ক্রিকেট খেলাটাই যেন কেমন!
ঘুরেফিরে ব্যাটসম্যানদেরই খেলা। দিনশেষে ব্যাটসম্যানদের কৃতিত্বটাই কেন যেন বড় করে দেখা হয়। নইলে কী আর গতকালকের ফাইনালে যশপ্রীত বুমরা ম্যাচসেরা না হয়ে পারেন!
যিনি কালকের ম্যাচে সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন, সেই বিরাট কোহলির অবদানও কম নয়। ৫৯ বলে ৭৬ রানের ইনিংস খেলে দলকে টেনেছেন। ১৭৬ রানের একটা সংগ্রহ দিয়েছেন। কিন্তু বুমরা-কোহলির অবদান পাশাপাশি রাখলে, আপনি কার পক্ষে ভোট দেবেন?
কোহলির ওই ইনিংসের পরও প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকার একটা সময়ে প্রয়োজন ছিল ৩০ বলে ৩০ রান। টি-টোয়েন্টিতে রান তাড়ায় যখন কোনো দলের শেষ ৫ ওভারে বলপ্রতি ১ রান করে প্রয়োজন হবে, তখন নিঃসন্দেহে আপনি আগে ব্যাট করা দলের সংগ্রহটাকে যথেষ্ট বলবেন না!
৩০ বলে ৩০ রান, হাতে ৬ উইকেট—এমন সমীকরণ মেলানো আর পার্কে হেঁটে হেঁটে বাদাম খাওয়া একই কথা! এমন পরিস্থিতি থেকে ভারতকে ম্যাচ জেতাতে পারতেন শুধু একজনই—বুমরা। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত বুমরাই জিতিয়েছেন ভারতকে। রূপক অর্থে বললে বিশ্বকাপ ট্রফিটা এইডেন মার্করামের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে এসে বুমরা তুলে দিয়েছেন রোহিত শর্মার হাতে। এরপরও ম্যাচসেরা বুমরা নন!
হ্যাঁ, বুমরা ম্যাচসেরা নন, তবে টুর্নামেন্ট সেরা। ফাইনাল থেকে পেছনের দিকে যেতে যেতে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচ পর্যন্ত চোখ দিন। প্রতিটি ম্যাচের পারফর্মারদের ভিড়ে শুধু একটা নামই কমন পড়বে—বুমরা। কাল দ্বিতীয় স্পেলে ১৬তম ওভারে যখন বোলিংয়ে এলেন, ম্যাচ তখন দক্ষিণ আফ্রিকার পকেটে।
উইকেটে ‘কিলার’ মিলার ও ‘হালাকু খাঁ’ ক্লাসেন, এ দুজনের সামনে দিলেন ৪ রান। ৫ ওভারে ৩০ রানের সমীকরণ তখন নেমে আসে ৪ ওভারে ২৬ রানে। এরপর হার্দিক পান্ডিয়া ৪ রান দিলে ৩ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ২২ রান।
১৮তম ওভারটাতে দিলেন ২ রান। তুলে নেন মার্কো ইয়ানসেনকে। যেভাবে নিঁখুত একটা ব্লকের পরও ইয়ানসেনের স্টাম্প উড়ে গেছে, আফ্রিকার মনে তখনই ভয় ধরে যাওয়ার কথা। তখন ২ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ২০ রান। ৩ ওভারে ২২ আর ২ ওভারে ২০—দুটি সমীকরণের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান!
শেষ পর্যন্ত বুমরার বোলিং ফিগারটা দাঁড়ায় এ রকম; ৪-০-১৮-২। বোলিং ফিগারের এই সংখ্যায় অবশ্য লেখা নেই, তাঁর কারণে কতটা মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন ব্যাটসম্যানরা। বুমরা আসার আগে রান তুলতে হবে। অথবা বুমরার ওভারে রান নিতে পারিনি, অন্য কারও ওভারে পুষিয়ে দিতে হবে—এমন চিন্তাভাবনায় প্রতিপক্ষ দলগুলো কতটা চাপে থাকে, একবার ভেবে দেখুন। ভাবনা যদি ঠাঁই না পায়, তাহলে বুমরার মুখোমুখি হওয়া দলগুলোর অধিনায়ক বা ব্যাটসম্যানদের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন!
বুমরা বিশ্বকাপটা শুরু করেন আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ রানে ২ উইকেট নিয়ে। আইরিশরা প্রতিপক্ষ হিসেবে বড় কেউ নয়, চাইলে এটা হিসাবের বাইরেও রাখতে পারেন। এটা না হয় ভুলে গেলেন, পাকিস্তানের বিপক্ষে বুমরা–জাদু কীভাবে ভুলবেন! সেই ম্যাচে বুমরা যখন দ্বিতীয় স্পেলে বোলিংয়ে আসেন, পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল ৬ ওভারে ৪০ রান, হাতে ৭ উইকেট। উইকেটে ছিলেন ওপেনার মোহাম্মদ রিজওয়ান।
এরপর কী হলো, সেটা সবারই জানা। ওহ্! রিজওয়ানকে বোল্ড করার আগে ওপেনার বাবর আজমকেও আউট করেছিলেন বুমরা। সব মিলিয়ে ৪ ওভারে খরচ করেছিলেন ১৪ রান, উইকেট ৩টি। এরপর প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই কোনো না কোনো পরিস্থিতিতে চলেছে বুমরা–জাদু। সে বিভ্রমে আটকা পড়েছে প্রতিপক্ষ থেকে দর্শক, সবাই।
এই যেমন ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন এক্সে সরাসরি বুমরাকে সর্বকালের সেরা বলেছেন, ‘আমার মতে সাদা বলে বুমরা সর্বকালের সেরা সিম বোলার।’
সব মিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপে ২৯.৪ ওভার বোলিং করে বুমরা ১৫ উইকেট নিয়েছেন।মানে ১৭৮টি বল করে ১২৪ রান দিয়েছেন। ইকনোমি ৪.১৭। ওয়ানডে ক্রিকেট আর বাজবলের দুনিয়ার টেস্ট ক্রিকেটেও এটা দুর্দান্ত। এর সঙ্গে যোগ করুন, এই বোলার বল করেন ম্যাচের সবচেয়ে কঠিন ওভারগুলোতে। তাঁর ‘বাজে’ একটা ওভারই বদলে দিতে পারে ম্যাচের ফল। এবারের বিশ্বকাপে সেটা একবারের জন্যও হয়নি। রোবটের মতো সমান তালে বল করে গেছেন বুমরা।
সব মিলিয়ে একটা কথা বলাই যায়—প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা চার–ছয় মেরে মেরে দলকে জয়ের প্রান্তে নিয়ে যাবেন, ডেথ ওভারে এসে বুমরা সেই জয় লুটে নেবেন! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রিকেটপ্রেমীরা তো বুমরার বোলিং নিয়ে গবেষণা করতে বলছেন। বুমরা যা শুরু করেছেন, সেটা হয়তো হবে কোনো দিন!