বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসের অস্থিরতম সময় যাচ্ছিল তখন। ১১ দফা দাবিতে ক্রিকেটারদের ধর্মঘটে তোলপাড় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। সে সমস্যার সমাধান হতে না হতেই দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ সাকিব আল হাসানকে আইসিসি এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে।
বাংলাদেশ টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক ছিলেন সাকিব। কদিন পরই এই দুই সংস্করণের সিরিজ খেলতে বাংলাদেশ দলের ভারত সফর। ঘোর অমানিশায় ডুবে থাকা বিসিবি তখন টি-টোয়েন্টির দায়িত্ব তুলে দেয় মাহমুদউল্লাহর হাতে, টেস্ট দলের অধিনায়ক হন মুমিনুল হক। সেই সফরে একটি টি-টোয়েন্টি জিতলেও টেস্ট সিরিজটা বাজেভাবে হেরেছিল বাংলাদেশ।
ভরাডুবির সেই সফর থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেট শিখেছিল কঠিন এক শিক্ষা। ক্রিকেট–বিশ্বে টিকে থাকতে হলে টেস্ট ক্রিকেটকে সত্যিকার অর্থেই গুরুত্ব দিতে হবে এবং সেটা মুখের কথায় নয়, কেন্দ্রীয় চুক্তিতেই থাকবে সেই ছাপ। এর আগে তিন সংস্করণের জন্য বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তি ছিল একটিই।
ভারতে ভরাডুবির পর টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সংস্করণের জন্য ক্রিকেটারদের সঙ্গে আলাদা চুক্তির সিদ্ধান্ত নেয় ক্রিকেট বোর্ড। চুক্তিতে টেস্টের ম্যাচ ফি ধরা হয় ম্যাচপ্রতি ৪ লাখ টাকা, ওয়ানডেতে ২ লাখ টাকা এবং টি-টোয়েন্টিতে ১ লাখ টাকা। টেস্ট ক্রিকেটের ম্যাচ ফি বেড়ে এখন হয়েছে ৬ লাখ টাকা, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির ৩ ও ২ লাখ টাকা করে। বার্তাটা পরিষ্কার—বাংলাদেশেও শুধু টেস্ট খেলেই ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব।
২০১৯ সালের সেই সিদ্ধান্তের ফলই এখন পাচ্ছে বাংলাদেশ দল। পাকিস্তানকে তাদের মাটিতে ধবলধোলাইসহ সর্বশেষ ৮ টেস্টের মধ্যে ৫ জয়ের ভিত খুঁজতে গেলে চার বছর আগের সেই সিদ্ধান্তের কথা বলতেই হবে, যা ছিল নতুন করে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার মতোই ঘটনা।
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান ছিলেন তখন বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান। দীর্ঘ ১২ বছর এ দায়িত্ব থাকা আকরাম সিদ্ধান্তটাকে তাঁর সময়ের সেরা সিদ্ধান্তই মনে করেন। গতকাল মুঠোফোনে গর্ব করে বলছিলেন, ‘তিন সংস্করণে আলাদা কেন্দ্রীয় চুক্তি আমার ১২ বছরের ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্ত। আজ বাংলাদেশের ক্রিকেট এটার সুফল পাচ্ছে।’
আকরাম এ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, ‘ওই সময় ৯০-৯৫ ভাগ খেলোয়াড় সব সংস্করণে খেলত। আমরা টেস্টের জন্য সেরা দল আলাদাই করতে পারতাম না। কিছু খেলোয়াড়ের টেস্টের প্রতি আগ্রহ কমে গিয়েছিল। যারা টেস্ট খেলবে, তাদের আর্থিকভাবেও খুব বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল না। আমরা ভাবলাম যে অন্য দুই সংস্করণের চেয়ে যদি টেস্টের টাকা বাড়ানো হয়, তাহলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে।’
বিসিবির প্রধান নির্বাচক ছিলেন তখন মিনহাজুল আবেদীন। যাঁকে টেস্ট সিরিজ এলেই হন্যে হয়ে লাল বলের ক্রিকেটার খুঁজতে হতো। কেন্দ্রীয় চুক্তি আলাদা করার আগের ও পরের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে গতকাল তিনি বলেছেন, ‘আগে ওয়ানডের সঙ্গে টেস্টের ম্যাচ ফির কোনো পার্থক্য ছিল না। এই আর্থিক অনুপ্রেরণাটা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল যেন ছেলেরা লাল বলের ক্রিকেটে আরও আকৃষ্ট হয়। ওরা যেন আস্থা রাখতে পারে, বাংলাদেশে শুধু টেস্ট ম্যাচ খেলেও ভালো ক্যারিয়ার দাঁড় করানো যায়। এটা করায় আমরা দ্রুতই সাত-আটজন লাল বলের বিশেষজ্ঞ ক্রিকেটার পেয়ে যাই।’
মিনহাজুলের বিশ্বাস, টেস্ট দলটা ভালো হলে সেটার প্রভাব পড়বে অন্য দুই সংস্করণেও, ‘লাল বলের খেলাটাকে আকর্ষণীয় করতেই আমরা চুক্তি আলাদা করেছিলাম। টেস্ট ক্রিকেটটা ঠিক হলে অন্য দুই সংস্করণ এমনিতেই ভালো করব। এটা মাথায় নিয়েই লাল বলে খেলোয়াড়দের আগ্রহ বাড়াতে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন এনেছিলাম।’
প্রভাবটা খুব দ্রুতই চোখে পড়েছে। পেসারদের একটা দল সারা বছর নিজেদের টেস্টের জন্য প্রস্তুত রাখতে শুরু করেন। আর্থিক সামর্থ্য বাড়ায় ব্যক্তিগত ট্রেনার রেখে খেলোয়াড়দের ফিটনেস ধরে রাখার রীতিও চালু হয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় বছরে ৪-৫টি টেস্টের একাদশে সুযোগ পেলেই ভালো আয় করা সম্ভব। শুধু ক্রিকেটারদের মনে ওই নিশ্চয়তা আসারই প্রতিফলন টেস্ট দলের এমন পারফরম্যান্সে।