দুনিয়ায় অনেক রকম পতন আছে। তবে মূলধারার পতন সম্ভবত দুরকম। বিলম্বিত পতন ও দ্রুত পতন। চাইলে বাংলাদেশের সৌজন্যে আরও একটি পতন আবিষ্কার করে নিতে পারেন। আশ্চর্য পতন!
এমন পতনের ব্যাখ্যা একটাই। চোখে দেখেও যা বিশ্বাস হয় না! না, মানে বাংলাদেশের ক্রিকেট দেখা থাকলে ‘পতন’ শব্দে মোটেও গাত্রদাহ হওয়ার কথা না। বরং এই দুই যুগের বেশি সময় ধরে পতনে পতনে সয়ে যাওয়ার কথা। ব্যাটিংয়ে নেমে ফেরার মিছিল তো নতুন না। তবু শারজায় গতকাল যা হলো, চোখে দেখেও বিশ্বাস করা কঠিন!
পরিস্থিতিটা একবার ফিরে দেখা যাক। ২৩৫ রান তাড়া করতে নেমেছিল বাংলাদেশ। ১১.৩ ওভারে দলের রান যখন ১ উইকেটে ৬২, তখন নাজমুল হোসেনের ক্যাচ ছাড়েন বদলি উইকেটকিপার ইকরাম আলীখিল। নাজমুল তখন ২১ রানে ব্যাট করছিলেন। মেহেদী হাসান মিরাজও ১ রান ও ৪ রানে দুটি ‘জীবন’ পান মোহাম্মদ নবী ও গুলবদিন নাইবের কাছে। রান তাড়ায় অর্ধেকের বেশি পথ পেরিয়ে, মানে বাংলাদেশের সংগ্রহ যখন ২ উইকেটে ১২০, ততক্ষণে আফগানিস্তানের দুটি রিভিউও শেষ। ওদিকে বাংলাদেশের হাতে ৮ উইকেট, দরকার ১১৬, ওভার সংখ্যাও ছিল পর্যাপ্ত।
বাংলাদেশের ক্রিকেট দেখা থাকলে এমন জায়গা থেকেও হার আপনার কাছে নতুন না। কিন্তু গতকাল যেভাবে হুড়মুড়িয়ে সবকিছু ভেঙে পড়ল, যেভাবে আসা-যাওয়ার মিছিল দেখা গেল, তেমন কিছু এর আগে কখনো দেখা গিয়েছে কি না, তা সত্যিই গবেষণার বিষয়। ৫৩ বলের মধ্যে ২৩ রানে পড়েছে শেষ ৮ উইকেট। এর মধ্যে শেষ ৭ উইকেট পড়েছে ২৫ বলের মধ্যে, যেখানে ১৮ বছর বয়সী এক স্পিনারের একার শিকারই ৫ উইকেট। হিসাবটা আরেকটু ছোট করে আনা যায়। ১৮ বলের মধ্যে পড়েছে শেষ ৬ উইকেট। ১০ বলের মধ্যে ভেঙেচুরে একাকার হয়েছে মিডল অর্ডার—ফিরেছেন মেহেদী হাসান মিরাজ, মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিকুর রহিম। বলতে পারেন, এটাও আর নতুন কী! সেটাও ঠিক, তবে তখন বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখে থাকলে কারও কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার কী দরকার?
দেখে মনে হচ্ছিল, মাত্র ৫টি ওয়ানডে খেলা ১৮ বছর বয়সী একটি ছেলের সামনে স্রেফ হাত-পা বেঁধে ব্যাটিংয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে! কারণ? গজনফরের রহস্য-স্পিন পড়তে না পারা। কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন হতে পারে, গজনফরের বোলিংয়ের কলাকৌশলগুলো তো দুনিয়াতে কালই নাজিল হয়নি! ক্যারম বল, অফ স্পিনার হয়েও দুই দিকেই বাঁক খাওয়ানো, গুগলি—এসব ক্রিকেটে এখন পুরোনো অস্ত্র। আমজনতার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে অজন্তা মেন্ডিসের সময় থেকে। সেখানে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার হয়েও এমন বোলিংয়ের সামনে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠা আশ্চর্যের নয় তো কী!
