নাসির হোসেন
নাসির হোসেন

শিস দিতে দিতেই কি শেষ হয়ে গেলেন নাসির

তখন কথাটা বলা হতো বীরত্বগাথার বর্ণনায়। শিস দিতে দিতে ব্যাটিংয়ে গিয়ে শেষ করে দিয়ে আসতেন বোলারদের। কি টেস্ট, কি ওয়ানডে, কি টি–টোয়েন্টি—নাসির হোসেনের ব্যাট মাঠে গিয়েই তলোয়ার। দলের অবস্থা শোচনীয়, অথচ ব্যাটিংয়ে নামা নাসিরের মুখে দুষ্টুমির হাসি। চেহারায় দুশ্চিন্তার লেশমাত্র নেই। ব্যাট হাতে উইকেটে তো নয়, যেন মঞ্চে দাঁড়াতেন রকস্টার! ঠোঁটে বেজে উঠত শিস।

ফ্ল্যাশব্যাকে একটু দূরবর্তী অতীতের বর্ণনাই দিতে হচ্ছে। মানে এখন থেকে ৮–৯ বছর আগের। কারণ, বেশ কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নাসির মোটামুটি বিস্মৃত হওয়ার পথে। অথচ একটা সময়ে তিন সংস্করণের ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ তো বটেই, সুন্দর ভবিষ্যতের আলো জ্বালিয়ে জ্বলজ্বলে এক তারকাও হয়ে উঠেছিলেন নাসির।

‘ফিনিশার’ শব্দটাই তাঁর নামের সঙ্গে বেশি যেত। কারণ, নাসির খেলা শেষ করে দিয়ে আসতে পারতেন। সাত–আটে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং, প্রয়োজনে অফ স্পিনে ব্রেক থ্রু, আর ফিল্ডিং যেটা করতেন; ওই রকম চোখ আটকে যাওয়া ক্ষিপ্রতার প্রতিযোগিতায় তখন বাংলাদেশ দলে একমাত্র সাব্বির রহমানই তুলনায় আসতেন তাঁর সঙ্গে।

সাহসী ক্রিকেটার হিসেবে ঘরোয়ায় খ্যাতি পেয়েছিলেন নাসির

ঘরোয়া ক্রিকেটেও নাসির ছিলেন সাহসী ক্রিকেটারের প্রতিচ্ছবি। সেদিকে ফিরে তাকালে খুব দূরে যেতে হবে না অবশ্য। বিপিএলের সর্বশেষ আসরেই ঢাকা ডমিনেটরসের হয়ে ১২ ম্যাচ খেলে ৪৫.৭৫ গড়ে রান করেছিলেন ৩৬৬। বল হাতে ১৪.৬ গড়ে ১৬ উইকেট।

সেই নাসিরকে নিয়ে সর্বশেষ খবরটি একদমই ভালো নয়। দুর্নীতির অভিযোগে ছয় মাসের স্থগিতাদেশসহ সব ধরনের ক্রিকেট থেকে আইসিসি আজ তাঁকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আনা আমিরাত ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতিবিরোধী ধারা ভঙ্গের তিনটি অভিযোগ নাসির মেনে নিয়েছেন বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে আইসিসি।

নাসির নিজেও প্রথম আলোকে মুঠোফোনে দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমি আইসিসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো আপিলে যাইনি। সব অভিযোগ মেনে নিয়েছি। কারণ, আপিলে গেলে যে আমি যথাযথ জায়গা থেকে আইনগত কোনো সহায়তা পাব, সে নিশ্চয়তা ছিল না।’

৩২ বছর বয়সী নাসিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনটি। সারমর্ম করলে যেটা দাঁড়ায়, ২০২১ সালে আবুধাবি টি–টেন লিগে খেলতে গিয়ে ‘উপহার’ হিসেবে পাওয়া ৭৫০ মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের একটি আইফোন–১২-এর রসিদ তিনি সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি দমন কর্মকর্তাদের দেখাতে পারেননি। নতুন এই ফোনের মাধ্যমে পাওয়া দুর্নীতির প্রস্তাবের তথ্যও নাকি নাসির তাঁদের জানাননি। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহযোগিতা না করার অভিযোগও আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে।

জাতীয় দলের দিনগুলি বহু আগেই পেছনে ফেলে এসেছেন নাসির

আইসিসির অভিযোগ ছিল নাসিরসহ আটজনের বিরুদ্ধে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার একমাত্র বাংলাদেশের নাসিরই ছিলেন। আইসিসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও শুধু তাঁকেই নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। সাকিব আল হাসান ও মোহাম্মদ আশরাফুলের পর নাসির বাংলাদেশের তৃতীয় ক্রিকেটার, যিনি ক্রিকেট দুর্নীতির কারণে আইসিসির বহিষ্কারাদেশ পেলেন।

এ নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নাসির খুব বেশি কিছু বলবেন না স্বাভাবিক। তাতে শৃঙ্খলাভঙ্গের আরও তির ছুটে আসতে পারে তাঁর দিকে। তবে বাংলাদেশের হয়ে ১৯টি টেস্ট, ৬৫টি ওয়ানডে ও ৩১টি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা এই ক্রিকেটার নাকি ঘনিষ্ঠ মহলে দাবি করেছেন, আলোচিত মুঠোফোনটি তিনি উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন তাঁর ফ্র্যাঞ্চাইজি পুনে ডেভিলসের কাছ থেকে। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছ থেকে পাওয়া মুঠোফোনের তথ্যও যে দুর্নীতি দমন কর্মকর্তাদের জানাতে হবে, সেটি জানা ছিল না তাঁর।

এই ফোনের মাধ্যমে পাওয়া দুর্নীতির প্রস্তাব গোপন করা এবং তদন্তে সহযোগিতা না করার বিষয়েও নাসিরের একটা ব্যাখ্যা জানা গেছে তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে। সেটি হলো, টুর্নামেন্ট শেষ করে ফেরার সময় নাসিরসহ সব ক্রিকেটারকে ‘উপহার’ দেওয়া ফোনই নাকি রেখে দিয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি। রেখে দিয়েছিল নাসিরের ব্যক্তিগত ফোনও, যেটি তিনি ফেরত পান ছয় মাস পর।

ব্যাখ্যার বাকি অংশটা অবশ্য বাস্তবতার সঙ্গে মেলানো কঠিন। কেন, তা যে কেউই বুঝবেন। আইসিসি নাসিরের কাছে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল ই–মেইলে। কিন্তু নাসির নাকি বলেছেন, যে ফোনে তিনি ই–মেইল ব্যবহার করতেন, সেটি দিয়ে এসেছিলেন ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছে। ই–মেইল ব্যবহারের খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না বলে এর মধ্যে অন্য কোথাও থেকে আর নিজের মেইল অ্যাকাউন্টে ঢোকা হয়নি তাঁর। আইসিসির পাঠানো মেইলের কথাও তাই নাসিরের কাছে থেকে গিয়েছিল অজানা, যে কারণে তিনি আইসিসিকে সহযোগিতাও করতে পারেননি।

জাতীয় দলে মজার চরিত্র হিসেবেও আলাদা পরিচিতি ছিল নাসিরের

শাস্তি ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় নাসির এসব নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি। আইসিসির শাস্তি মেনে তিনি এখন অপেক্ষা করবেন শাস্তির মেয়াদ শেষে মাঠে ফেরার। সেটি আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া দুই ক্রিকেটেই। গত সেপ্টেম্বরে নাসিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরই বিসিবি জানিয়ে দিয়েছিল, অভিযোগ থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটের কোনো টুর্নামেন্টেই খেলতে পারবেন না।

কিন্তু শাস্তির মেয়াদ শেষেও কি সেই নাসিরকে আর দেখা যাবে মাঠে? প্রশ্নটা করতেই হচ্ছে, কারণ যে আলো জ্বেলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আবির্ভাব হয়েছিল রংপুরের এই ক্রিকেটারের, ফর্মহীনতা আর নানান বিতর্কের ঝাপটায় সেটি নিভু নিভু অবস্থায় চলে গিয়েছিল আরও আগেই। গত কয়েক বছরে নাসির ক্রিকেটের কারণে যত না খবর হয়েছেন, তাঁর চেয়ে বেশি আলোচিত এবং ‘ভাইরাল’ হয়েছেন বিতর্কিত সব ঘটনায়। ক্রিকেটে তিনি দৃশ্যমান হয়েছেন বেশি আমিরাত–যুক্তরাষ্ট্রের কিছু টি–টেন লিগে, যেগুলোর খেলোয়াড় তালিকায় কারও নাম থাকলেই ক্রিকেট–বিশ্ব তাঁর দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়।

নাসিরের ক্যারিয়ার কি আর কখনো আলোর মুখ দেখবে

আইসিসির নিষেধাজ্ঞার পর তো মনে হচ্ছে ক্রিকেটার নাসিরের ‘কফিনে’ শেষ পেরেকটাই বুঝি ঠোকা হয়ে গেল এবার। সেখান থেকে আবারও শিস বাজাতে বাজাতে তাঁর মাঠে ফেরাটা কঠিন। জীবনটাকে হালকা চালে দেখা সাহসী ক্রিকেটার নাসির শিস দিতে দিতেই বুঝি শেষ হয়ে গেলেন!