বাংলাদেশের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ দুই খেলোয়াড় সাকিব আল হাসান (ডানে) ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ
বাংলাদেশের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ দুই খেলোয়াড় সাকিব আল হাসান (ডানে) ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ

টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

সাকিব–মাহমুদউল্লাহর শেষ, নাকি শেষ নয়

সেবার মাহমুদউল্লাহ ছিলেন অধিনায়ক। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে এ রকমই এক বিশ্বকাপ ছক্কায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বাঘা হতে হলে বাঘা দলকেই হারাতে হবে।’

তারপর কী হয়েছিল আপনারা জানেন। ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত মিলিয়ে হওয়া ২০২১ সালের সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সাফল্য বলতে প্রথম রাউন্ডে ওমান আর পাপুয়া নিউ গিনির সঙ্গে জয়। দ্বিতীয় রাউন্ডে গিয়ে পাঁচ ম্যাচ খেলে কোনো জয় নেই। গ্রুপের পাঁচ প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ‘বাঘা’ হওয়ার সত্যিকারের সুযোগ ছিল সামনে। কিন্তু বাংলাদেশ যা করেছিল, তাতে বাঘের বদলে তাদের বিড়াল মনে হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।

অস্ট্রেলিয়ায় পরের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশ সরাসরি খেলল সুপার টুয়েলভে, তবে শেষটা সেই হতাশা দিয়েই। গ্রুপের পাঁচ প্রতিপক্ষ ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেদারল্যান্ডস ও জিম্বাবুয়ের মধ্যে বাংলাদেশ হারাতে পারল কেবল জিম্বাবুয়ে আর নেদারল্যান্ডসকে। মানে যাদের না হারালে নাক–কান কাটা যেত, সে রকম দুটি দল। অধিনায়ক সাকিব তবু অস্ট্রেলিয়ার টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে স্মিত হাসি নিয়ে ফিরলেন। জয়ের সংখ্যায় ওটাই যে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য!

মাহমুদউল্লাহ, সাকিব এখন আর অধিনায়ক নন; তবে নাজমুল হোসেনের এবারের বিশ্বকাপ দলে দুজনই আছেন দলের আস্থার স্তম্ভ হয়ে। গত দুই বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে তাঁদের যে লক্ষ্য ছিল বা যতটুকুই তাঁরা অর্জন করতে পেরেছেন; যুক্তরাষ্ট্র আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের এবারের বিশ্বকাপে হয়তো এর চেয়েও বড় স্বপ্ন থাকবে তাঁদের চোখে। শেষটা কে না রাঙাতে চায়!

ডালাসে ব্যাটিং অনুশীলনে সাকিব–মাহমুদউল্লাহ

সাকিব গত ভারত বিশ্বকাপের আগেই বলেছেন, ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর তাঁর আর খেলার ইচ্ছা নেই। তা ছাড়া সাকিবের বয়স এখনই ৩৭ হয়ে গেছে। ২০২৬ সালের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও তাঁর খেলা মানে ৩৯ বছর বয়সে খেলা। পরবর্তী ওয়ানডে বিশ্বকাপ তো তার পরের বছর। কাগজে–কলমে মাহমুদউল্লাহ সাকিবের চেয়েও এক বছরের বড়। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায়, এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপই হয়তো যেকোনো সংস্করণে তাঁদের শেষ বিশ্বকাপ। সাকিব, মাহমুদউল্লাহ দুজনই নিশ্চয় চাইবেন বিশ্বকাপের মঞ্চে তাঁদের শেষটা স্মরণীয় করে রাখতে।

বড় মঞ্চে ভালো খেলার সামর্থ্য যে দুজনেরই আছে, সেটাও তাঁরা প্রমাণ করে রেখেছেন আগেই। ২০১৫ বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহর এবং ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিবের পারফরম্যান্সের দিকে তাকালেই আরেকবার মনে পড়বে তা। ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে এসে দুজনই এখন আরও বেশি পরিণত। আরও বেশি উত্থান–পতন দেখা হয়েছে তাঁদের এই কয় বছরে। বিশ্বকাপে নিজেদের শেষটাও তাঁরা পারফরম্যান্সের রঙে রাঙাবেন—এমন আশা তাহলে কেন করবে না দেশের ক্রিকেটামোদী মানুষ!

তবে নিরাপদ থাকতে একটা কথা বলে রাখা ভালো। খেলোয়াড়দের জীবনে আসলে শেষ বলে কিছু নেই। অন্তত বাইরে থেকে সেই দাঁড়িটা কেউ টেনে দিতে পারেন না। যতক্ষণ না একজন খেলোয়াড় নিজ থেকে ‘বিদায়’ বলছেন, ততক্ষণই তিনি তাঁর সব সম্ভাবনা নিয়ে খেলাটায় বেঁচে থাকেন। আবার ‘বিদায়’ বলেও যেহেতু অনেকে পরে ফিরে আসেন, খেলা থেকে একজন খেলোয়াড়ের বিদায় ব্যাপারটা সব সময়ই আপেক্ষিক হয়ে থাকে।

বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে শেষটা নিশ্চয়ই রাঙিয়ে রাখতে চাইবেন সাকিব–মাহমুদউল্লাহ

মাহমুদউল্লাহ টেস্ট ক্রিকেটকে আনুষ্ঠানিক বিদায় বললেও সাদা বলের দুই সংস্করণেই এখনো তিনি আছেন। তবে ২০২২ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে–পরে মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, অন্তত এই সংস্করণ থেকেও বুঝি তাঁর বিদায় ঘটে যাচ্ছে।

২০২২ সালের আগস্ট–সেপ্টেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ টি–টোয়েন্টিতে দুটি ম্যাচ খেলেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। এরপর প্রায় দেড় বছরের বিরতি। মিনহাজুল আবেদীনের তখনকার নির্বাচক কমিটি টি–টোয়েন্টি থেকে মাহমুদউল্লাহর নাম একরকম কেটেই দিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় ২০২২ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং তার আগে ক্রাইস্টচার্চে হওয়া ত্রিদেশীয় সিরিজেও দলে সুযোগ হয়নি মাহমুদউল্লাহর। তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশ খেলেছে পরের ১৪টি টি–টোয়েন্টি ম্যাচও।

অথচ দেখুন, এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বেশ আগে বাংলাদেশের যে কয়জন ক্রিকেটারের দলে থাকা নিশ্চিত মনে হচ্ছিল, মাহমুদউল্লাহ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। নির্বাচকেরা তখনো দল গঠন নিয়ে বৈঠকেই বসেননি, অথচ ক্রিকেট বোর্ডের শীষ পর্যায় থেকে প্রকাশ্যেই ইতিবাচক আভাস মিলছিল মাহমুদউল্লাহর দলে থাকার বিষয়ে।

দুঃসময় পেছনে ফেলে বাংলাদেশ দলে ফেরা মাহমুদউল্লাহ এখন ‘অটোমেটিক চয়েস’

সেটি তো এমনি এমনি নয়। গত মার্চে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হোম সিরিজে দলে ফিরে নিজের প্রথম ম্যাচেই খেললেন ৩১ বলে ৫৪ রানের ইনিংস। তবে এই যে তাঁর আবার টি–টোয়েন্টির তাঁবুতে ফেরা, সেটি মূলত গত অক্টোবর–নভেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপের দুর্দান্ত ব্যাটিং দিয়ে। একটি সেঞ্চুরি আর একটি ফিফটিসহ ৯১.৬২ স্ট্রাইক রেটে করা মাহমুদউল্লাহর ৩২৮ রানই ছিল ওই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সর্বোচ্চ সংগ্রহ। সঙ্গে গত বিপিএলে করা কিছু সময়োচিত ব্যাটিং মিলিয়ে মাহমুদউল্লাহ জানিয়ে দেন, তিনি হারিয়ে যাননি। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৬ বলে অপরাজিত ২৬ আর ৪৪ বলে ৫৪ রানের দুটি ইনিংস আরও পোক্ত করেছে সেই ধারণাকে।

