১৪৭ রানে থেমেছিল খেলা। আজ নিরবচ্ছিন্নভাবে হওয়া ভারত ইনিংসের বাকি ২৫.৫ ওভারে কোহলি–রাহুল মিলে করেন আরও ২০৯ রান, সেটাও দুজনের কেউই আউট না হয়ে!
ওদিকে রিজার্ভ ডে পেয়ে বৃষ্টিও পিছু ছাড়ছিল না ভারত–পাকিস্তান মহারণের। পাকিস্তানের ইনিংসের ১১ ওভার শেষ হতেই আবার বৃষ্টি। ততক্ষণে ৪৪ রান তুলতে পড়ে গেছে ওপেনার ইমাম–উল হক ও অধিনায়ক বাবর আজমের উইকেট। ১ ঘণ্টা ১২ মিনিট পর খেলা শুরু হলে এবারও কমানো হয়নি ওভার, পাকিস্তানের লক্ষ্যও আগের মতোই ৩৫৭। আর সেই অসম্ভব লক্ষ্য তাড়া করার আতঙ্কেই কি না, ওয়ানডের ১ নম্বর দল রীতিমতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল। লক্ষ্যহীন ব্যাটিংয়ে ভুল শটের ছড়াছড়িরই মাশুল সেটা। তাতে ১২৮ রানে ৮ উইকেট হারিয়েই ২২৮ রানের হার মেনে নিতে হয় পাকিস্তানকে। রানের হিসাবে ওয়ানডেতে পাকিস্তানের বিপক্ষে যা ভারতের সবচেয়ে বড় জয়। হারের এই বিশাল ব্যবধান চোটে পড়ে হারিস রউফ আর নাসিম শাহর ব্যাটিং করতে না পারা নিয়েও আফসোসের কোনো সুযোগ রাখেনি পাকিস্তানের।
ভারতের পেস–স্পিন কিছুর সামনেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন না পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা। কূলদীপ যাদবের কথা আলাদা করেই বলতে হয়। পাকিস্তানের বিপক্ষে আগের ম্যাচে ভারতকে বোলিং করতে হয়নি। নেপালের বিপক্ষে পরের ম্যাচে ৩৪ রান দিলেও উইকেটি পাননি কূলদীপ। কাল তার সামনেই ভেঙে পড়ে পাকিস্তান। ৮ ওভারে ২৫ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে পাকিস্তানের বোলাররা ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের কাছে কতটা নিষ্পেষিত হয়েছেন, তা বুঝতে পারবেন শাহীন শাহ আফ্রিদি–ফাহিম আশরাফদের ইকোনমি রেট দেখলে। ছয় বোলারের মধ্যে চারজনেরই ৭–এর ওপরে, ৫–এর নিচে নেই কারওটাই। সবচেয়ে কম হারিস রউফের ৫.৪০, সেটাও আগের দিন করা ৫ ওভারে। মাংসপেশির চোটের কারণে কাল বোলিংও করেননি এই পেসার।
ব্যাটিং বিনোদনের প্রদর্শনীর দিনে কোহলি–রাহুল শুধু সেঞ্চুরিই করেননি, গ্যালারি মাতিয়ে রাখা তাঁদের ২৩৩ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে কিছু রেকর্ডও দেখেছে প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম। ওয়ানডেতে কালকের ৩৫৬ রানই এখন পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের সর্বোচ্চ। ম্যাচটা জিততে পাকিস্তানকেও ভাঙতে হতো নিজেদের দুটি রেকর্ড। সব দল মিলিয়ে ৩৪৯ এবং ভারতের বিপক্ষে ৩২২, ওয়ানডে ক্রিকেটে যে এর চেয়ে বেশি রান তাড়া করে জেতার নজিরই নেই তাঁদের।
ব্যক্তিগত ৭৬ রানে আফ্রিদির স্লোয়ার বুঝতে না পেরে ডিপ থার্ডম্যানে ক্যাচ দিয়েও কোহলি বেঁচে যান নাসিমের হাত থেকে। তাঁর মতো ব্যাটসম্যান এমন সুযোগ পেয়েও বড় কিছু করবেন না, তা তো হয় না। পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের তুলাধোনা করে আবারও তিনি নিজেকে নিয়ে এলেন সেঞ্চুরির আলোয়, ওয়ানডেতে নিজের ৪৭তম সেঞ্চুরি। শচীন টেন্ডুলকারকে (৪৯) ধরতে আর মাত্র দুবারই তিন অঙ্ক ছুঁতে হবে কোহলিকে।
রাহুলের জন্যও ছিল সুযোগ কাজে লাগানোর তাড়না। ভারত–পাকিস্তান এ ম্যাচের আগে রিজার্ভ ডের মতো আলোচনা ছিল ভারতের ওপেনিং জুটি নিয়েও। রোহিতের সঙ্গে শ্রেয়াস আইয়ারই থাকবেন, নাকি ফিরবেন গত মার্চে সর্বশেষ ওয়ানডে খেলা রাহুল? ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজটা সহজ করে দেয় পিঠের অস্ত্রোপচার করিয়ে ফেরার পর দুই ম্যাচ খেলেই অনুশীলনে পাওয়া শ্রেয়াসের পিঠের চোট। এরপর রাহুল কী করলেন, তা তো দেখলেনই—এলেন, খেললেন এবং জয় করলেন।
গ্রুপ পর্বে দুই দলের প্রথম সাক্ষাৎ অসমাপ্ত রেখে দিয়েছিল ক্যান্ডির বৃষ্টি। তবে বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হওয়ার আগে ২৬৬ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছিল ভারত, পাকিস্তান আফসোসে পুড়েছে একটি সম্ভাব্য জয় হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায়। রিজার্ভ ডে না থাকলে একই পরিণত হতে পারত সুপার ফোরের ম্যাচেরও। তবে এবার হয়তো আফসোসটা করত ভারত।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ভারত: ৫০ ওভারে ৩৫৬/২
পাকিস্তান: ৩২ ওভারে ১২৮/৮
ফল: ভারত ২২৮ রানে জয়ী।