সেন্ট ভিনসেন্ট থেকে যে বিমানে উড়ে বাংলাদেশ দল অ্যান্টিগায় এসেছে, সেটির গায়ে লেখা ‘ফ্লাই অলওয়েজ’। বাহ্, দারুণ তো! তা এমন শুভকামনা কি শুধু বাংলাদেশ দলকেই, নাকি সুপার এইটে ওঠা সব দলের জন্যই কমন?
কোনোটাই নয়। বিশ্বকাপ ফুটবলে যেমন টিম বাসে সেই দলের স্লোগান লেখা থাকে, বিমানের গায়ে লেখাটা এমন কিছু নয়। এটা একটা এয়ারলাইনসের নাম। বিশ্বকাপে আইসিসি যাদের কাছ থেকে বিমান ভাড়া নিয়েছে।
এদিন অবশ্য ফ্লাই অলওয়েজ কথাটা একটু অন্য অর্থ নিয়ে দেখা দিল। সোমবার দুপুরে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা একে একে বিমানে উঠছেন। সেন্ট ভিনসেন্ট বিমানবন্দরের ডিপারচার লাউঞ্জ থেকে দেখা যাচ্ছে বিমানটা। বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা বাংলাদেশের টিভি সাংবাদিকদের কেউ কেউ যেটিকে পশ্চাৎপটে রেখে মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করছেন। অবধারিতভাবেই ফ্লাই অলওয়েজ কথাটার তাৎপর্য চলে আসছে তাঁদের কথায়। বাংলাদেশ দল তো সব সময়ই উড়তে চায়।
এখন আরও বেশি উড়তে চাইছে। বিশ্বকাপে ভেন্যু থেকে ভেন্যুতে চার্টার্ড প্লেনেই যাচ্ছে দলগুলো। এর আগে বাংলাদেশ দলের সব কটি বিমানই ছিল গ্লোবালএক্সের। এই প্রথম ফ্লাই অলওয়েজ। বাংলাদেশ দলের সুপার এইটে যাত্রার সঙ্গে যেটিকে মিলিয়ে নিতেই পারেন। বাংলাদেশ দলও তা মিলিয়ে নিয়েছে। বিমানে ওঠার সময় লেখাটা চোখে পড়েছে অনেকেরই। ফ্লাই অলওয়েজ কথাটাকে দলের জন্য শুভকামনা বলেই ধরে নিয়েছে তারা।
উড়তে থাকা কাউকেই সব সময় উড়তে থাকার কথা বলা যায়। তা বাংলাদেশ দল তো এখন উড়ছেই। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠাটাকে ইতিহাস বলা যাবে না। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টির প্রথম আসরেই তো তা উঠেছে বাংলাদেশ। তবে সেবার পরের রাউন্ডে যাওয়ার কড়ি ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সবেধন নীলমণি একটিমাত্র জয়। সেটি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচেই। বিশ্বাস করা কঠিনই, পরের ছয়টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে বাংলাদেশ আর একটাও ম্যাচ জিততে পারেনি। সেখানে এবার এরই মধ্যে তিনটি জয়। সেদিন নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামে মাহমুদউল্লাহর ছয়টা হয়ে গেলে তো চারে চার হয়ে যায়!
জয়ের সংখ্যায় এরই মধ্যে এটি বাংলাদেশের সেরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেটিও কি স্নায়ুক্ষয়ী চারটি ম্যাচ খেলে! দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে যেমন একটু এদিক-ওদিক হলেই বাংলাদেশ জিতে যেত, বাকি তিন ম্যাচে আবার উল্টোটাও হতে পারত। তিনটি ম্যাচই তো বাংলাদেশের ফিরে আসার দারুণ গল্প। ‘ক্যারেক্টার শো’ করার যে মন্ত্রটা জপ করে সব দল, সেটির প্রদর্শনী।
ম্যাচে নিজেদের উজাড় করে দেওয়ার সংকল্প বোঝাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা আরেকটা কথা প্রায়ই বলেন, ‘মাঠে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হবে।’ তা বাংলাদেশের তিনটি জয়ই ‘অনেক কষ্ট’ করে। একদিক থেকে যা উপকারই করেছে।
যেকোনো পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ম্যাচ জেতা সম্ভব, এই বিশ্বাসটাকে এখন বলতে পারেন বাংলাদেশ দলের আবহসংগীত। বিশেষ করে নেপালের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে কম রানের পুঁজি নিয়েও জয়ের পর কোনো কিছুকেই আর অসম্ভব মনে হচ্ছে না।
