‘আমরা জানি না কীভাবে ১৮০ করা যায়’—গোয়ালিয়রে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ভারতের কাছে ৭ উইকেটে হারের পর বলেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন। অধিনায়ক এর পেছনে সামর্থ্যের অভাব দেখেন না, তাঁর মতে ঘাটতিটুকু দক্ষতায়। সেখানে কীভাবে উন্নতি করা যায়, সেই প্রশ্নে নাজমুল ঘরের মাঠে উইকেটের পরিবর্তন চেয়েছেন।
নাজমুল এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘আমরা যখন ঘরের মাঠে খেলি, তখন ১৪০-১৫০ রানের উইকেটই হয়। ব্যাটসম্যানরা ওই রানটা কীভাবে করতে হয়, সেটা জানে। কিন্তু আমরা জানি না কীভাবে ১৮০ করা যায়। ওই ধরনের উইকেটে অনুশীলন করলে হয়তো আমাদের আরেকটু উন্নতি হবে। তবে আমি শুধু উইকেটের দোষ দেব না। এখানে মানসিক অনেক ব্যাপার থাকে।’
মানসিক ‘রোগ’ তো আছেই। সেটা নাজমুলের কথায়ও পরিষ্কার। প্রথম ম্যাচে আগে ব্যাট করে ১২৭ রানে অলআউট হয়ে ম্যাচ হারের পর নাজমুল এটাও বলেছেন, ‘আমি যদি গত ১০ বছর দেখি, আমরা এ রকমই ব্যাটিং করে যাচ্ছি। মাঝেমধ্যে হয়তো ভালো ব্যাটিং করি।’
নাজমুলের কথার মধ্যেই লুকিয়ে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের মূল সমস্যাটা। এই সংস্করণে যেভাবে রান তোলা দরকার, সেটা মোটেও পারে না বাংলাদেশ। পরিসংখ্যানও সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। নাজমুলের কথার সূত্র ধরেই গত ১০ বছরে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের কিছু পরিসংখ্যান দেখুন।
আজকের দিন থেকে হিসাব করে সর্বশেষ ১০ বছরে ৬৮ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে আগে ব্যাট করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৬৭ ইনিংসে গড় স্কোর ১৪৯.২ বা প্রতি ওভারে গড়ে ৭.৪৬ করে রান তুলেছে বাংলাদেশ। জিতেছে ৩০ ম্যাচ ও হার ৩৬ ম্যাচে। গোয়ালিয়রে অবশ্য সে তুলনায়ও খারাপ করেছে বাংলাদেশ, ওভারপ্রতি ৬.৪০ করে রান তুলেছে নাজমুলের দল। টি-টোয়েন্টি ভুলে যান, যেকোনো সংস্করণের ক্রিকেটে ১ রানের গুরুত্বও কতটা, সেটা সবারই জানা।
গত ১০ বছরে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে আগে ব্যাট করে দ্রুত রান তোলার (ওভারপ্রতি গড়ে) তালিকায় বাংলাদেশ ৪৩তম!
গত এক দশকে ৬৮ ম্যাচে পরে ব্যাটিং করে ৬৭ ইনিংসে ৭.৫১ গড়ে রান তুলেছে বাংলাদেশ। গড় স্কোর ১৫০.২। হেরেছে ৪০ ম্যাচ, জিতেছে ২৭ ম্যাচ। মানে গত ১০ বছরে আগে কিংবা পরে ব্যাট করে বাংলাদেশের গড় স্কোর ১৪৯ কিংবা ১৫০–এর আশপাশের ঘরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এই আমলের টি-টোয়েন্টিতে ১৫০–এর আশপাশে স্কোর কি এখন জেতার মতো? মিরপুরের মতো উইকেটে দু-একবার এই স্কোর দিয়ে হয়তো উতরে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু এমন ব্যাটিং যে মোটেও বর্তমান টি-টোয়েন্টির দাবি মেটায় না, সেই সাক্ষ্যও দিচ্ছে পরিসংখ্যান।
এই এক দশকে বড় দলগুলোর ব্যাটিংয়ে একটু তাকানো যাক। আইসিসি টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ দল ভারত এই এক দশকে ১০৫ ম্যাচে (১০৫ ইনিংস) আগে ব্যাট করে ওভারপ্রতি গড়ে ৮.৯২ করে রান তুলেছে। গড় স্কোর ১৭৮.৪। পরে ব্যাট করে ওভারপ্রতি ৮.৬০ গড়ে রান তুলেছে কিংবা গড় স্কোর ১৭২।