এর মধ্যে আশ্চর্যতম হতে পারে মুশফিকের আউটটি। উইকেটকিপিংয়ে চোট পাওয়ায় কাল সাতে ব্যাটিংয়ে নামেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ (৪৬৮ ম্যাচ) এই ব্যাটসম্যান। শোনা যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে মুশফিকের অনুশীলনের মাত্রা যে কারও জন্যই রেফারেন্স পয়েন্ট। তা, সেসব অনুশীলনে কি ক্যারম বল-টল খেলায় শাণ দেওয়া হয় না! নাকি সবই সোজা সোজা কিংবা অফ স্পিন অথবা লেগ স্পিন? স্মরণ করে দেখুন, বলটি মুশফিকের ব্যাট ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় ফ্লাইটে বোকা বনে শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে তিনি ক্রিজ ছেড়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন। এমন আউট আট-নয়-দশে নামা লোয়ার অর্ডারদের ক্ষেত্রে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের স্তম্ভ যদি এভাবে ধসে পড়ে, তখন ভিত নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
মাহমুদউল্লাহ করলেন কি, আবহমান বাংলার সেই চিরায়ত ‘বাঙালি সহজ-সরল’ কথাকে প্রমাণ করতেই যেন শরীর থেকে দূরে ড্রাইভ খেললেন। তাতে ব্যাট ও প্যাডের মাঝ গলে বল ঢোকার মতো যে ফাঁকটা তৈরি হলো, সেটি কি শুধু বোল্ড হওয়ার পথরেখা নাকি বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মাঝে যে ফারাক—সেটারও রূপক ব্যবধান?
কিন্তু সেই প্রশ্নে না যাওয়াই উত্তম। কারণ, প্রশ্ন তোলার আগে ঘটে মানে মাথায় কিছু থাকতে হয়! স্বয়ং অধিনায়ক নাজমুল হোসেনই সাংবাদিকদের এই ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন, গত ২০ অক্টোবর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুর টেস্ট শুরুর আগে। সেই টেস্ট শুরুর আগে তিন সংস্করণ মিলিয়ে সর্বশেষ ৩০ ইনিংসে মাত্র একটি ফিফটি পাওয়ায় নাজমুলের বাজে ফর্ম নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর কাছে। অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘আপনারা যাঁরা (সাংবাদিকেরা) আছেন, আমরা হয়তো আপনাদের চেয়ে বেশি জানি কোন উইকেটে কোন শট খেলতে হবে।’
নাজমুলের কথা বিলক্ষণ সঠিক। তাঁদের কাজটাই তো খেলা। খেলার জন্য শাণ দিয়ে নিজেদের প্রস্তুত করা। আর আমাদের কাজ তাঁদের খেলা দেখা। সমস্যা হলো, দেখতে দেখতে কখনো চোখ ব্যথা করে ওঠে। বেদনার উদ্রেক ঘটে। তখন একটি বাজে সিনেমা দেখে হল থেকে বের হয়ে দর্শকের যে প্রতিক্রিয়া হয়, তেমনি দু-একটি আর্তিও মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়! তা, নাজমুল গোস্তাখি মাফ করলে একটি বিষয় পেশ করা যায়।
যে ওভারে (২৬তম) তিনি আউট হলেন, সে ওভারে মোহাম্মদ নবীর চতুর্থ বলের পর ডিপ স্কয়ার লেগ থেকে ফিল্ডার তুলে এনে স্লিপে দাঁড় করানো হয়। স্লিপ তখন দুটি। কেন?
ম্যাচের দিনেও এখন তেমন সাড়া পড়ে না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গতকালও এর আলাদা কিছু হয়নি। তেমন ভ্রুক্ষেপ ছিল না কারও। ব্যাপারটা শঙ্কার না স্বস্তির, তা আমরা সবাই বুঝি। কথায় আছে, দর্শক না থাকলে সব খেলাই অর্থহীন।
নাজমুল সম্ভবত ভেবেছিলেন, এর আগে নবীর বের হয়ে যাওয়া অফ স্পিনে বারবার যেহেতু পরাস্ত হচ্ছিলেন, তাই দুটি স্লিপ। তাহলে কী করতে হবে? সুইপ ও রিভার্স সুইপে যেহেতু রান পাওয়া গেছে, তাই ওটাই ওই মুহূর্তে মোক্ষম শট। পঞ্চম বলটি তাই সুইপের না হলেও সেটাই খেলেছেন জোর করেই। ফলটা আপনি জানেন, শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ। শট নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কারণ, কোন উইকেটে কোন শট খেলতে হবে, সেটা বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়কের সবচেয়ে ভালো জানার কথা। প্রশ্ন অন্য জায়গায়।
নাজমুল কখনো ‘টোপ’ শব্দটি শুনেছেন কি না?
