এখনো মনে আছে, লন্ডনে সেদিন সকালটা শুরু হয়েছিল ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে। লর্ডসে বিশ্বকাপ ফাইনালও তাই শুরু হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের মিনিট ১৫ পর। কিন্তু বৃষ্টিভেজা শুরু যে ফাইনালের, সেটাই শেষ পর্যন্ত হয়ে যায় আগুনে এক ম্যাচ! বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সব ফাইনালের সেরা ফাইনাল।
ফাইনালে ইংল্যান্ড–নিউজিল্যান্ড। ভারতের আশার গুড়ে বালি ছিটিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপা ছুঁয়ে দেখতে ফাইনালে উঠে গিয়েছিল কিউইরা। তবে ভারত ফাইনালে উঠবে আশায় সেই ১৪ জুলাইয়ের ম্যাচের অনেক টিকিট যে আগেই কিনে রেখেছিলেন ভারতীয়রা! লর্ডসের গ্যালারিতে সেদিন না থেকেও তাই ছিল ভারত। তবে ঘরের মাঠের ফাইনালে স্বাভাবিকভাবেই বেশি ছিলেন ইংল্যান্ডের সমর্থকেরা। আর নিউজিল্যান্ডের উপস্থিতি চোখে পড়েছে কেবল মাঠেই, গ্যালারিতে তেমন নয়।
লর্ডসের গ্যালারি উপচে দর্শকদের ভিড় ছড়িয়ে পড়েছিল পাশের নার্সারি গ্রাউন্ডে। মাঠে ঢুকতে না পেরে জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখা দর্শকদের মধ্যেই উৎসবের রংটা বেশি দেখা গেছে। কিন্তু সেই উৎসবের শেষ দৃশ্যে যে ঘড়ির কাঁটা থেমে যাবে, স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনা ভর করবে লর্ডসের মাঠে, কারও কল্পনায়ও আসেনি সেটা।
দুই ফাইনালিস্ট ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের সাংবাদিকেরা ছাড়া ফাইনালে বিশ্বকাপ কাভার করতে যাওয়া বেশির ভাগ সাংবাদিককেই বসতে হয়েছিল ওভার ফ্লো জোনে। ফাইনালের দেশের সাংবাদিকেরা প্রেসবক্সে অগ্রাধিকার পাবেন, এটাই নিয়ম আইসিসির।
ওভার ফ্লো জোন গ্যালারিরই একটা অংশ। প্রেসবক্সের মতো কাচে ঘেরা নয় বলে দর্শকদের গগনবিদারী চিৎকার আর কানফাটানো হাততালির শব্দে লেখার পরিবেশ সেখানে থাকে না বললেই চলে। আবার এটাও ঠিক, মাঠের আবহ পেতে এর চেয়ে সেরা জায়গা হয় না। একেকটা চার হচ্ছে, ছয় হচ্ছে, আর ব্যাট–বলের মিলনের রোমাঞ্চকর শব্দ কানে আসছে। ক্রিকেট মাঠে এর চেয়ে মধুর সংগীত আর কী আছে! শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রেসবক্সগুলোয় অন্য সব সুযোগ–সুবিধা থাকলেও এই আনন্দটাই থাকে না।
লেখাটাকে গৌণ ধরে খেলা দেখাটাকেই মুখ্য ধরলে ওভার ফ্লো জোনে বসা মানে তাই সৌভাগ্যে বসতি। খেলাটার আরেকটু কাছাকাছি থাকা, এর ঝাঁজ আরেকটু বেশি গায়ে মাখা। দর্শকদের হইহুল্লোড়ে বিরক্ত না হয়ে সেদিকেও কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালে পাওয়া যায় লেখা প্রাণবন্ত করার অনেক মসলাও। আরও অনেক দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে আমরা বাংলাদেশের সাংবাদিকেরাও সেদিন সেই ‘সৌভাগ্যবান’দের দলে। অনেকটা গ্যালারিতে গাদাগাদি করে বসেই দেখলাম বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা ফাইনাল।
দুই দলই ২৪১ রান করার পর ৫০ ওভারের শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ টাই, খেলা গেল সুপার ওভারে। তবে গ্যালারি, ওভার ফ্লো জোন আর প্রেসবক্সের টান টান উত্তেজনাটাকে আরও চড়িয়ে দিয়ে সুপার ওভারে ঘটল না রোমাঞ্চের সমাপ্তি। ইংল্যান্ডের ১৫ রানের জবাবে নিউজিল্যান্ডও যে করে ফেলে ঠিক ১৫ রানই! কিন্তু একটা ম্যাচে আর কত নাটকীয়তা মেনে নেওয়া যায়? অনিশ্চয়তার কোন চূড়ায় তুলে নিয়ে শেষ হবে এই ম্যাচ? কীভাবে ঠিক হবে, কে হলো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন!
সেটা নির্ধারিত হলো আইসিসির অদ্ভুত এক নিয়মে। ২০১৯ বিশ্বকাপের নিয়ম অনুযায়ী মূল ম্যাচ ও সুপার ওভার মিলিয়ে বেশি বাউন্ডারি যারা মারবে, জিতবে তারাই এবং তারাই হবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। হিসাব করে দেখা গেল ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা মূল ম্যাচে ২২টি চার ও ২টি ছক্কা মেরেছেন, সুপার ওভারে মেরেছেন ২টি চার। অন্যদিকে মূল ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের চার ১৪টি, ছক্কা ২টি ও সুপার ওভারে চার মেরেছে ১টি। শুধু বাউন্ডারি সংখ্যায় এগিয়ে থেকেই বিশ্বকাপের ৪৪ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে গেল ইংল্যান্ড। সত্যি বলতে কি, ক্রিকেট–বিধাতাই যেন ঠিক করে রেখেছিলেন, ঘরের মাঠে সেবার আর ইংল্যান্ডকে নিরাশ করবেন না। লর্ডসের ব্যালকনি হবে বেন স্টোকস–জস বাটলারদের উৎসবের মঞ্চ।
নিউজিল্যান্ডের কাছে দৃশ্যটা বুক ভেঙে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর মনে হয়ে থাকবে। পরপর দুই বিশ্বকাপে ফাইনালে উঠেও বিশ্বকাপের সুবাস নিয়ে ঘরে ফিরতে হলে মনে হওয়া স্বাভাবিক, ভাগ্যই হয়তো তাদের সঙ্গে নেই। বিশেষ করে ২০১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালটা যে রকম অনিশ্চয়তার দোলায় দুলতে দুলতে শেষ হলো, তাতে কিউইদের ওই হার মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল অনেকেরই। তারা তো আসলে ইংল্যান্ডের কাছে হারেনি, হেরেছে ভাগ্যের কাছে। ইংল্যান্ডের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের উল্লাস ধ্বনির মধ্যেও তাই কিউই বেদনার বিউগল বুকে বেশ দাগ কেটে গিয়েছিল।
ম্যাচের শেষ ওভারেও নিউজিল্যান্ডের দিকেই ভারী ছিল সম্ভাবনার পাল্লা। শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ১৫ রান। ট্রেন্ট বোল্টের প্রথম দুই বলে রান নিতে পারেননি বেন স্টোকস। পরের বলে মিডউইকেট দিয়ে ছক্কা মারার পরও ৭ রান দরকার ছিল ইংল্যান্ডের। ফুলটস হয়ে আসা বোল্টের চতুর্থ বলটা মিডউইকেটে ঠেলেই আদিল রশিদের সঙ্গে প্রান্ত বদলের চেষ্টা, কিন্তু রানআউট এড়িয়ে দ্বিতীয় রান শেষ করতে ডাইভ দিতে হলো স্টোকসকে।
