২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ১০০ দিনের কাউন্টডাউন শুরু হচ্ছে আজ। এ দিনে আট দলের টুর্নামেন্টের সূচি ঘোষণার পরিকল্পনা ছিল আইসিসির। লাহোরে ট্রফি নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু সূচি প্রকাশ বা অনুষ্ঠান, কোনোটাই হচ্ছে না। কারণ, কোন দল কোথায় খেলবে, সেটিই এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি।
কোথায় খেলা হবে, তা চূড়ান্ত না হওয়ার কারণ ভারত। দেশটির ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই বলেছে, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে পাকিস্তানে দল পাঠানোর অনুমতি দেয়নি ভারত সরকার। অনুমতি না দেওয়ার ঘটনা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগে ২০২৩ এশিয়া কাপের আয়োজক ছিল পাকিস্তান। সেবারও ভারত সরকার পাকিস্তানে দল পাঠানোর অনুমতি দেয়নি।
ভারতের অনড় অবস্থানের কারণে ছয় দলের এশিয়া কাপ হয়েছিল ‘হাইব্রিড মডেলে’। এর মধ্যে ভারত ছাড়া বাকি পাঁচ দলই শুরুতে পাকিস্তানের মাটিতে অন্তত একটি করে ম্যাচ খেলেছে। ভারতকে নিয়ে টুর্নামেন্টের বেশির ভাগ অংশ হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। এবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফির বেলায়ও হয়তো তেমন কিছুই হবে। ভারতের ম্যাচগুলো হতে পারে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বা অন্য কোথাও। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত সরকার কেন পাকিস্তানে দল পাঠাতে রাজি নয়?
ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতার কথা সবার জানা। এর মধ্যেও ক্রিকেট দলের মধ্যে সফর ছিল প্রায় নিয়মিত। মাঝে দীর্ঘ বিরতি ছিল শুধু ১৯৬২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত। ওই সময়ের মধ্যে দুবার যুদ্ধে জড়িয়েছিল দুই দেশ। একবার ১৯৬৫ সালে, আরেকবার বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়। এর আগে-পরেও একাধিকবার সফর বাতিলের ঘটনা ঘটেছে। তবে একুশ শতকে কোনো যুদ্ধ না লাগলেও এক যুগ ধরে ভারত-পাকিস্তান একে অপরের দেশে সফর করে না।
পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে সর্বশেষ ভারতে গেছে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। আর ভারতীয় দলের সর্বশেষ পাকিস্তান সফর ২০০৭ সালে। এর পরের বছরও ভারতের একটি দল পাকিস্তানে গেছে, তবে সেটা এশিয়া কাপের জন্য। এর পর থেকে চলছে লম্বা বিরতি, যা আপাতত শেষের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
গত বছর এশিয়া কাপের জন্য ভারতীয় দলের পাকিস্তানে যাওয়া না–যাওয়া নিয়ে যখন তুমুল আলোচনা, তখন জাভেদ মিয়াঁদাদের একটি মন্তব্য ভারতীয়দের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। ‘ঠোঁটকাটা’ হিসেবে পরিচিত মিয়াঁদাদ বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানে যদি তারা খেলতে না আসে, তাহলে জাহান্নামে যাক।’ বহুল আলোচিত ওই বক্তব্যের দিন আরও কিছু কথা বলেছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেটের ‘বড়ে মিয়া’। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলতে ভয় পায় মন্তব্য করে তিনি বলেছিলেন, ‘তারা জানে পাকিস্তানের কাছে হারলে তাদের দেশের মানুষ ছেড়ে কথা বলবে না। এমনকি নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত উধাও হয়ে যাবেন, ভারতের জনগণ তাঁকেও ছাড়বে না।’
জাভেদ মিয়াঁদাদের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার বেশ লম্বা। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে খেলেছেন সাড়ে তিন শর বেশি টেস্ট ও ওয়ানডে। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের অনেক কিছু তাঁর দেখা ও জানা। তবে ভারত যে শুধু পাকিস্তানের কাছে হেরে যাবে ভয়ে খেলতে চায় না, সাম্প্রতিক ইতিহাস এ কথার পক্ষে বলে না। গত এক যুগে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ না হলেও বিশ্বকাপ এবং এশিয়া কাপে নিয়মিতই খেলছে পাকিস্তান-ভারত। আর সেসব লড়াইয়ে ভারতেরই একচ্ছত্র দাপট। এ সময়ে পাকিস্তান জিতেছে শুধু ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ও ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে।
পাকিস্তানে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকে সব দেশই। ২০০৯ সালের মার্চে লাহোরে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর হামলার ঘটনায় তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসনেই চলে গিয়েছিল পাকিস্তানের ভেন্যু।
বোঝাই যাচ্ছে, ভারতের মূল আপত্তি পাকিস্তানের মাটিতে খেলা নিয়ে। পাকিস্তানে না যাওয়া নিয়ে বিসিসিআই সব সময়ই সরকারের অনুমোদন না থাকার কথা বলে। কিন্তু ভারত সরকারের কেউ কখনোই স্পষ্ট করে বলেন না ঠিক কী কারণে অনুমতি দেওয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমে ভারতের ক্রিকেট–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একটা শব্দই নিয়মিত উচ্চারণ করে থাকেন—‘নিরাপত্তা’।
