ক্রিকেটের অনেক রেকর্ডের মধ্যে সবচেয়ে বড় রেকর্ডের নাম মনে হয় উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালমানাক। হলুদরঙা ছোট এই বইটার নাম ক্রিকেটপ্রেমী মাত্রই জানেন। এটিকে যে ‘ক্রিকেটের বাইবেল’ বলা হয়, হয়তো এটাও। স্বাধীন নিরপেক্ষ সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে তথ্য–পরিসংখ্যান–রেকর্ডে নির্ভুলতার অতুলনীয় এক মানদণ্ড স্থাপন করার কারণেই এই স্বীকৃতি। ‘ছোট বই’ বলছি আকৃতির কারণে, নইলে ছোট কোথায়? গত এপ্রিলে প্রকাশিত ২০২৪ সালের সর্বশেষ অ্যালমানাকের পৃষ্ঠাসংখ্যাই তো ১৫৫২।
তা যে রেকর্ডের কথা বলছিলাম, সেটি কী? সেই রেকর্ড হলো, এই অ্যালমানাক ১৬১ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতিবছর বেরিয়ে যাচ্ছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধেও যাতে বিরতি পড়েনি। শুধু রেকর্ড বললেই হয়তো চলছে না, এটিকে বলতে হয় রীতিমতো বিস্ময়। বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলাই তো হয়নি, তারপরও ক্রিকেট নিয়ে একটা অ্যালমানাক কীভাবে বেরোয়!
এমন গৌরবময় ঐতিহ্যের কারণে উইজডেনের স্বীকৃতি যেকোনো ক্রিকেটারের জন্য বড় এক অর্জন। সেই স্বীকৃতি নানাভাবে আসে। ২০০৩ সাল থেকে ‘লিডিং ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ নামে একটা পুরস্কার চালু হয়েছে, যা ছেলেদের ক্রিকেটে বছরের সেরা ক্রিকেটারের স্বীকৃতি। এ বছর থেকে যাতে যোগ হয়েছে মেয়েদের ক্রিকেটও। এসব তো সাম্প্রতিক সংযোজন। পুরোনো হলো উইজডেনের ‘ক্রিকেটার্স অব দ্য ইয়ার’ স্বীকৃতি।
‘ক্রিকেটার্স’ কথাটা থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে তাতে একাধিক নাম থাকে। শুরুর দিকে ‘সিক্স গ্রেট বোলারস অব দ্য ইয়ার’, ‘নাইন গ্রেট বোলারস অব দ্য ইয়ার’, ‘ফাইভ গ্রেট উইকেটকিপারস’—এমন সব ক্যাটাগরিতে এই স্বীকৃতি দেওয়া হলেও সংখ্যাটা অনেক বছর ধরেই পাঁচে স্থির হয়ে আছে। এই পাঁচজনকে নির্বাচন করেন উইজডেন সম্পাদক। যাঁদের একজন একবার মজা করে বলেছিলেন, পুরো গণতান্ত্রিকভাবে এই নির্বাচন করা হয়, তবে ভোটারের সংখ্যা এক। সম্পাদক যাকে ইচ্ছা নির্বাচন করতে পারেন, তবে সাধারণত আগের ইংলিশ মৌসুমে পারফরম্যান্স ও প্রভাব বড় ভূমিকা রাখে এতে।
এই উইজডেন ক্রিকেটার্স অব দ্য ইয়ারও ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরোনো পুরস্কার। যেটির শুরু সেই ১৮৮৯ সালে। বাংলাদেশের একজন ক্রিকেটারেরই নাম আছে এই তালিকায়। ২০১০ সালে লর্ডস আর ওল্ড ট্রাফোর্ডে পরপর দুই টেস্টে দাপুটে দুই সেঞ্চুরির স্বীকৃতি হিসেবে তামিম ইকবাল। সেবার অবশ্য পাঁচজনের বদলে চারজন ছিলেন তালিকায়।
