লিটন দাস হয়তো সহ-অধিনায়ক শুধু টেস্ট দলেরই, কিন্তু ভেতরে নেতৃত্ববোধ থাকলে সেটা সীমানা মানবে কেন!
দুই শ রানের ইনিংসেও দু-চারটি ভুল শট থাকে, এক-দুটি ‘লাইফ’ও থাকা অস্বাভাবিক নয়। লিটনের কথাটা হয়তো ছিল সে রকমই একটা ‘ভুল শট’। গায়ানায় শেষ টি-টোয়েন্টিতে সাকিব আল হাসানকে দিয়ে মাত্র ২ ওভার বোলিং করানোর প্রসঙ্গে ম্যাচ শেষে সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর মন্তব্য ছিল, মাঠের সব সিদ্ধান্তই অধিনায়কের।
পরে ব্যাখ্যা দিয়ে এটাও বোঝাতে চেয়েছেন, অধিনায়কের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াটাই খেলোয়াড়ের কর্তব্য। সাকিবকে দিয়ে পুরো ৪ ওভার বোলিং না করানোর নিশ্চয়ই যুক্তি ছিল মাহমুদউল্লাহর। লিটন সেটি না-ই জানতে পারেন, কারণ টি-টোয়েন্টিতে তো তিনি আর ‘থিঙ্কট্যাংকে’র সদস্য নন। কিন্তু দলের মুখপাত্র হিসেবে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হলে এসব ক্ষেত্রে যেকোনো খেলোয়াড়কেই সতীর্থদের ঢাল হতে হয়। সেটি না হয়ে লিটন একটু মচমচে বিতর্কের উপকরণই বিলিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন।
সংবাদ সম্মেলনে এর আগেও অনেকবার নড়বড়ে লিটনকে দেখা গেছে। সহজ প্রশ্নও সহজভাবে নিতে না পেরে কখনো কখনো আক্রমণাত্মক হয়েছেন। সেসবের জন্য তাঁকে সমালোচনাবিদ্ধ করার কিছু নেই। তাঁর কাজ আগে ভালো খেলা, ভালো কথা বলতে পারলে সেটা বাড়তি গুণ। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে লিটনও নিশ্চয়ই সেই গুণটা অর্জন করবেন। করতেই হবে। চোখে দুরবিন লাগিয়েও বাংলাদেশ দলের ভবিষ্যৎ কান্ডারি হিসেবে মাত্র যে এক-দুজনকেই এখন দেখা যায়, লিটনের ছবিটাই সেখানে সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট।
শুধু সংবাদ সম্মেলনের লিটনকে দিয়ে মাঠের বাইরে তাঁর সব ভূমিকার পর্যালোচনা করতে গেলে লিটনের প্রতি অন্যায়ই করা হবে। মাঠের বাইরে ছয় মাস আগেও লিটন যেরকম ছিলেন, এখন কিন্তু তাতে বেশ ইতিবাচক পরিবর্তনের হাওয়া। বিসিবি এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ থেকেই টেস্টে তাঁকে সাকিবের ডেপুটি করেছে, তবে লিটনের মধ্যে সামনে এসে কথা বলার প্রবণতার শুরু আরও আগে থেকে। নির্দিষ্ট করে বললে, সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকেই তিনি একটু একটু খোলস ছেড়ে বের হচ্ছেন। দলের ভালো-মন্দে সরব হচ্ছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর চলাকালীন টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদই একদিন বলেছিলেন, লিটনের মধ্যে পরিবর্তন আসছে। এখন তাঁর একটা নিজস্ব মতামত তৈরি হচ্ছে।
সেই ইতিবাচক প্রবণতা লিটন ধরে রেখেছেন চলতি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজেও। চেষ্টা করছেন নিজেকে বদলে পরের ধাপে যেতে। তিনি হয়তো সহ-অধিনায়ক শুধু টেস্ট দলেরই, কিন্তু ভেতরে নেতৃত্ববোধ থাকলে সেটা সীমানা মানবে কেন! দলের প্রয়োজনের মুহূর্তে নিজের মতটা অবচেতনেই চলে আসবে মুখে। ‘বড় ভাই’য়েরা কে কী ভাবেন ভেবে বাংলাদেশ দলে জুনিয়র ক্রিকেটাররা মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক সময় অদৃশ্য একটা বাধা হয়তো অনুভব করেন, কিন্তু সেটা এমন নয় যে কেউ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবেন না।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে তামিম ইকবালের সঙ্গে নাজমুল হোসেনকে দিয়ে ইনিংস শুরু করার চিন্তাটা যেমন অধিনায়ক তামিমকে জানিয়েছেন লিটন। প্রতিপক্ষের দুই বাঁহাতি স্পিনারের কথা ভেবেই তাঁর অমন চিন্তা। ওপেনিংয়ে দুই বাঁহাতি নামলে ক্যারিবীয় বাঁহাতি স্পিনারদের ধার যেমন একটু কম অনুভূত হবে, ওই ওভারগুলো বাঁহাতি ওপেনাররা পার করে দিতে পারলে পরে লিটন নিজেও ব্যাটিংয়ে নেমে থাকবেন স্বচ্ছন্দ।
বাঁহাতি পেসার এড়ানোর চিন্তায় লিটনের ব্যক্তিগত স্বার্থ হয়তো ছিল, কিন্তু সেটাও দলের কথা ভেবেই। তাঁর এমন ভাবনাকে সে কারণেই স্বাগত জানিয়েছেন তামিম। ম্যাচ শেষে লিটনকে প্রশংসায় ভাসিয়ে অধিনায়ক বলেছেন, চিন্তাটা ছিল অসাধারণ।
লিটন আস্তে আস্তে ব্যতিক্রম হয়ে উঠলেও বাংলাদেশের এই দলটায় কথা বলার লোকের বড় অভাব। যাঁরা পাঁচ-ছয় বছর ক্রিকেট খেলে ফেলেছেন, তাঁরাও বেশির ভাগ চাঁদের মতো। নিজের কোনো আলো নেই, নিজের কোনো মত নেই। দলের ‘বড় ভাই’দের মত আর আলোতেই তাঁরা আলোকিত। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকুর রহিমরা যখন ক্যারিয়ারের প্রায় সায়াহ্নে এসে পড়েছেন, তখন পরের প্রজন্মের বাংলাদেশ দল গড়তে লিটন-মিরাজদের মতো ক্রিকেটারদের মধ্যে নিজস্ব মতামত গড়ে ওঠাটা জরুরি, সেটি নিঃসংকোচে প্রকাশ করতে পারা আরও বেশি জরুরি।
খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে থাকা লিটন সেই পথটাই দেখাচ্ছেন। তবে কোনো পথেই একা বেশি দূর হাঁটা কঠিন। যুগ বদলানোর পথে লিটনের সঙ্গী হতে হবে আরও অনেককেই।