পাকিস্তানে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকে সব দেশই। ২০০৯ সালের মার্চে লাহোরে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর হামলার ঘটনায় তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসনেই চলে গিয়েছিল পাকিস্তানের ভেন্যু। এমনকি ২০১১ বিশ্বকাপের অন্যতম আয়োজক হলেও পাকিস্তানে শেষ পর্যন্ত কোনো ম্যাচই হয়নি। লাহোর হামলা–পরবর্তী ছয় বছর কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশই আর পাকিস্তানে সফর করেনি। ২০১৫ সালে জিম্বাবুয়ের মাধ্যমে আবার দরজা খোলার পর গত কয়েক বছরে সব দেশই পাকিস্তানে খেলতে গেছে। বাকি শুধু ভারত। দ্বিপক্ষীয় তো বটেই, এশিয়া কাপেও যায়নি, এখন চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও যেতে রাজি নয়।
পাকিস্তানে ভারত ক্রিকেট দলের সফর বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে লাহোরের ঘটনা ছিল সবার জন্য ‘কমন’। তবে ভারত সরকারের জন্য বাড়তি হিসেবে ছিল ২৬/১১। ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর টানা চার দিন মুম্বাইয়ে দফায় দফায় সন্ত্রাসী হামলা হয়, যাতে পৌনে দুই শ মানুষ নিহত হয়।
মুম্বাইয়ে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করে ভারত। এ নিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে। সঙ্গে লাহোরে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর হামলার ঘটনা মিলিয়ে ভারত পাকিস্তানে ক্রিকেট দল পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
অর্ধযুগ পর দুই দেশের মধ্যে ক্রিকেট চালুর সম্ভাবনা দেখা দেয় ২০১৫ সালের শেষ দিকে। ওই বছরের অক্টোবরে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ নিয়ে কথা বলতে ভারতে যান পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের তখনকার চেয়ারম্যান শাহরিয়ার খান ও প্রধান নির্বাহী নাজাম শেঠি। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বিসিসিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে যেদিন বৈঠক হবে, সেদিন ওয়াংখেড়েতে হানা দেন শিবসেনার কর্মীরা। প্রায় দুই শর মতো শিবসেনা বিসিসিআই প্রধান শশাঙ্ক মনোহরসহ অন্যদের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখলে পিসিবি-বিসিসিআই বৈঠক পণ্ড হয়ে যায়। হোটেল থেকে বেরিয়ে সেদিন বিকেলেই ভারত ছাড়েন শাহরিয়ার খান।
সেদিন শিবসেনার বিক্ষোভের মুখে বিসিসিআইয়ের তখনকার সচিব অনুরাগ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা নিয়ে আলোচনা করতে পারি তিনটি শর্তে। ভারতীয় ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা, ভারতীয় ক্রিকেটারদের স্বার্থ এবং ভারতীয় জনগণের অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে।’
পরবর্তী সময়ে মোদি সরকারে ক্রীড়ামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন অনুরাগ ঠাকুর। কিন্তু তিন শর্তের সব কটিতে ঘাটতি কি না, কিংবা কোনটি অপূর্ণ—এ ধরনের বক্তব্য আর তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। ২০২৩ সালের এশিয়া কাপ এবং ওয়ানডে বিশ্বকাপ ঘিরে দুই দেশের ক্রিকেট সম্পর্ক পুনরায় চালু নিয়ে আবার ব্যাপক মাত্রায় আলোচনা তৈরি হয়েছিল। ভারতের ইচ্ছায় পাকিস্তান এশিয়া কাপ শ্রীলঙ্কায় স্থানান্তর করলেও বছরের শেষ দিকে ভারতে বিশ্বকাপ খেলতে যেতে আপত্তি করেনি।
ওই সময় গুঞ্জন ছিল, ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে ভারতের কাছ থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্তের আশা বা সম্ভাবনায় পাকিস্তান বিশ্বকাপ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি। যদিও এ বিষয়ে ভারতের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বলেও খবর পাওয়া যায়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে টানাপোড়েন, তার কেন্দ্রে আছে জম্মু। গত জুলাইয়ে ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের ছয় মাসে জম্মুতে পাঁচটি বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। একই প্রতিবেদনে পাকিস্তানের লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের কাছাকাছি একটি ‘সন্ত্রাস-সমর্থক গোষ্ঠী’র র্যালির কথা উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়, ‘নিরাপত্তা উদ্বেগের পুনরাবৃত্তির ঘটনা এবং সন্ত্রাস-সমর্থক সমাবেশের কারণে বিসিসিআইয়েরর পক্ষে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে (পাকিস্তান) সফরে পাঠানোর সম্ভাবনা কম।’
আইসিসিকে পাঠানো বিসিসিআইয়ের চিঠিতে যা এখন নিশ্চিতভাবেই নেই।