‘অ্যান্ডি কিছু বললে আপনি শুনবেন। সে খেলাটা জানে’—মাইকেল হোল্ডিং বহুবার বলেছেন এই কথা। সতীর্থ ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টসের প্রসঙ্গ এলেই হোল্ডিংয়ের উত্তর শুরু হয় এই কথা দিয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সোনালি প্রজন্ম নিয়ে কোনো প্রামাণ্যচিত্র, পেস বোলিং নিয়ে সাক্ষাৎকার কিংবা ধারাভাষ্যে রবার্টসের প্রসঙ্গ এলেই হোল্ডিংয়ের মুখে কথাটা শুনতে পাবেন। প্রিয় ‘অ্যান্ডি’কে বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হোল্ডিং কথাটা সবসময়ই বলেন।
তিনি নিজেও রবার্টসের দেখানো পথে হেঁটেছেন। তাঁদের দেখানো পথ ধরে ক্রিকেট–বিশ্ব কাঁপিয়েছেন জোয়েল গার্নার, কলিন ক্রফট, ম্যালকম মার্শাল, কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশ ও প্যাট্রিক প্যাটারসনের মতো বাঘা বাঘা পেসাররা। রবার্টসের আগে ল্যারি কনস্ট্যানটাইন, চার্লি গ্রিফিথ কিংবা ওয়েস হলের মতো কিংবদন্তিরা এলেও রবার্টসই ছিলেন সত্তরের দশকে পেস বোলারদের ‘গডফাদার’।
বুধবার লর্ডস টেস্ট দিয়ে শুরু হতে যাওয়া ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজকে সামনে রেখে আজ ক্যারিবীয় পেস চতুষ্টয়ের ‘নেতা’ রবার্টসের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য টেলিগ্রাফ’। যদিও সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছে গত ডিসেম্বরে অ্যান্টিগায়। ৭৩ বছর বয়সী রবার্টস যখন খেলেছেন, তখন ক্রিকেটে পারফরম্যান্স বিশ্লেষক বলে কিছু ছিল না। তবে সাক্ষাৎকারে তাঁর কথাগুলো শুনলে তাঁকে আধুনিক ক্রিকেটের অ্যানালিস্টের চেয়ে কম কিছু মনে হবে না।
রবার্টস বলেছেন, ‘আমি অন্যদের থেকে একটু বড় ছিলাম। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের অনুকরণ করার অভ্যাস আছে। অন্যদের কিছু ভালো লাগলে তারা সেটা অনুকরণ করতে পছন্দ করে। আমি ব্যাটসম্যানদের শক্তি ও দুর্বলতা খুঁজে বের করতে পছন্দ করতাম। সে জন্যই হয়তো আমি এখন কৃতিত্বটা পাই। কারণ, টিম মিটিংয়ে আমি ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলতাম।’
রবার্টসের আতশি কাচের নিচে পড়তে হতো নিজ দলের সতীর্থ হোল্ডিং, ক্রফট, গার্নারকেও। পেস চতুষ্টয় কেন কার্যকর ছিল, তা বোঝাতে রবার্টসই বলছিলেন, ‘আমরা সবাই একজন আরেকজন থেকে আলাদা ছিলাম।’ ]
ক্রফটকে নিয়ে গার্নারের পর্যবেক্ষণ, ‘কলিন ক্রফট হয়তো আমাদের মধ্যে শারীরিকভাবে সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ছিল।’ আর ৬ ফুট ৭ ইঞ্চির গার্নার? ‘আপনি তাঁকে ভদ্র দানব বলতে পারেন’—রবার্টসের উত্তর। ‘হুইসপারিং ডেথ’ হোল্ডিংকে নিয়ে তাঁর কথা, ‘ভয়ংকর গতিময়। আপনি তার রানআপ দেখতে দেখতে বল দেখা ভুলে যাবেন।’ এরপর নিজেকে অন্য তিনজনের চেয়ে আলাদা করলেন এভাবে, ‘আমি অন্য রকম ছিলাম। আমি ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করেছিলাম। আমার বোলিংয়ে ছিল বৈচিত্র্য।’
