চড়া দামের খেলোয়াড় মানেই ভালো পারফরম্যান্সের নিশ্চয়তা নয়—এবারের আইপিএল যেন কথাটিকে নতুন করে প্রমাণ করছে। প্রতিটি দল কমপক্ষে চারটি করে ম্যাচ খেলে ফেলেছে। তবে নিলামের সবচেয়ে দামি (২৪ কোটি ৭৫ লাখ রুপি) মিচেল স্টার্ক ন্যূনতম প্রত্যাশাও পূরণ করতে পারেননি। ভালো করতে পারছেন না চড়া দামে বিক্রি হওয়া স্যাম কারেন, ক্যামেরন গ্রিন, আলজারি জোসেফরাও। বিপরীতে অপেক্ষাকৃত কম দামে বিক্রি হয়েও আলো ছড়াচ্ছেন বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়। এমন ৫ খেলোয়াড়কে নিয়েই এ আয়োজন—
এবারের আইপিএলের নিলাম হয়েছিল ক্ষুদ্র পরিসরে। দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত সেই নিলামে কয়েক ঘণ্টার হাঁকডাকের পরও যখন কোনো দলই মোস্তাফিজুর রহমানের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছিল না, তখন মনে হচ্ছিল এবারের আসরে বোধ হয় বাংলাদেশি খেলোয়াড়ের প্রতিনিধিত্ব থাকছে না। তবে শেষ পর্যন্ত ঠিকই দল পেয়েছেন মোস্তাফিজ। তাঁকে ভিত্তিমূল্য ২ কোটি রুপিতে কিনে নেয় চেন্নাই সুপার কিংস। অন্য বিদেশি পেসারদের সঙ্গে তুলনায় আনলে অনেক কম দামেই মোস্তাফিজকে পেয়েছে চেন্নাই। তবে বাংলাদেশের বাঁহাতি পেসার যা করেছেন, তাঁর পেছনে চেন্নাইয়ের বিনিয়োগকে সার্থক বলা যায়। আইপিএল ইতিহাসের সফলতম ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে মোস্তাফিজ এখন পর্যন্ত ৪ ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়েছেন। দলটির জেতা ৩ ম্যাচেই রেখেছেন দারুণ অবদান।
৩ দিন আগেও আইপিএলের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির প্রতীক ‘পার্পল ক্যাপ’ মোস্তাফিজের মাথায় শোভা পাচ্ছিল। তবে গত বুধবার রাজস্থান রয়্যালসের যুজবেন্দ্র চাহাল ও গত পরশু মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের যশপ্রীত বুমরা তাঁকে ছাড়িয়ে যান। বর্তমানে চাহাল-বুমরা দুজনেরই উইকেট ১০টি করে। তবে তাঁরা মোস্তাফিজের চেয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলেছেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে মাঝে দেশে ফিরেছিলেন মোস্তাফিজ। সে কারণে সাবেক ফ্র্যাঞ্চাইজি সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিপক্ষে ম্যাচটি তিনি খেলতে পারেননি। ওই ম্যাচ খেললে হয়তো সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় শীর্ষেই থাকতেন ‘দ্য ফিজ’।
বাবা পরাগ দাস ছিলেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার। ভারতের রেলওয়ে ক্রিকেট দলে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে সতীর্থ হিসেবেও পেয়েছিলেন। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে পরাগ দাসের ছেলে রিয়ান পরাগ এবারের আইপিএলে ব্যাট হাতে যেভাবে ধারাবাহিকতা দেখাচ্ছেন, হয়তো তাঁকে অচিরেই ভারতীয় দলে দেখা যাবে। কেউ কেউ তো পরাগকে ভারতের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলে নেওয়ার দাবি তুলেছেন। ২০১৮ সালে ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতা পরাগকে পরের বছর ভিত্তিমূল্য ২০ লাখ রুপিতে কিনে নেয় রাজস্থান রয়্যালস। পরবর্তী সময়ে ছেড়ে দিলেও ২০২২ সালে বৃহৎ পরিসরের নিলামে (মেগা অকশন) তাঁকে ৩ কোটি ৮০ লাখ রুপিতে আবারও দলে ভেড়ায় রাজস্থান। সেই পরাগ এবার আস্থার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছেন রানের ফোয়ারা ছিটিয়ে। এখন পর্যন্ত ২৬১ রান নিয়ে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকদের তালিকায় দুইয়ে আছেন পরাগ। শীর্ষে থাকা বিরাট কোহলির রান ৩১৯। তবে কোহলি ওপেনিংয়ে ব্যাটিং করলেও পরাগ সব ম্যাচেই নেমেছেন চার নম্বরে। তাই কোহলির চেয়ে কম বল খেলার সুযোগ পেয়েছেন।
এখন পর্যন্ত খেলা পাঁচ ম্যাচের তিনটিতে ফিফটি করেছেন পরাগ। দুটিতে ছিলেন আবার অপরাজিত। এবারের আসরে কমপক্ষে ১০০ বল খেলেছেন—এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তাঁর গড় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ; ৮৭.০০। ২২ বছর বয়সী তরুণ ছক্কা মেরেছেন ১৭টি, যা হাইনরিখ ক্লাসেনের সঙ্গে যৌথ সর্বোচ্চ।
মোহাম্মদ শামি চোটের কারণে অনেক দিন হলো মাঠের বাইরে, মোহাম্মদ সিরাজের ফর্ম নেই। তাই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের পেস আক্রমণে যশপ্রীত বুমরার সঙ্গী কে হবেন, সেটা খুঁজতে গিয়ে নির্বাচকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ার কথা। তবে তরুণ মায়াঙ্ক যাদব গতি আর বাউন্সার দিয়ে যেভাবে হইচই ফেলে দিয়েছেন, তাতে নির্বাচকেরা আশ্বস্ত হতেই পারেন। তরুণ এই ফাস্ট বোলারকে ২০২২ সালে মাত্র ২০ লাখ রুপিতে কিনেছিল লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টস। তবে আগের দুই মৌসুম খেলার সুযোগ পাননি। অপেক্ষা ফুরিয়েছে এ বছর। অভিষেক ম্যাচেই পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে ২৭ রানে ৩ উইকেট হয়েছেন ম্যাচসেরা। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে পরের ম্যাচে ছিলেন আরও উজ্জ্বল। সে ম্যাচে ১৪ রানে নিয়েছেন ৩ উইকেট; যথারীতি এটিতেও ম্যাচসেরা। ওই ম্যাচেই ঘণ্টায় ১৫৬.৭ কিলোমিটার গতিতে বল ছুড়েছেন, যা এবারের আইপিএলে দ্বিতীয় দ্রুততম ডেলিভারি। ২১ বছর বয়সী মায়াঙ্কের গতি তো আছেই, সঙ্গে মারতে পারেন ভয়ংকর বাউন্সার।
জনি বেয়ারস্টো, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলদের মতো ব্যাটসম্যানদের মাথা বরাবর বাউন্সার দিয়ে আউট করে এরই মধ্যে ‘মাথায় মারা পেসার’ তকমা পেয়ে গেছেন। এবারের আইপিএলে কমপক্ষে ৫০ বল করেছেন—এমন বোলারদের মধ্যে তাঁর ইকোনমি রেট তৃতীয় সর্বনিম্ন; ৬.০০। তাঁর করা ৫৪ বলের মধ্যে ৩১টিতেই রান নিতে পারেননি ব্যাটসম্যানরা। এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ডট বল করাতেও তিনি এগিয়ে; বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে ২৪ বল করে ১৭টিতেই কোনো রান দেননি। তবে সাড়াজাগানো এই ফাস্ট বোলারের ছন্দে ছেদ ফেলেছে চোট। গত রোববার গুজরাট টাইটানসের বিপক্ষে এক ওভার বল করেই সাইড স্ট্রেনের চোট নিয়ে বেরিয়ে যান। পুরোপুরি সেরে না ওঠায় গত রাতে দিল্লি ক্যাপিটালসের বিপক্ষে খেলেননি।
শশাঙ্ক সিংয়ের গল্প রূপকথাকেও হার মানাবে। নিলামে শশাঙ্ককে ভিত্তিমূল্য ২০ লাখ রুপিতে কেনে পাঞ্জাব কিংস। এর ঠিক পরপরই পাঞ্জাবের পক্ষ থেকে নিলাম পরিচালনাকারীকে ইঙ্গিত করা হয়, তারা এই শশাঙ্ককে নয়; নিতে চায় আরেক শশাঙ্ককে। দলের মালিক প্রীতি জিনতাও একই ইঙ্গিত করেন। একজন খেলোয়াড়কে কিনে নেওয়ার পর আবার ফিরিয়ে দিতে চাওয়ার সেই ঘটনায় বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় আইপিএলের নিলামে। পরে অবশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাঞ্জাব পরিষ্কার করে, তারা এই শশাঙ্ককেই কিনতে চেয়েছিল। দুজন একই নামের খেলোয়াড় তালিকায় থাকাতেই ওই গোলমাল হওয়ার কথাও জানায় দলটি। ভুল করে কেনা সেই শশাঙ্কই এবার পাঞ্জাব কিংসের সত্যিকারের ‘রাজা’। প্রথম ম্যাচে শূন্য রানে আউট হলেও পরের চার ম্যাচেই তিনি ছিলেন অপরাজিত। ৩২ বছর বয়সী এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান এখন পর্যন্ত করেছেন ১৩৭ রান। এর মধ্যে আছে ২৯ বলে ৬১ রানের ইনিংস। তাঁর সেই ইনিংসের ওপর ভর করেই গুজরাট টাইটানসের বিপক্ষে হারতে বসা ম্যাচ জিতেছে পাঞ্জাব।
পরের ম্যাচে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিপক্ষে করেন ২৫ বলে ৪৬ রান। এদিনও তিনি দলকে প্রায় অসম্ভব পরিস্থিতি থেকে জয়ের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাব পারেনি ২ রানের জন্য। কমপক্ষে ৫০ বল খেলেছেন—এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তাঁর গড় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ; ১৩৭.০০। ভুল করে দল পেয়ে কীভাবে সবাইকে ভুল প্রমাণ করতে হয়, সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবেন শশাঙ্ক।
দিল্লি ক্যাপিটালস স্কোয়াডে আছেন লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেট ইতিহাসের দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান জেইক ফ্রেজার-ম্যাগার্ক, আছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক ও অভিজ্ঞ শাই হোপ। এরপরও দলটি ট্রিস্টান স্টাবসকে সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে তাঁর প্রতিভার কারণে। দক্ষিণ আফ্রিকার এই হার্ড হিটার ব্যাটসম্যানকে এবার মাত্র ৫০ লাখ রুপিতে পেয়েছে দিল্লি। তবে ব্যাট হাতে যেভাবে তাণ্ডব চালাচ্ছেন, তাতে দলটির পয়সা উশুল হয়েছে বলাই যায়। এখন পর্যন্ত ৬ ম্যাচে ১৯০.৯১ স্ট্রাইক রেটে ১৮৯ রান করেছেন স্টাবস। আছে দুটি ঝোড়ো ফিফটি ও একটি ৪৪ রানের অপরাজিত ইনিংস। দিল্লি পয়েন্ট তালিকার নয়ে থাকলেও স্টাবস ঠিকই বড় ইনিংস উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। এবারের আসরে দিল্লির ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তাঁর রান, স্ট্রাইক রেট ও গড়ই (৬৩.০০) সবচেয়ে বেশি। কাল রাতে লক্ষ্ণৌর বিপক্ষে দিল্লির জয়সূচক রানটা তাঁর ব্যাট থেকেই এসেছে। ২৩ বছর বয়সী ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে আগামী ম্যাচগুলোতেও বড় কিছুর আশা করতেই পারে দলটি।