সেন্ট ভিনসেন্ট বিমানবন্দরে দেখা হতেই অধিনায়ক নাজমুল হোসেন যেমন মনে করিয়ে দিলেন, ‘কী, বলেছিলাম না?’ বলেছিলেন তো অনেক কিছুই। বিশ্বকাপে আসার আগে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে দলের শক্তি-দুর্বলতা, বিশ্বকাপে তাঁর ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বপ্ন...। তা কোনটির কথা বলছেন নাজমুল? নেপালের বিপক্ষে ম্যাচের স্মৃতি টাটকা বলে ধরে নেওয়া যায়, দলের বোলিংয়ের ওপর তাঁর অসীম আস্থার কথাই হয়তো হবে।
তানজিম হাসান এমন অগ্নিমূর্তিতে দেখা দেওয়ার তো সেই আস্থা আরও বাড়ারই কথা।
শরীফুল চোট না পেলে যাঁর হয়তো খেলাই হয় না, সেই তানজিম এখন বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের নতুন বিজ্ঞাপন।
এতটাই যে, সোমবার সেন্ট ভিনসেন্ট বিমানবন্দরে ডেল স্টেইন পর্যন্ত তাঁর মুগ্ধতার কথা বলতে গিয়ে দারুণ সব বিশেষণ ব্যবহার করে ফেললেন। দক্ষিণ আফ্রিকান ফাস্ট বোলার নিজে ছিলেন অহিংস নীতির অনুসারী। ব্যাটসম্যানদের গালি দেওয়া দূরে থাক, কখনো কুশল বিনিময় করতে কিছু বলেছেন কি না সন্দেহ; তানজিম যেখানে নেপালের অধিনায়কের সঙ্গে তুমুল সংঘাতে জড়িয়ে গেছেন। ডেল স্টেইনের এটাও খুব ভালো লেগেছে।
তা ‘কী, বলেছিলাম না...’ কথাটায় কি বোলিং বোঝালেন নাজমুল, নাকি ওই কথাটা? যেটি বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিলেন। বিশ্বকাপের আগে সমালোচনা আর ব্যঙ্গবিদ্রুপে বাংলাদেশ দলের এমন অবস্থা যে বড় কিছু করার স্বপ্নের কথা বলতেও ভয় অধিনায়কের! ‘আমার মনে যা আছে, তা যদি বলি, তাহলে এ নিয়ে আবার ট্রল শুরু হয়ে যাবে’—এটা বলে মনের কথা তাই মনেই রেখে দিয়েছিলেন।
তারপরও তাঁর চোখে বিশ্বকাপের ফেবারিট কে, এই প্রশ্নের উত্তরে বলে দিয়েছিলেন, ‘প্রথমে তো আমি বাংলাদেশকেই ফেবারিট মনে করব। আবার এটা বললে দেখা যাবে...,’ কথাটা আর শেষ করেননি।
বাংলাদেশ আসলেই এই বিশ্বকাপ জিততে পারে বলে বিশ্বাস করেন কি না প্রশ্ন করায় মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ১৯৮৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। সেবার কি কেউ ভেবেছিল, ভারত চ্যাম্পিয়ন হবে? তাঁর চোখে সম্ভাব্য চার সেমিফাইনালিস্টের নাম বলতে বলায় তিনটি দলের কথা বলে একটু হেসে বলেছিলেন, ‘একটা ফাঁকাই থাক।’
সেই শূন্যস্থান বাংলাদেশকে দিয়েই পূরণ করার যে স্বপ্ন ছিল নাজমুলের, তা এখন আরও উজ্জ্বল। সেমিফাইনালে অন্য যে তিন দলকে দেখেছিলেন, তাদের মধ্যে নিউজিল্যান্ড সুপার এইটেই উঠতে পারেনি। বাকি দুই দলের মধ্যে ইংল্যান্ডেরও জান বেরিয়ে গেছে উঠতে। নাজমুলের চোখে সম্ভাব্য সেমিফাইনালিস্ট তিন দলের অন্যটিই সুপার এইটের দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ—ভারত।
সেন্ট ভিনসেন্টে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জিতে সুপার এইটে এক পা দিয়ে রাখার পর নাজমুলকে ওই সাক্ষাৎকারের কথা মনে করিয়ে দেওয়ায় তাঁর মুখে হাসি, ‘দেখেন না, কী হয়! আমার মনে তো হচ্ছে হয়ে যাবে।’
মাঠের বাইরে নেতৃত্ব এবং মাঠের অধিনায়কত্ব মিলিয়ে নাজমুলের এই বিশ্বকাপে দশে দশ পাওয়ার মতো পারফরম্যান্স। সমস্যা বলতে ব্যাটে রান নেই।
এই বিশ্বকাপে টপ অর্ডার নিয়ে দুর্ভাবনায় বাংলাদেশ দল অবশ্য মোটেই নিঃসঙ্গ নয়। ভারতের অমন প্রতাপশালী টপ অর্ডারও ভুগছে। দক্ষিণ আফ্রিকারও ব্যাটিং শুরু হচ্ছে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর। যেসব দেখে একটু সান্ত্বনা তো মিলছেই। সঙ্গে এটাকে ইতিবাচক কিছুতে রূপান্তরের চেষ্টা। টপ অর্ডার প্রায় না থাকার পরও যদি চার ম্যাচের তিনটিতে জেতা যায়, এই সমস্যা মিটে গেলে তো বাংলাদেশ হয়ে যাবে আরও দুর্দান্ত।
সুপার এইটেই দেখা দেবে সেই দুর্দান্ত বাংলাদেশকে—আশা করতে দোষ কী!