মোহাম্মদ আমির থাকলেও তিনি বাদ পড়ে যান স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারির কারণে। লিডিং ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার একজন একাধিকবার হতে পারেন। বিরাট কোহলি ও বেন স্টোকস যেমন তিনবার এই স্বীকৃতি পেয়েছেন। বীরেন্দর শেবাগ ও কুমার সাঙ্গাকারা দুই বার। ক্রিকেটার্স অব দ্য ইয়ারের নিয়ম আবার ভিন্ন। যা দ্বিতীয়বার হওয়ার সুযোগ নেই।
ইন্টারনেটের এই যুগে ক্রিকেটের রেকর্ড–পরিসংখ্যান পাওয়ার অনেক মাধ্যম তৈরি হয়েছে। তবে একটা সময় উইজডেন অ্যালমানাকই ছিল এর সবচেয়ে বড় সহায়। একসময় অ্যালমানাক শুরুই হতো এই রেকর্ড বিভাগ দিয়ে। এখন তা শেষে থাকে। সর্বশেষ উইজডেন অ্যালমানাকের সেই অধ্যায়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের রেকর্ডে চোখ বোলাতে বোলাতে মনে একটা কৌতূহল জাগল। দেখি তো খুঁজে কোনো রেকর্ডে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নাম আছে কি না! সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম, ভালোই আছে। তা ব্যাটিং–বোলিং–উইকেটকিপিং সব বিভাগেই। বিস্ময়ের প্রথম কারণ, বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের বয়স খুব বেশি নয়। তার চেয়েও বড় কারণ, সেটির মানও এমন বলার মতো কিছু নয়। তারপরও দারুণ কিছু রেকর্ডে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নাম। বিভাগ ধরে এক এক করে তা বলা যাক:
১. প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পঞ্চম উইকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটিটি বাংলাদেশের দুই ব্যাটসম্যান মার্শাল আইয়ুব ও মেহরাব হোসেন জুনিয়রের। ২০১২–১৩ মৌসুমে বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের ম্যাচে মধ্যাঞ্চলের হয়ে পূর্বাঞ্চলের বিপক্ষে তাঁরা দুজন গড়েছিলেন ৪৯৪ রানের জুটি। বিশ্ব রেকর্ডটা খুব বেশি দূরে ছিল না। যেটি ৫২০ রানের। ২০০৮–২০০৯ মৌসুমে ভারতের রঞ্জি ট্রফিতে ওড়িশার বিপক্ষে সৌরাষ্ট্রের চেতেশ্বর পূজারা ও রবীন্দ্র জাদেজার এই জুটি ছিল অবিচ্ছিন্ন।
২. সপ্তম উইকেটে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ জুটি রাজশাহীর ফরহাদ রেজা ও সানজামুল ইসলামের। ২০১৩–১৪ মৌসুমে জাতীয় লিগে চট্টগ্রামের বিপক্ষে দুজনের জুটিটি ছিল ৩৪৭ রানের। এই জুটিতে বিশ্ব রেকর্ড ৪৬০ রান। ১৯৯৪–৯৫ মৌসুমে পাঞ্জাবের ভূপিন্দর সিং ও পঙ্কজ ধারমানি দিল্লির বিপক্ষে এই জুটি গড়েছিলেন রঞ্জি ট্রফিতে।
২০১৩–১৪ মৌসুম জাতীয় লিগের ম্যাচে রাজশাহীর মুক্তার আলী চট্টগ্রামের বিপক্ষে ১৬৮ রানের ইনিংসে ছক্কা মেরেছিলেন ১৬টি। আর একটি মারতে পারলেই বিশ্ব রেকর্ডটা তাঁর একার হয়ে যেত। তাঁর আগে আরও তিনজন এক ইনিংসে ১৬টি করে ছক্কা মেরে রাখায় রেকর্ডটা তাঁদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হয়েছিল মুক্তার আলীকে। সেই রেকর্ড অবশ্য পরের বছরই ভেঙে যায়।
নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে অকল্যান্ডের হয়ে সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিকসের বিপক্ষে ২৮১ রানের ইনিংসে কলিন মানরোর ২৩ ছক্কা এখনো এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কার রেকর্ড হয়ে আছে। ২০১৭–১৮ মৌসুমে যা প্রায় ভেঙেই দিয়েছিলেন আফগানিস্তানের শফিকউল্লাহ শিনওয়ারি। কাবুলের হয়ে বুস্তের বিপক্ষে অপরাজিত ২০০ রানের ইনিংসে শিনওয়ারি ছক্কা মেরেছিলেন ২২টি। প্রথম ইনিংসের দুই ছক্কা যোগ হয়ে ম্যাচে সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ড অবশ্য শিনওয়ারিরই। মানরো–শিনওয়ারি ছাড়া মুক্তার আলীর চেয়ে এক ইনিংসে বেশি ছক্কা মারার কীর্তি আছে আর মাত্র চারজনের।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ৪৪ বার দেখেছে ‘ডাবল হ্যাটট্রিক’ বা চার বলে চার উইকেট নেওয়ার কীর্তি। দক্ষিণ আফ্রিকার আর জে ক্রিসপ্ই শুধু যেটির পুনরাবৃত্তি করতে পেরেছেন। চারে–চারের বাকি ৪২ জন বোলারের মধ্যে আছেন বাংলাদেশেরও একজন—মাহমুদউল্লাহ। ২০১৩–১৪ মৌসুমে বিসিএলে মধ্যাঞ্চলের হয়ে উত্তরাঞ্চলের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহর এই চারে চার। এই চার উইকেট ছিল আবার দুই ইনিংস মিলিয়ে।
চার বলে চার উইকেট নেওয়ার ম্যাচে সেঞ্চুরিও করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। এতেই তিনি ঢুকে যান রেকর্ড বইয়ের আরেকটি ছোট্ট তালিকায়। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সেঞ্চুরি আর হ্যাটট্রিকের বিরল যুগলবন্দী তো মাত্রই ১৭ বার। শুধু দুজনই তা একাধিকবার করতে পেরেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার মাইক প্রোক্টর ও বাংলাদেশের সোহাগ গাজী। প্রোক্টরের দুই কীর্তির মধ্যে ব্যবধান সাত বছরের (১৯৭২ ও ১৯৭৯), সোহাগের যেখানে তা পরপর দুই মৌসুমে। ২০১২–১৩ মৌসুমে বরিশালের হয়ে খুলনার বিপক্ষে। পরের মৌসুমেই যেটির পুনরাবৃত্তি করেন চট্টগ্রামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে। এই একটা ক্ষেত্রে সোহাগ গাজী এক ও অনন্য। একই টেস্টে সেঞ্চুরি আর হ্যাটট্রিকের এই যুগল কীর্তি সোহাগ গাজী ছাড়া আর কারও নেই।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ড ৮। রেকর্ডটা যে উইকেটকিপারদের, তা বলাই বাহুল্য। সেই রেকর্ডের অনেক ভাগীদার। এখন পর্যন্ত ১০ জন উইকেটকিপার এক ইনিংসে ৮টি ক্যাচ নিয়েছেন। যাঁদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশের গোলাম মাবুদও। জাতীয় লিগে সিলেট দলে একসময় তিন ভাই একসঙ্গে খেলতেন। গোলাম রহমান, গোলাম মাওলা ও গোলাম মাবুদের ডাকনামগুলো ছিল দারুণ—হিমেল, তুষার ও শিশির। তিন ভাইয়ের মধ্যে ছোট গোলাম মাবুদ ২০০৫–২০০৬ মৌসুমে ঢাকার বিপক্ষে ৮ ক্যাচ নিয়ে ছুঁয়েছিলেন বিশ্বরেকর্ড। এখনো যা অম্লান।