মাহমুদউল্লাহর মতো এতটা দুর্দান্ত ফর্মে নেই এবারের বিশ্বকাপে নাজমুলের আরেক ভরসা সাকিবের ব্যাট। বল হাতে (৪/৩৫ ও ১/৯) জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ দুই ম্যাচে খারাপ না করলেও তাঁর কাছে চাওয়াটা তো ব্যটিং–বোলিং দুটো মিলিয়েই থাকে। তবে খেলায় সাকিব–ম্যাজিক এমনই এক ব্যাপার যে সেটির সঙ্গে ফর্ম–টর্মের সম্পর্ক সব সময় থাকে না। সাকিব দলে থাকা মানেই একটা কিছু; সেটা বোলার কিংবা ব্যাটসম্যান হিসেবে অথবা ডাগআউটে অন্যের ব্যাটিং দেখে কাটানো সময়েও।

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগে অধিনায়ক নাজমুল নিশ্চয়ই এসব মাথায় রেখেই বলেছেন, তাঁর দলের এই দুই অভিজ্ঞজন তাঁদের স্বাভাবিক ভূমিকাটা পালন করলেই তা যথেষ্ট হয়ে উঠবে দলের জন্য। তাঁদের বাড়তি কিছু করার দরকারই নেই। সঙ্গে নাজমুলের আশাবাদ ছিল, তাঁরাও চেষ্টা করবেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই দুই ‘কিংবদন্তি’কে অন্তত বিশ্বকাপের আসরে একটা দারুণ কিছু উপহার দিতে। ভবিষ্যতে সাকিব–মাহমুদউল্লাহ যে সুখস্মৃতিটা গর্বভরে রেখে দিতে পারবেন অর্জনের সিন্দুকে।

সাকিব খুব একটা ছন্দে নেই

কিন্তু এই বিশ্বকাপটাকে সাকিব–মাহমুদউল্লাহ কীভাবে নিচ্ছেন? তাঁরা কি আসলেই ভাবছেন, এই বিশ্বকাপই তাঁদের শেষ বিশ্বকাপ! উত্তরটা নিশ্চয়ই এ মুহূর্তে মাহমুদউল্লাহ, সাকিবও দিতে চাইবেন না। আর দিলেও খেলোয়াড়দের জীবনে যেহেতু শেষ বলে কিছু নেই, বিশ্বকাপ–পরবর্তী ভাবনা থেকে দেখা গেল, সেটি উধাও!

একটু ব্যাখ্যা করেই বোঝানো যাক শেষটা। ধরুন, সাকিব–মাহমুদউল্লাহর ঝলকে যুক্তরাষ্ট্র–ওয়েস্ট ইন্ডিজের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপটা বাংলাদেশ সত্যি সত্যি রাঙিয়ে ফেলল, তাঁরা কিন্তু তখন দুই রকম ভাবনাই ভাবতে পারেন—

এক. এখনো তো অনেক কিছুই দিতে পারছি। খেলাটা তাহলে এখনই ছাড়া কেন!

দুই. অনেক হয়েছে। এবার মধুরেণ সমাপয়েৎই হোক।

কাজেই খেলোয়াড়দের শেষ বলে কিছু নেই ধরে নিয়ে শুধু এই কামনাই করা যাক—মাহমুদউল্লাহ, সাকিব রাঙিয়ে দেবেন বাংলাদেশের বিশ্বকাপ। সেটি শেষ, নাকি শেষ নয়, সেই সিদ্ধান্ত একান্তই তাঁদের অধিকারে থাকুক।