তামিম ইকবাল চোট পেয়ে ছিটকে যাওয়ার পরই জাকির হাসান ডাক পান টেস্ট দলে। ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ কিছুদিন ধরেই রান করছেন, তবে ভারত সিরিজের আগে তিনি নতুন করে আলোচনায় আসেন কক্সবাজারে ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে দারুণ এক সেঞ্চুরিতে। ১০ ঘণ্টার ওপর ব্যাটিং করে বাঁচিয়েছিলেন ম্যাচ। অথচ বাংলাদেশ ‘এ’ দলের ওই ম্যাচেও থাকার কথা ছিল না তাঁর। শুরুতে ডাকা হয়েছিল তৌহিদ হৃদয়কে, তাঁর চোটেই শেষ মুহূর্তে ডাক পড়ে সিলেটের ব্যাটসম্যানের।
এবার অবশ্য মঞ্চটা টেস্ট ক্রিকেট। প্রথম ইনিংসে ভালো শুরুর পরও ফিরতে হয় ২০ রান করেই। এমনিতে সহজাত ওপেনার নন, যদিও তিন-চারে খেলেন বলে নতুন বলে খেলার অভিজ্ঞতা আছে ভালোই। তবে জাকির হঠাৎ পাওয়া সুযোগটা কতটা কাজে লাগাতে পারবেন, সে প্রশ্ন ছিলই।
সেই জাকিরকে আজ চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে চতুর্থ দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে আসার পথে একটু থামতে হলো। রাহুল দ্রাবিড় যে এগিয়ে আসছেন অভিনন্দন জানাতে। সেঞ্চুরির পর মাঠেই বিরাট কোহলির অভিনন্দন পেয়েছেন, দিনের খেলা শেষে অভিনন্দন পেলেন ভারতীয় কোচেরও।
টেস্ট শুরুর আগেই প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো বলেছিলেন, ম্যাচ পঞ্চম দিনে নিয়ে যাওয়াই মূল লক্ষ্য তাঁদের। গতকাল বিকেলে যখন নাজমুল হোসেনের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন জুটিতে দিন পার করেছিলেন জাকির, তখনো চতুর্থ দিনে টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা ছিল। তারপরও চট্টগ্রাম টেস্টটা যে পঞ্চম দিনে গেল, তার পেছনে অনেক বড় অবদান জাকিরের ২২৪ বলে ১০০ রানের ইনিংসেরই। সে ইনিংস সুযোগ কাজে লাগানোর উদাহরণ যেমন সৃষ্টি করেছে, তাতে আছে জাকিরের টেম্পারামেন্ট, ধৈর্য আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ছবিও।
টেস্ট অভিষেকের আগে ৬৯টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন। এর চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলে টেস্ট অভিষেকের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে আছে আর মাত্র তিনজনের। আজ দিন শেষে জাকির বলছেন, তাঁর টেম্পারামেন্ট এসেছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা থেকেই, ‘অবশ্যই, প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার কারণে আমি আমার টেম্পারামেন্টটা ধরে রাখতে পেরেছি। ওখানে অনেকগুলো বড় ইনিংস আছে, আবার ছোট ইনিংসও আছে। প্রক্রিয়াটা কিছুটা হলেও আমার আয়ত্তে ছিল।’
বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং নিয়ে একটা সাধারণ প্রশ্ন ঘুরেফিরেই আসে—সমস্যা আদতে কোথায়, দক্ষতা নাকি প্রয়োগে? দল থেকে আসা উত্তরগুলো হয় প্রায় একই। এ টেস্টের দ্বিতীয় দিনও বাংলাদেশ ৮ উইকেট হারানোর পর স্পিন বোলিং কোচ রঙ্গনা হেরাথ বলেছিলেন, আসলে স্কিল বা দক্ষতায় কমতি নেই। তবে ব্যাটসম্যানদের হতে হবে আরও দৃঢ়চেতা।
জাকিরের ব্যাটিং ছিল ঠিক সে রকমই দৃঢ়চেতা। রিস্ট স্পিনে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের একটা দুর্বলতা থাকেই, বাঁহাতি রিস্ট স্পিনার যেন আরও ঝামেলার। কুলদীপ যাদব প্রথম ইনিংসেও যেমন নিয়েছেন ৫ উইকেট। আজও দিনের শেষ দিকে ম্যাচআপ হিসেবে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান সাকিব খেলছিলেন অক্ষর প্যাটেলকে, কুলদীপকে সামলাচ্ছিলেন ডানহাতি মিরাজ।
জাকির বাঁহাতি হয়েও কুলদীপকে সামলেছেন ভালোভাবেই, মুখোমুখি ৪৬ বলে তুলেছেন ২৬ রান, তিনটি চারের পাশাপাশি ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে মেরেছেন একটি ছক্কা। ওই ছয়েই নব্বইয়েও পৌঁছে যান তিনি আজ। একটু পরই চতুর্থ ইনিংসে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অভিষেকেই সেঞ্চুরিও পেয়ে যান।
অবশ্য জাকির বলছেন, খেলাটা টেস্ট ক্রিকেট, এমন ভেবে নিজেকে স্নায়ুচাপে ফেলতে চাননি তিনি, ‘প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যে ধাঁচে খেলার চেষ্টা করেছি, সেটিই মাথায় ছিল। টেস্ট ম্যাচ অনেক বড় খেলা, এ রকম চিন্তা করতে চাইনি। চেষ্টা করেছি যতটা স্বাভাবিক থাকা যায়। ৯০-এ গিয়ে, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সেঞ্চুরির আগে যেভাবে মনোযোগ ধরে রাখি, সেগুলোই চেষ্টা করেছি।’
২০১৮ সালে একটি টি-টোয়েন্টি খেলেই আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিলেন জাকির। তবে মনোবলটা হারাননি, ‘কখনো মনে হয়নি (আমাকে দিয়ে হবে না)। যেটা বললাম, সব সময়ই প্রক্রিয়াটা অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি, নিজেকে সব সময় সাহস দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
জাকির সেঞ্চুরি পেলেও থেমেছেন আর কোনো রান যোগ না করেই। দারুণ এক ইনিংস খেলেও হতাশ ছিলেন। কারণ, ব্যাটিং করতে চেয়েছিলেন আরও কিছুক্ষণ, ‘আউট হওয়ার পর একটু আপসেট ছিলাম। আমি চাইছিলাম দলের জন্য আরও যদি লম্বা ব্যাটিং করা যায়। আজকের দিনটা যদি আমিই পার করতে পারি...।’
জাকির সেটি পারেননি। তাঁর ইনিংস হয়তো টেস্ট বাঁচাতে যথেষ্ট হবে না বাংলাদেশের জন্যও। তবে বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান দেখালেন, কীভাবে সুযোগ কাজে লাগাতে হয়। অনেক দিন অপেক্ষায় থাকতে হলেও অধ্যবসায় থাকলে শেষ পর্যন্ত ফলটা মেলে।