কী ভাগ্য, মিডউইকেট থেকে উড়ে আসা থ্রো এসে লাগে ঠিক তাঁর সামনের দিকে প্রসারিত ব্যাটে এবং লেগেই ছুটে চলে যায় বাউন্ডারির বাইরে। রানআউটের শঙ্কা জাগা বলেই কিনা ৬ রান! পরের বলে আদিল রশিদ রানআউট। শেষ বলে ১ হলে ম্যাচ টাই, ইংল্যান্ড প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে যাবে ২ রান হলেই। দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে রানআউট হয়ে যান মার্ক উড। রূদ্ধশ্বাস সুপার ওভারে গড়ায় খেলা।
ম্যাচটা সেদিন যাঁরা মাঠে বসে দেখেছিলেন, খেলার প্রতিটি মুহূর্ত তাঁদের স্মৃতিতে থেকে যাবে আজীবন। নিউজিল্যান্ডের হয়ে সুপার ওভারে বল হাতে পান বোল্ট, ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ে পাঠায় বাটলার আর স্টোকসকে। তাঁদের ১৫ রানের জবাবে জিমি নিশাম ও মার্টিন গাপটিল ভালো শুরুই করেছিলেন। কিন্তু আটকে গেলেন শেষে এসে। শেষ বলে ২ রান নিলে জিতে যায় নিউজিল্যান্ড। কিন্তু প্রথম রান হওয়ার আগেই ফিল্ডারের হাতে পৌঁছে যায় বল, গাপটিল রানআউট দ্বিতীয় রান শেষ করার আগেই। তার মানে সুপার ওভারও টাই!
কিন্তু তখন পর্যন্ত কী করে বলবেন, নিউজিল্যান্ড হেরেছে! পরে যেভাবে তাদের রানার্সআপ ঘোষণা করা হলো, সেটা কি আসলে খেলে হেরে? নাকি ইংল্যান্ড লটারি জিতে যাওয়ায়!
ভাগ্য সেদিন ইংল্যান্ডের সঙ্গে আরও আগে থেকেই ছিল। মূল ম্যাচে তাদের ৪৯তম ওভারের ঘটনাটা মনে করে দেখুন একবার। নিশামের বলে মিডউইকেট দিয়ে ছক্কা মারতে গিয়েছিলেন স্টোকস। বোল্ট বাউন্ডারিতে ক্যাচটা হাতে নিয়েও পেছনের পা ফেললেন রশির ওপর। ওই অবস্থাতেই বল মাঠের ভেতরে ছুড়ে দিয়েও পারেননি স্টোকসের আউট নিশ্চিত করতে। উল্টো যে বলে আউট হতে পারতেন, স্টোকস সে বলেই কিনা পেয়ে যান ছক্কা!
ভাগ্যের বদান্যতা আর সেটাকে কাজে লাগিয়ে স্টোকসের সাহসী হয়ে ওঠাতেই আসলে সেদিন শেষ হাসি হাসতে পেরেছিল ইংল্যান্ড। ৮৬ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলার পরও স্টোকস আর বাটলারের ১১০ রানের জুটিতে খেলায় ফেরে স্বাগতিকেরা। ৯৮ বলে স্টোকসের সেই অপরাজিত ৮৪ রানের ইনিংসটাকে সম্ভব হলে ইংলিশরা লর্ডসের জাদুঘরেই রেখে দিত।
অবশ্য কে জানে, স্টোকসের সেই ঐতিহাসিক হয়ে যাওয়া ব্যাট হয়তো ঠিকই কাচের বাক্সে সযত্নে রেখে দেওয়া হয়েছে সেখানে। যেমন স্মৃতি হয়ে আছে সেই ম্যাচের প্রতিটি মূহূর্ত মাঠে বসে খেলা দেখা প্রত্যেক মানুষের মনে। বিশ্বকাপের সব ফাইনালের সেরা ফাইনাল তো আর ভুলে যাওয়ার মতো ঘটনা নয়।