র্যাঙ্কিংয়ে দ্বিতীয় দল অস্ট্রেলিয়া এ সময় ৪৮ ম্যাচে (৪৮ ইনিংস) আগে ব্যাট করে ওভারপ্রতি গড়ে (আগে ব্যাট করে এই ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি) ৯.০৩ করে তুলেছে। গড় স্কোর ১৮০.৬। পরে ব্যাট করে (৭৮ ইনিংস) অস্ট্রেলিয়ার ওভারপ্রতি গড় স্কোর ৮.৪৫। গড় স্কোর ১৬৯। র্যাঙ্কিংয়ে তৃতীয় দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ এই এক দশকে আগে (৫৯ ইনিংস) ব্যাট করে ওভারপ্রতি গড়ে ৮.৪৭ করে রান তুলেছে। গড় স্কোর ১৬৯.৪। পরে ব্যাট করে ওভারপ্রতি গড় স্কোর ৮.২১—গড় দলীয় স্কোর যেখানে ১৬৪.২।
ইংল্যান্ডের পরিসংখ্যানও জেনে নিন। এই এক দশকে ৫২ ইনিংসে আগে ব্যাট করে ওভারপ্রতি গড়ে ৮.৯১ করে রান তুলেছে ইংল্যান্ড—গড় স্কোর ১৭৮.২। পরে ব্যাট করে এ সময়ে সবচেয়ে দ্রুত রান তোলা দলও ইংল্যান্ড। ৬৭ ইনিংসে ওভারপ্রতি ৮.৬৯ গড়ে রান তুলেছে, গড় দলীয় স্কোর ১৭৩.৮।
গত এক দশকে পরে ব্যাট করে দ্রুত রান তোলার তালিকায় (ওভারপ্রতি গড়ে) বাংলাদেশ ৩১তম।
এবার আসল কথাটা বলে ফেলা যাক। গত ১০ বছরে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে আগে ব্যাট করে দ্রুত রান তোলার (ওভারপ্রতি গড়ে) তালিকায় বাংলাদেশ ৪৩তম! জানতে ইচ্ছা হতে পারে, বাংলাদেশের ওপরে কোন কোন দল? ৪২টি দেশের মধ্যে টেস্ট খেলুড়ে অন্য ১১টি দেশ তো আছেই, তাদের বাইরে এমন কিছু দেশ আছে, যাদের নাম শুনে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন, এরাও ক্রিকেট খেলে! এই যেমন ধরুন চেক প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া, স্পেন, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ইতালি, ফ্রান্স, সৌদি আরব—এসব দলই এ সময়ে ন্যূনতম ১০টি করে ম্যাচ খেলেছে।
গত এক দশকে পরে ব্যাট করে দ্রুত রান তোলার তালিকায় (ওভারপ্রতি গড়ে) বাংলাদেশ ৩১তম। তবে এই তালিকায় বাংলাদেশ জিম্বাবুয়েকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে। বাংলাদেশের চেয়ে আগে টেস্ট মর্যাদা পাওয়া জিম্বাবুয়ে আরও ১০ ধাপ পেছনে—৪১তম। এস্তোনিয়া, কুক দ্বীপপুঞ্জ, সুইজারল্যান্ড, সৌদি আরব, হাঙ্গেরির মতো দেশগুলোও এ সময়ে দ্রুত রান তোলায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে এবং সবাই এ সময়ে ন্যূনতম ১০টি করে ম্যাচ খেলেছে।
নাজমুলের অধিনায়কত্বে আগে ব্যাট করে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ১৬৫ রান তুলেছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, এ বছরের মে মাসে চট্টগ্রামে।
টি-টোয়েন্টিতে নাজমুলের অধিনায়কত্বে এ পর্যন্ত ২২ ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ একবারই দলীয় সংগ্রহ ১৮০–এর ওপাশে নিতে পেরেছে। সেটি পরে ব্যাট করে এ বছরের মার্চে সিলেটে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ২০৬ রান তাড়া করতে নেমে ২০৩ রানে থেমেছিল বাংলাদেশ। নাজমুলের অধিনায়কত্বে আগে ব্যাট করে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ১৬৫ রান তুলেছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, এ বছরের মে মাসে চট্টগ্রামে।
অর্থাৎ অধিনায়কের এ কথাও সত্য যে তাঁর দল কীভাবে ১৮০ করতে হয়, জানে না। হয়তো সামর্থ্য আছে, কিন্তু পথটা এখনো বের করতে পারেনি, যে পথে নিয়মিতই ওই স্কোরের আশপাশে কিংবা পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব।