গত ১৯ জানুয়ারি শুরু হয়েছে বিপিএলের দশম আসর
গত ১৯ জানুয়ারি শুরু হয়েছে বিপিএলের দশম আসর

বিপিএলে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের যত অপেশাদার আচরণ

একসময় যে টুর্নামেন্টকে বিসিবিই দাবি করত আইপিএলের পর দ্বিতীয় সেরা, এখন তারাই হতাশ কণ্ঠে বলে, দিন দিন টুর্নামেন্টটাকে টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছে। বিপিএলের এখনকার লড়াইটা তাই ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট-দুনিয়ায় টিকে থাকার।

ফেসবুকে ছবিটা দেখে ধাক্কাই খেতে হলো। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ঢুকেছে দুটি রিকশা ভ্যান। ভ্যানে বোঝাই বিপিএলের এক ফ্র্যাঞ্চাইজি দলের কিট ব্যাগ, আইস বক্স ইত্যাদি! সেই ছবি ফেসবুকে ভাইরাল। ফ্র্যাঞ্চাইজিটির এতে কিছু গেল-এল কি না, জানা নেই, তবে বিপিএলের অবশিষ্ট ভাবমূর্তিটুকু ধূলিসাৎ করতে ওই এক ছবিই যথেষ্ট।

ভ্যান নিয়ে আর ভ্যান-ভ্যান না করে অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। এবার টুর্নামেন্ট শুরুর প্রথম দু-এক দিন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের সামনের চত্বরটাকে আন্তনগর বাসস্ট্যান্ড বলেই মনে হচ্ছিল। ক্রিকেটারদের নিয়ে বড় বড় বাস এসে থামছে। কিন্তু কোনো বাসের গায়েই কোনো দলের ব্র্যান্ডিং নেই। অথচ বিপিএলে সব সময় ফ্র্যাঞ্চাইজিদের বাসগুলোও হয় দেখার মতো। রাজপথে চলা সেসব বাসে দেশি-বিদেশি তারকা খেলোয়াড়দের ছবি আর নানা রঙের সাজ দেখেই মানুষ বলত—ওই যে, অমুক দল যায়।

বিসিবির অন্দরমহলেই বিপিএল এখন একটা নেতিবাচক পরিচয় পেয়ে গেছে—‘পেইন’। সেটা ধরলে বিপিএলের পুরো নাম হওয়া উচিত ‘বাংলাদেশ পেইন লিগ’। তা তো আর বলা যাবে না।

ক্রিকেটারদের সরঞ্জাম ভ্যানে করে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে নিয়ে আসার এই দৃশ্য এখন ভাইরাল

বাংলাদেশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ এই বিপিএল, যেখানে নামীদামি বিদেশি ক্রিকেটাররা খেলতে আসেন। ধারাভাষ্যকক্ষেও থাকেন ভিনদেশি তারকা। প্রতি ম্যাচ শেষে আতশবাজি ফোটে, মাঠে খেলার ফাঁকে ধুমধাড়াক্কা গান বাজে। এবার তো প্রচার-প্রচারণায় নির্দিষ্ট একটা মোটিভও নিয়েছে বিপিএল। রিকশা পেইন্টিংয়ের আদলে করা হয়েছে লোগো, টেলিভিশন সম্প্রচার থেকে শুরু করে টুর্নামেন্টের অন্য সবকিছুতেও থাকছে সেই ছোঁয়া।

কিন্তু বিসিবি এবং টুর্নামেন্টের কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজির অপেশাদারত্বের সুবাদে বিপিএলে এরই মধ্যে যে নেতিবাচকতার কালি লেগে গেছে, এক রিকশা পেইন্টিং দিয়ে তার সব ঢেকে ফেলা যাবে না। একসময় যে টুর্নামেন্টকে বিসিবিই দাবি করত আইপিএলের পর দ্বিতীয় সেরা, এখন তারাই হতাশ কণ্ঠে বলে, দিন দিন টুর্নামেন্টটা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে উঠছে। বিপিএলের এখনকার লড়াইটা তাই ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট-দুনিয়ায় টিকে থাকার লড়াই। সে লড়াইয়ে বিসিবির সহযোদ্ধা ফ্র্যাঞ্চাইজিরা কী ভূমিকা রাখছে, তার একটু নমুনা তো শুরুতেই দেওয়া হলো। এ রকম নমুনা আরও আছে।

মাