বাংলাদেশ দলের কেউ নন, টি–টোয়েন্টি সিরিজ শুরুর আগে কথাটা বলেছিলেন ভারতীয় সাংবাদিকেরা। ভারতের বিপক্ষে এবারের টি–টোয়েন্টি সিরিজে রিশাদ হোসেন, তাওহিদ হৃদয়দের দিকে দৃষ্টি থাকবে ‘ক্রিকেটের মেহফিলের’!
ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছে আইপিএল মানে ক্রিকেটের মেহফিল। তা এই মেহফিলে যাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের তেমন একটা আসে না। এ নিয়ে ক্রিকেটারদের শুধু নয়, আক্ষেপ আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদেরও।
সমর্থকগোষ্ঠীর কেউ কেউ আবার বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অবহেলার প্রসঙ্গটিও সামনে নিয়ে আসেন। কারণটা যা–ই হোক, সব প্রশ্নের উত্তর হতে পারত ভারতের বিপক্ষে এবারের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। সেখানকার সাংবাদিকেরাও হয়তো সেটাই বলতে বা বোঝাতে চেয়েছিলেন!
কিন্তু এই সিরিজে বাংলাদেশ যেমন খেলল, ভারতের ক্রিকেট তথা ক্রিকেটারদের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট আর ক্রিকেটারদের পার্থক্যটা আরও বেশি করে ফুটে উঠেছে। আইপিএলের নজর কাড়ার সিরিজে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা যেন দেখে আর বুঝে এল—আইপিএল আসলে কী জিনিস! হয়তো এটাও বুঝে গেল, ক্রিকেটের এই মেহফিল বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য নয়!
আইপিএল চার-ছক্কার খেলা। পরিসংখ্যান দিয়ে বুঝিয়ে বলা যেতে পারে। সর্বশেষ আইপিএল মৌসুমে মোট ছক্কা হয়েছে ১২৬০টি, চার ২১৭৪টি। ওভারপ্রতি রান উঠেছে ৯.৫৬ করে। ব্যাটসম্যানদের সমন্বিত স্ট্রাইক রেট ছিল ১৫০.৫৮।
এবার বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের দিকে তাকান। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে কমপক্ষে ২০০ রান করেছেন এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইক রেট ১৪০–এর ওপরে নেই। সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট, সেটাও কোনো ব্যাটসম্যানের নয়—বোলিং অলরাউন্ডার মাশরাফি বিন মুর্তজার—১৩৬.১০।
রিশাদ হোসেন ছাড়া বর্তমান দলেও কারও স্ট্রাইক রেট ১৩০–এর ওপরে নয়। ১৬ ইনিংসে রিশাদের মোট রান আবার মাত্র ১৪৮, স্ট্রাইক রেট—১৩৪.৫৪। বর্তমান দলে থাকা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট তাওহিদ হৃদয়ের—১২৯.০৫।
যাঁদের নিয়ে দেশের ক্রিকেটে চর্চা খুব বেশি হয়েছে, সেই পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে যে চারজন ব্যাটসম্যান, টি-টোয়েন্টিতে তাঁদেরও কারও স্ট্রাইক রেট ১২২–এর বেশি নয়। সাকিব আল হাসান ছাড়া সবার স্ট্রাইক রেটই ১২০–এর নিচে। তাঁরা যে ‘প্রাগৈতিহাসিক কালের’ ক্রিকেটার, তা–ও তো নয়! তাহলে চার–ছক্কার আইপিএলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের অবস্থানটা কোথায়!
দেশের হয়ে টি–টোয়েন্টিতে বড় ম্যাচে ভালো করে আইপিএলে সুযোগ পেয়েছেন, এমন ঘটনাও অবশ্য আছে। এই যেমন লিটন দাস। ২০২২ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ২১ বলে ফিফটি করার পরের আইপিএলে সুযোগ পেয়েছিলেন লিটন।
কলকাতা নাইট রাইডার্স তাঁকে এক ম্যাচে একাদশে রাখলেও সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেননি। সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে আইপিএলে মোস্তাফিজের আর একা একা লাগত না! সাকিব আল হাসানের থেকে আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর এখন টুর্নামেন্টটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলতে শুধু মোস্তাফিজুর রহমানই আছেন।
মোস্তাফিজুর রহমান গত মৌসুমে খেলেছেন চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে। বাংলাদেশ দলের হয়ে জিম্বাবুয়ে সিরিজে খেলতে দেশে ফেরার আগে চেন্নাইয়ের জার্সিতে ৯টি ম্যাচ খেলেছেন মোস্তাফিজ। এই ৯ ম্যাচে ২২.৭১ গড় আর ৯.২৬ ইকোনমিতে ১৪ উইকেট নিয়েছেন। আইপিএলের উইকেট বিবেচনায় দারুণ বোলিং করেছেন।
তবে টি–টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের বোলারদের দিকে সামগ্রিকভাবে তাকালে, খুব ভালো কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাসকিন আহমেদ আইপিএল খেলার প্রস্তাব পেয়েছেন দুবার। একবারও খেলতে পারেননি। এবারের ভারত সিরিজে একটি ম্যাচ ছাড়া ছিলেন খুব খরুচে।
দ্বিতীয় ম্যাচে ৪ ওভারে ১৬ রান দেওয়া তাসকিন প্রথম ম্যাচে ২.৫ ওভারে রান দেন ৪৪, তৃতীয় ম্যাচে ৪ ওভারে ৫১। প্রস্তাব আর আসবে কি না, কে জানে! শরীফুল ইসলামেরও আইপিএলে খেলা হয়নি। এই সিরিজে খেলতে পেরেছেন মাত্র একটি ম্যাচ। বলার মতো তো কিছুই করতে পারলেন না।
সবচেয়ে বড় সুযোগ হয়তো মিস করেছেন স্পিনার রিশাদ হোসেন। টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরুর আগে সবার চোখ ছিল তাঁর দিকেই। তবে সিরিজ শেষে ফ্র্যাঞ্চাইজগুলোর চোখ রিশাদের ওপর থাকবে কি না, সেটা বলা যাচ্ছে না। বিগ ব্যাশে সুযোগ পাওয়া এই স্পিনারের বলে গতকাল ২ ওভারে ৪৬ রান নিয়েছেন ভারতের ব্যাটসম্যানরা।
সঞ্জু স্যামসন মেরেছেন এক ওভারে ৫ ছক্কা। অথচ এই উইকেটেই কাল বোলিং করেছেন আরেক লেগ স্পিনার রবি বিষ্ণয়। ৪ ওভারে রান দিয়েছেন মাত্র ৩০, উইকেট নিয়েছেন ৩টি। এর আগে দ্বিতীয় ম্যাচে ৪ ওভারে রিশাদ দেন ৫৫ রান। স্পষ্টতই নিজেকে প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। এরপরও বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে আইপিএলে খেলার সুযোগ কিছুটা থাকলে তা রিশাদেরই আছে। লেগ স্পিনার বলে কথা!
আইপিএল খেললে পকেটে অনেক টাকা আসে, কথা সত্য। সঙ্গে অভিজ্ঞতাও জোটে। এই যেমন কাল ভারতের বেধড়ক পিটুনি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কাছে অচেনা লাগলেও এই সিরিজে অভিষেক হওয়া নীতিশ কুমারের কাছে তেমনটা ছিল না। তিনি তো গত মৌসুমে আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে খেলেছেন। নিজেও টুর্নামেন্টে ২১টি ছক্কা মেরেছেন। দেখেছেন কীভাবে প্রথম ৬ ওভারে ১২৫ রান তোলা যায়।
স্বাভাবিকভাবেই এমন ঝড় দেখলে নীতিশরা আঁতকে ওঠেন না। ভারত যে গতকাল বাংলাদেশের বিপক্ষে ২০ ওভারে ২৯৭ রান করল, এর আশপাশের ইনিংস তো আইপিএলে তাঁরা দেখেই এসেছেন। তাঁরা জানেন, চার–ছক্কার দুনিয়াটা কেমন আর এখানে সবারই ঝড় তোলার সুযোগ আসে! বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য বিষয়টি উল্টো। আইপিএলের এমন ঝড় তাঁরা শুধু টেলিভিশনেই দেখে থাকেন।
সরাসরি এমন ঝড়ের কবলে পড়ে আঁতকে না উঠে, সংবাদ সম্মেলনে বোলারদের কোর্টে বল ঠেলে না দিয়ে এসবের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যত দ্রুত মানিয়ে নিতে পারবেন; ততই মঙ্গল। নইলে যে ভবিষ্যতে ফ্ল্যাট উইকেটে বড় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে এভাবে আরও অনেক ‘আইপিএল–দর্শন’ করতে হবে!