প্রথম দিন শেষে, বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৮৫ ওভারে ৩১০/৯
গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে বসা গোটা পাঁচ-ছয় নিউজিল্যান্ডের দর্শক নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন। সিলেটের কোথায় যেন পিকনিক করতে এসে কয়েকজন স্কুলছাত্রী কিছু সময়ের জন্য খেলা দেখতে মাঠে এসে নিশ্চয়ই মন খারাপ করে ফিরে গেছে। এ রকম ব্যাটিং উইকেটে, এ রকম চমৎকার রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে কেন বাংলাদেশের অমন ব্যাটিং!
সব কেনর যেমন উত্তর হয় না, এই ‘কেন’রও নেই। এখানে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আউট করার যে কাজটা নিউজিল্যান্ডের বোলারদের কষ্ট করে করার কথা, ব্যাটসম্যানরাই যখন বাজে শট খেলে বোলারদের অর্ধেক কাজ কমিয়ে দিয়ে সেটিকে উল্টো সহজ বানিয়ে দেন; এর আপনি কী ব্যাখ্যা দেবেন? সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে প্রথম টেস্টের প্রথম দিনটা তাই কাটল বাংলাদেশের অদ্ভুত ব্যাটিংয়ের কার্যকারণ খুঁজতে খুঁজতে।
খেলা যদি না–ও দেখে থাকেন, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের রানের তালিকায় একবার চোখ বোলালেই কিছুটা বুঝে নিতে পারবেন, কী ঘটেছে আজ মাঠে। বাড়তি তথ্য হিসেবে কিছু আউটের বর্ণনা জানতে পারলে তো আরও ভালো।
শতকি-সুবাস পেতে পেতে ওপেনার মাহমুদুল হাসান ইশ সোধির বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছেন ৮৬ রান করে। অথচ এমন ব্যাটিং–সহায়ক উইকেটে ৮৬ রানে পৌঁছে যাওয়া একজন ব্যাটসম্যান শুধু বড় কিছুরই কল্পনা করতে পারেন। মাহমুদুলও নিশ্চয়ই করেছিলেন। শুধু কল্পনাকে বাস্তব করতে যেটা করা দরকার, সেটা করেননি। অবশ্য মাহমুদুল তো আউট হলেন চা-বিরতির কিছু আগে। তারও আগে প্রথম সেশনে ১০৪ রানে যে ২ উইকেট পড়ল, সেটাও কি মেনে নেওয়ার মতো ছিল!
ওপেনার জাকির হাসান বাঁহাতি স্পিনার এজাজ প্যাটেলের নিচু হয়ে যাওয়া বলে বোল্ড হলেন কাট করতে গিয়ে। ওই বলে তিনি কাট কেন করবেন! অধিনায়ক নাজমুল হোসেনই–বা কী করলেন! অফ স্পিনার গ্লেন ফিলিপসের ফুলটস তুলে মারতে গিয়ে লং অনে দিলেন সহজ ক্যাচ। ৩৯ রানে জাকিরের আউটে ওপেনিং জুটি ভাঙার পর মাহমুদুলের সঙ্গে জুটিটা জমে উঠেছিল নাজমুলের। ৫৩ রানের জুটি জমিয়ে তুলেছিলেন আসলে অধিনায়ক নাজমুলই।
৩৭ রান করেছেন ৩৫ বলে, এটুকু তথ্যই যথেষ্ট টেস্টেও তাঁর ওয়ানডে মেজাজের ব্যাটিংটাকে বোঝাতে। বাড়তি তথ্য, ওই সময়ের মধ্যেই তিনি মেরেছেন ৩ ছক্কা আর ২ চার। টি-টোয়েন্টির ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়ে টেস্ট ক্রিকেটের বইটাই এখন এমন যে ধরে খেলার অধ্যায় সেখানে আর নেই। বাজে বল হলে মেরে দাও—এটাই কথা। কিন্তু এই নীতিও যে একটু দেখেশুনে এবং কখনো কখনো উইকেটে সময়ক্ষেপণ করে মানা উচিত, তার প্রমাণ নাজমুলের আউট এবং পরে মুশফিকুর রহিমের আউটও। এজাজ প্যাটেলকে সামনে এগিয়ে এসে মেরেছিলেন মুশফিক। কিন্তু শটে জোর ছিল না, যথেষ্ট উচ্চতাও নেয়নি যে ফিল্ডারের মাথা পেরিয়ে যাবে। মিড অফে বুকের ওপর আসা ও রকম সহজ ক্যাচ নিতে কোনো ভুলই করার কথা নয় কেইন উইলিয়ামসনের।
ফিলিপসের বলে মুমিনুলের কট বিহাইন্ড হওয়া বলটায় কাট করার মতো যথেষ্ট বাউন্স ছিল না, কিন্তু তিন আউট হলেন তা–ই করে। ৭৮ বলে ৩৭ রান, তার মানে তো উইকেটে থিতু হয়ে গিয়েছিলেন মুমিনুল। আর এ রকম উইকেটে থিতু হওয়া মানে তাঁর মতো অভিজ্ঞ একজন ব্যাটসম্যানের কাছে বড় ইনিংসের প্রত্যাশা জাগা। প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড বলে মুমিনুলের কাছে প্রত্যাশাটা আরও বেশি ছিল। কিউইদের বিপক্ষে এর আগে ৭ টেস্টের ১৪ ইনিংসে তিনি তিন অঙ্ক ছুঁয়েছেন দুবার ও অর্ধশত দুটি। আজও সে রকম কিছুর সুযোগ ও সম্ভাবনা জাগলেও মুমিনুল ফিরলেন অতৃপ্তি নিয়ে।
অভিষেক টেস্ট খেলতে নেমে ২৪ রান করা শাহাদাত হোসেনকে না হয় ছেড়েই দিন। লেট মিডল অর্ডারে মেহেদী হাসান মিরাজ, নুরুল হাসানরাও থেমে গেছেন ২০-এর ঘরে থেকে। অথচ প্রথম দিনে সিলেটের উইকেটের যে আচরণ দেখা গেছে, তাতে এই উইকেট অন্তত টেস্টের তৃতীয় দিন পর্যন্তও ব্যাটিং–সহায়ক থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। অথচ মাত্র একটি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস নিয়ে বাংলাদেশ প্রথম দিনেই ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলল। বাকি ১ উইকেটে ৩১০ রান আর কতটুকুই–বা বাড়বে! আর বাড়লেও উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এসে আরও বড় কিছু করার সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করার হতাশা তাতে কমবে না।
বলতে পারেন বাংলাদেশ খারাপ করল কী! ৩০০ রান তো হয়েছে। হ্যাঁ, ‘তিন শ’ শুনতে হয়তো খারাপ লাগে না, তবে যে উইকেটে আগে ব্যাট করলে ৪৫০ রানের দেখা সহজেই পাওয়ার কথা, ব্যাটসম্যানদের অনেকে সে রকম ভালো শুরুও করেছিলেন, সেখানেই প্রায় অলআউট হয়ে গিয়ে দিন শেষ করা একটা প্রশ্নই আসলে মনে আনে—তাহলে কোন উইকেটে রান করবে বাংলাদেশ?