তা রবার্টস নিজের বোলিংয়ে এত বৈচিত্র্য যোগ করলেন কীভাবে? শুনুন তাঁর মুখেই, ‘ফাস্ট বোলিংয়ের যা কিছু শিখেছি, প্রায় সবই নিজে নিজে শেখা। আমি সবার বোলিং দেখতাম। অনেক ক্রিকেট ম্যাচ দেখতাম। অন্যদের দেখে তা অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম। কাউকে কিছু করতে দেখলেই নেটে গিয়ে সেটা করার চেষ্টা করতাম।’ এমনকি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইংলিশ কিংবদন্তি পেসার ফ্রেড ট্রুম্যানের মন্তব্য পড়েও নিজের বোলিং অ্যাকশন পাল্টেছিলেন রবার্টস, ‘আমি নেটে গিয়ে হাত উঁচু করে বল করার চেষ্টা করতে থাকি। সেটা করার পর দেখি যে আমার আউটসুইং হচ্ছে।’
রবার্টস যেন সত্তর-আশির দশকের পেস বোলিংয়ের ‘অ্যাপ’, যিনি নিজেকে কদিন পরপরই ‘আপডেট’ করতেন। তাঁর অস্ত্রাগারে স্লোয়ার বল এসেছে এভাবেই। সাধারণ স্লোয়ার বল দিয়ে শুরু, এরপর রবার্টস আবিষ্কার করেন দুই রকমের স্লোয়ার বাউন্সার। একটা কিছুটা কম গতির, আরেকটি বিদ্যুৎগতির, ‘এ কারণে ব্যাটসম্যানদের আমার বাউন্সারে সমস্যা হতো। সবার মনে হতো, দুটি বাউন্সারই একই রকম। একটা বাউন্সার যদি ১০০ মাইল বেগে করি, আরেকটি যদি ৯০ মাইলে করি, তাহলে ব্যাটসম্যানদের নতুন করে ভাবতে হবে। যদি সবই ১০০ মাইলে যায়, তাহলে তো তাঁকে চিন্তা করতে হচ্ছে না।’
ব্যাটসম্যানকে দুশ্চিন্তায় ফেলার আরও কত কৌশল আবিষ্কার করেছেন রবার্টস! কখনো রিলিজ পয়েন্ট বদলে ফেলতেন, কখনো রানআপ। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করেই বুট দিয়ে ঘাসের ওপর ঘষা দিতেন। এসবই তাঁর ব্যাটসম্যানদের কৌতূহলী করার কৌশল। এখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বোলারদের এমন অনেক কৌশলই ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু সত্তর-আশির দশকে এসবই ছিল নতুন, ‘ব্যাটসম্যানকে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা থেকে বের করে আনতে পারলে তাঁকে সহজে আউট করা যায়। আপনাকে ব্যাটসম্যান থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে হবে।’
রবার্টস অবশ্য এগিয়ে থেকেছেন ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। অ্যান্টিগার মতো ছোট্ট দ্বীপ থেকে আসা প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার যে তিনিই! রবার্টস বলেছেন, ‘তখন নির্বাচকেরা ছোট দ্বীপের খেলোয়াড়দের সুযোগ দিত না। আমার যেমন প্রথম টেস্ট ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে নিজের অভিষেক ম্যাচে। আমাদের সামনে কোনো লক্ষ্য ছিল না, কোনো অনুপ্রেরণা ছিল না, যাকে দেখে মনে হতো যে হ্যাঁ, তিনি আমাদের দ্বীপের এবং তিনি ভালো খেলছেন। তবে আমি জানি আমাদের এমন খেলোয়াড়ও ছিল, যারা আমার চেয়ে ভালো, কিন্তু সুযোগ পায়নি।’
রবার্টস সুযোগ পেয়েছেন এবং তা কাজে লাগিয়েছেন। মাত্র ১৯ টেস্টে ১০০ টেস্ট উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন। ৪৭ টেস্টের ক্যারিয়ারে শিকার ২০২ উইকেট, ‘আমি এমন কিছু করেছি যেন আমাকে বাদ দেওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়। আমি যেকোনো উপায়ে দলে নিজের জায়গা ধরে রাখতে চেয়েছি। সেদিক থেকে ভালো করে যাওয়ার একটা অনুপ্রেরণা তো ছিলই।’
ছোট্ট দ্বীপ অ্যান্টিগায় রবার্টসের পর ভিভ রিচার্ডসের মতো কিংবদন্তি ক্রিকেটারও জন্মেছেনন। কার্টলি অ্যামব্রোস, রিচি রিচার্ডসনও এই দ্বীপেরই ক্রিকেটার। অ্যান্টিগা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে গেলে খুঁজে পাবেন তাঁদের নাম, খুঁজে পাবেন রবার্টসকেও।