ডিপ স্কয়ার লেগ ফাঁকা করে তাঁকে সুইপ খেলার টোপ দেওয়া হয়েছিল। সেই টোপ ঠিক করে নবী বলটা একটু টেনে পেছনের লেংথে করেছিলেন যেন সুইপ খেলতে গিয়ে গড়বড় হয়। বাকিটা নাজমুলই ভালো জানেন। অধিনায়ক যখন এমন টোপ গেলেন, তখন মুশফিকের ওই আউট কিংবা আশ্চর্য পতনেও গা না করাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ম্যাচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের সমর্থকদের কাছে এত দিন ‘ট্রেন্ড’ ছিল। ভালো কিংবা খারাপ—যা–ই করুক, প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু কয়েক মাস ধরে পার্থক্যটা কি ধরা যাচ্ছে?
নাজমুল ম্যাচ শেষে বলেছেন, প্রস্তুতি দারুণ ছিল। কিন্তু দিনটা তাঁদের ছিল না। যদিও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দিন কাড়তে হয়, কেউ দেয় না!
ম্যাচের দিনেও এখন তেমন সাড়া পড়ে না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গতকালও এর আলাদা কিছু হয়নি। তেমন ভ্রুক্ষেপ ছিল না কারও। ব্যাপারটা শঙ্কার না স্বস্তির, তা আমরা সবাই বুঝি। কথায় আছে, দর্শক না থাকলে সব খেলাই অর্থহীন। তবে বাংলাদেশের জন্য ব্যাপারটা হয়তো একটু অন্য রকম। নাজমুলরা যেহেতু জানেন কোন উইকেটে কেমন শট খেলতে হবে, তাই ওই আশ্চর্য পতনের পরও সবাই হয়তো ধরে নিয়েছেন, সবজান্তারা এর চেয়ে বেশি আর কী করবেন! ওটাই সামর্থ্য—২ উইকেটে ১২০ থেকে ১৪৩–এ অলআউট হওয়া। সক্ষমতা সম্ভবত ৪ উইকেটে ৩৫ থেকে ৫০ ওভার খেলে ২৩৫ করতে পারা।
সক্ষমতার কথা যেহেতু উঠল, রশিদ খানকে টানতেই হবে। লেগ স্পিনার হলেও ওভারে চার-পাঁচটি করে গুগলি করার সক্ষমতায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। বরাবরের মতো কালও প্রতি ওভারে অন্তত তিন থেকে চারটি করে গুগলি করেছেন। ড্রেসিংরুম থেকেই মাহমুদউল্লাহ তা দেখেছেন। এমনকি এই ম্যাচের আগে ভিডিও অ্যানালিস্ট থেকে কোচরাও নিশ্চয়ই রশিদ খানের বিপক্ষে প্রস্তুতিতে এ অধ্যায়টা ভালো করে শিখিয়ে–পড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মাঠে কী দেখা গেল? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের তৃতীয় অভিজ্ঞতম (৪২৪ ম্যাচ) ক্রিকেটারটি রশিদের দুটি বল খেলার পর তৃতীয়টিতে প্রলুব্ধ হলেন। বলটা বাতাসে ভাসতে ভাসতে যখন কল্পিত ছয় নম্বর স্টাম্প বরাবর পড়ল, তখন যে কেউ ভেবে নেবেন, ওটা গুগলি! কারণ, লেগ স্পিনার ছয় নম্বর স্টাম্পে বল ফেলে কখনো তা বের করার চেষ্টা করবে না। অন্তত ম্যাচের ৩২তম ওভারে, যখন ম্যাচ বাংলাদেশের হাতে ছিল।
কিন্তু মাহমুদউল্লাহ করলেন কি, আবহমান বাংলার সেই চিরায়ত ‘বাঙালি সহজ-সরল’ কথাকে প্রমাণ করতেই যেন শরীর থেকে দূরে ড্রাইভ খেললেন। তাতে ব্যাট ও প্যাডের মাঝ গলে বল ঢোকার মতো যে ফাঁকটা তৈরি হলো, সেটি কি শুধু বোল্ড হওয়ার পথরেখা নাকি বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মাঝে যে ফারাক—সেটারও রূপক ব্যবধান?
নাজমুল ম্যাচ শেষে বলেছেন, প্রস্তুতি দারুণ ছিল। কিন্তু দিনটা তাঁদের ছিল না। যদিও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দিন কাড়তে হয়, কেউ দেয় না! কিন্তু সেসব বিশেষজ্ঞ তো আর কোন উইকেটে কোন শট খেলতে হবে, সেটা নাজমুলদের মতো অত ভালো জানেন না। তাই ম্যাচের পর ম্যাচ সবকিছু নাজমুলদের হাতে ছেড়ে দিয়ে বলতে হয়, দেখেন যা ভালো মনে করেন!