তাঁর চুক্তি শেষ হবে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় চ্যাম্পিয়নস ট্রফি শেষে, অর্থাৎ আর মাত্র ছয় মাস পরই। ফারুক আহমেদ নতুন বোর্ড সভাপতি হওয়ায় ধরেই নেওয়া হচ্ছে, বাংলাদেশ দলের কোচ হিসেবে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের চুক্তি এরপর আর নবায়ন করবে না বিসিবি। শ্রীলঙ্কান এই কোচ চুক্তির বাকি ছয় মাস শেষ করে যেতে পারবেন কি না, সেটাই বরং প্রশ্ন।
বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ফারুক আহমেদ পরিষ্কার করে দিয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে হাথুরুসিংহের ব্যাপারে তিনি আগের অবস্থানে অটল। আগের অবস্থান কী, সেটাও কারও অজানা থাকার কথা নয়। ২০১৬ সালে দল নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি তুলে প্রধান নির্বাচকের পদ থেকে সরে যান ফারুক। এরপর তিনি যতবারই বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে কথা বলেছেন, প্রায় ততবারই হাথুরুসিংহের সমালোচনা করেছেন। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে এই শ্রীলঙ্কানের অযোগ্যতা তুলে ধরেছেন।
কিন্তু বিসিবির বাইরে থেকে কথা বলা একরকম, বিসিবির অংশ হয়ে, বিশেষ করে বিসিবি প্রধানের চেয়ারে বসে কথা বলা আরেক রকম। দায়িত্ব পাওয়ার পর ২১ আগস্টের সংবাদ সম্মলনে ফারুক তাই এ–ও বলেছেন, হাথুরুসিংহেকে বাদ দেওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে বিসিবির চুক্তিতে কী আছে, সেটা দেখবেন। কথা বলবেন অন্য পরিচালকদের সঙ্গে।
তবে এমন নয় যে ফারুক আহমেদ বোর্ড সভাপতি হয়ে আসার পরই হঠাৎ করে হাথুরুসিংহের বিদায় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিসিবির বাইরে তো এই দাবি অনেক আগে থেকেই আছে এবং জানা যাচ্ছে, নাজমুল হাসানের বোর্ডেও সেটা বেশ জোরালোভাবেই ছিল। তবে আলোচনাটা চাপা পড়ে গিয়েছিল সাবেক সভাপতির ইচ্ছার নিচে।
সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর থেকে নাজমুল হাসানের বোর্ডের বলতে গেলে সব পরিচালকই চেয়েছেন, প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ দিয়ে হলেও হাথুরুসিংহের চুক্তি বাতিল করা হোক। বর্তমানে আয়কর ছাড়াই হাথুরুসিংহে মাসে পান ২৫ হাজার ডলার, ৩০ শতাংশ করসহ (বিসিবি প্রদান করে) তাঁর মাসিক বেতন দাঁড়ায় ৩৫ হাজার ডলারের ওপরে। চুক্তি অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বিদায় করলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিন মাসের বেতন দিতে হবে হাথুরুসিংহেকে।
বিসিবির পরিচালকেরা এই ক্ষতি মেনেও হাথুরুসিংহেকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন মূলত খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাঁর রুঢ় আচরণ, দলে অগ্রহণযোগ্যতা এবং কোচিং স্টাফের অন্য সদস্যদের সঙ্গে দূরত্বের কারণে। ২০২৩ বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে ঘটা কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা জোরালো ভূমিকা রেখেছে পরিচালকদের এমন ইচ্ছায়।
তারপরও হাথুরুসিংহে বাংলাদেশ দলের কোচ থেকে গেছেন নাজমুল হাসান তাঁর পক্ষে থাকায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিসিবি পরিচালক বলেছেন, ‘২০২৩ বিশ্বকাপের পর হাথুরুসিংহে ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত দল নিয়ে কিছু পরিকল্পনা দিয়েছিলেন বোর্ডকে। জাতীয় দল নিয়ে এমন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অতীতে কোনো কোচ দেননি। সভাপতি সে কারণেই চেয়েছেন হাথুরুসিংহে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত থাকুন। তা ছাড়া সভাপতি মনে করতেন, চুক্তির মাঝপথে কোচ বিদায় খারাপ উদাহরণ হবে।’
নাজমুল হাসানের সেই ছায়া এখন আর নেই হাথুরুসিংহের ওপর। আর নতুন বোর্ড সভাপতি নিজেই যখন স্পষ্ট বলে দেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি আর হাথুরুসিংহেকে চান না, বাংলাদেশের সংস্কৃতি মেনে সেটা প্রভাবিত করতে পারে অন্য পরিচালকদেরও। তা ছাড়া পরিচালকদের মধ্যে তো হাথুরুসিংহের পক্ষে ভোট নেই আগে থেকেই!
অবশ্য চলতি পাকিস্তান সিরিজ একটা ‘লাইফ লাইন’ হলেও হতে পারে হাথুরুসিংহের জন্য। রাওয়ালপিন্ডির প্রথম টেস্টে দারুণ ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ দল। প্রথম ইনিংসে ৫৬৫ রান করে ১১৭ রানের লিড নিয়ে চতুর্থ দিন শেষে নাজমুল হোসেনের দল এগিয়ে ৯৪ রানে। মুশফিকের ১৯১, সাদমানের ৯৩, মিরাজের ৭৭–এর সঙ্গে মুমিনুল ও লিটনের দুটো ফিফটি যেন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হতাশা ভুলিয়ে দেওয়ারই উপলক্ষ তৈরি করল পাকিস্তানে।
সিরিজের পরের টেস্টে পারফরম্যান্সের এই ধারাবাহিকতা থাকলে ভাগ্য বদলাতেও পারে হাথুরুসিংহের। টেস্টে অনেক দিন পর এমন পারফরম্যান্সে পাকিস্তানে যাওয়ার আগে ক্রিকেটারদের টানা দুই মাসের কঠোর অনুশীলনের যেমন ভূমিকা আছে, কৃতিত্বের কিছুটা ভাগ পাবে হাথুরুসিংহের পরিকল্পনাও। পাকিস্তান সিরিজসহ এ বছরের আটটি টেস্ট সামনে রেখে লাল বলে দীর্ঘ সময় অনুশীলনের পরিকল্পনায় ভূমিকা ছিল কোচেরও। পাকিস্তান সিরিজ ভালো কাটা মানে উন্নতির লক্ষণ ফুটে ওঠা। হাথুরুসিংহেকে এখনই বিদায় করার শক্ত যুক্তি তখন থাকবে না বোর্ডের হাতে। দিন শেষে ফলাফলটাই তো আসল!
হাথুরুসিংহের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পাকিস্তান সফরে থাকা দলের ক্রিকেটার, টিম ম্যানেজমেন্ট সদস্য এবং প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেনের মতামতেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে বলে জানা গেছে। অবশ্য মুদ্রার উল্টো পিঠে কী আছে, তা এখনই বলার উপায় নেই। উল্টো পিঠ বলতে হাথুরুসিংহে নিজে কী ভাবছেন, সেটা।
বিসিবিতে পটপরিবর্তনের পর হাথুরুসিংহে বলেছেন, বোর্ড চাইলে তিনি থাকবেন। তবে ফারুক আহমেদের আগের অবস্থানে থাকার ঘোষণায় মিশে থাকা বার্তাটা নিশ্চয়ই বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। সঙ্গে দুজনের মধ্যে থাকা অতীতের দূরত্ব মিলিয়ে বাংলাদেশ দলের কোচ হিসেবে হাথুরুসিংহে নিজে কতটা স্বচ্ছন্দে থাকবেন, সেটাও যথেষ্ট কৌতূহল জাগানিয়া বিষয়।