রোহিত শর্মার বয়স তখন ১১ বছর। স্থানীয় এক ক্রিকেট ম্যাচে প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়েরা প্রতারণা করায় খেপে গিয়েছিল রোহিত। মারামারি বেধে যায় যায়, এমন পরিস্থিতিতে রোহিতের সতীর্থরা ভয়ে চম্পট দিয়েছিল। কিন্তু কিশোর রোহিত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিল। রাগ দমাতে না পেরে দুই ঘা বসিয়েও দিয়েছিল প্রতিপক্ষকে!
ভারতের সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’–এর সঙ্গে খোলামেলা আলাপচারিতায় সেসব দিনের কথা স্মরণ করেছেন রোহিত শর্মা, ‘মনে আছে ওদের (প্রতিপক্ষ) বলেছিলাম, তোমরা যা করলে সেটা কিন্তু ভালো হলো না। তখন অনেক কারণেই মারামারিতে জড়িয়ে পড়তাম।’ তবে ভয়ও ছিল। মারামারি করে গা হাত-পা রক্তাক্ত করে বাসায় গেলে পরিবার তো আস্ত রাখবে না!
কলোনিতে খেলাধুলার সেই দিনগুলোয় সাইকেল ছাড়াও আকর্ষণীয় সব পুরস্কার ছিল কিশোরদের জন্য। স্বাভাবিকভাবে এসব পুরস্কারের প্রতি লোভ থেকেই যেকোনো মূল্যে ম্যাচ জিততে চাইত সবাই। সে ভাবনা থেকেই আসলে মাঝেমধ্যে প্রতারণার আশ্রয় নিতে হতো। রোহিত হাসতে হাসতে সেসব দিন স্মরণ করে বলেছেন, ‘কলোনির ম্যাচগুলোয় আকর্ষণীয় সব পুরস্কার ছিল। সাইকেল থেকে টাকাপয়সাও দেওয়া হতো। বয়স কম ছিল, তাই সবাই পুরস্কারগুলো জিততে চাইত। তবে সত্যি বলতে, প্রতারণার কোনো জায়গা নেই এবং যারা এসব করে তাদের সঙ্গে মারামারি করতেই হতো।’
১১ বছর বয়সী সেই রোহিতের বয়স এখন ৩৬। ছোটবেলার ক্রিকেটের প্রতি সে ভালোবাসা ধরে রেখেই ভারতীয় ক্রিকেটে কিংবদন্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু ভারতীয় ক্রিকেট কেন, সাদা বলে রোহিতের মতো ওপেনার ইতিহাসে আর ছিল কি না, তা নিয়ে গবেষণাও হতে পারে। হোটেলে সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় রোহিত কামরার এক কোণা দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে জায়গাটুকু দেখছেন (কামরায় কোণার জায়গাটুকু), আমাদের (ছোটবেলায়) কক্ষটা ছিল এমন। দাদা বিছানায় ঘুমাতেন। দাদি, চাচা-চাচির সঙ্গে আমি মেঝেতে ঘুমাতাম। আমার একটা বিষয় ছিল। পা দিয়ে কাউকে কিংবা কোনো কিছু স্পর্শ করতে না পারলে ঘুমাতে পারতাম না।’
আর্থিক অবস্থা অতটা ভালো না থাকায় রোহিতকে নিজের কাছে রেখেছিলেন তাঁর দাদা। রোহিতের মা-বাবাকে বলেছিলেন, তাঁর অন্য ভাইকে লালন-পালন করতে। রোহিতের ভাষায়, দাদা তাঁর বাবাকে বলেছিলেন, ‘রোহিতকে আমাদের কাছে ছেড়ে দাও। ছোটটাকে (রোহিতের ছোট ভাই) নিয়ে যাও। এভাবেই বোরিয়াভাল্লিতে থাকা শুরু হয় আমার। ভাইকে নিয়ে আমার মা-বাবা ডোম্বিভিলিতে থাকতেন (রোহিতের দাদার বাসা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে)। প্রায় ১০০ বর্গফুটের বাসায় আমরা আটজন থাকতাম।’
সেই রোহিত এখন স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকেন ওরলিতে, ৫ হাজার ৫০০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট বাসায়। কিন্তু ফেলে আসা সেসব দাহকালের দিন রোহিতকে জীবন সম্বন্ধে আরও গভীরভাবে বুঝতে শিখিয়েছে। ভারত জাতীয় ক্রিকেট দলের এই অধিনায়কের মুখেই শুনুন, ‘বাবা হিসেবে এখন আমি বুঝতে পারি সেই ব্যথাটা কেমন ছিল। আমাকে ছেড়ে আসা মা-বাবার জন্য কতটা কঠিন ছিল, সেটা এখন বুঝি। প্রথম সন্তান হলেও তাঁদের সিদ্ধান্তটি নিতে হয়েছিল। এমন না যে তাঁরা এটাই চেয়েছিলেন। দাদা ছিলেন পরিবারের হর্তাকর্তা। তাঁর সিদ্ধান্তই শেষ কথা।’ রোহিত এরপর হাসতে হাসতে বললেন, ‘আর্থিকভাবে আমরা সচ্ছল ছিলাম না। চাইলেই কোনো কিছু পাওয়া যেত না... ভবিষ্যতে তাকিয়ে দাদার সিদ্ধান্তটা যৌক্তিকই ছিল।’
ফেলে আসা সেসব দিন রোহিতকে মানুষ হিসেবে আরও পরিপূর্ণ করেছে। সে জন্যই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারলেন, ‘সেসব দিনগুলো পার করে এসেছি বলেই জানি জীবনে কোনো কিছুই সহজে অর্জন করা যায় না। কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, তা কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের ওই পথটা পাড়ি দেওয়ার জন্যই। সহজে কোনো কিছু পেয়ে গেলে তার গুরুত্বটা বোঝা যায় না। যে পথে আমি বড় হয়েছি, সেটাই সাহায্য করেছে। প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি।’
এক যুগ হয়ে গেল সর্বশেষ কোনো আইসিসির টুর্নামেন্ট জিতেছে ভারত। সেটি ২০১৩ সালে মহেন্দ্র সিং ধোনির হাত ধরে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। রোহিত কি পারবেন এবার বিশ্বকাপে সেই খরা ঘোচাতে? শুনুন তাঁর মুখেই, ‘হ্যাঁ, আমরা জিততে পারিনি। কিন্তু ঠিক আছে। আমি এমন মানুষ নই যে এসব নিয়ে বেশি বেশি ভেবে নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব যে সিদ্ধান্তই নিতে পারব না। ইংল্যান্ড কিন্তু ২০১৯ বিশ্বকাপ জিতেছে অনেক বছর পর। এমন হতেই পারে।’
তাহলে চ্যাম্পিয়ন হবে কোন দল? রোহিত এই প্রশ্নের উত্তরে যেন সামনের পায়ে ডিফেন্স করলেন, ‘এটার কোনো উত্তর নেই আমার কাছে। এটা এখন কীভাবে বলব? আমি শুধু আশা করতে পারি (ভারত) দল যেন ভালো অবস্থায় থাকে।’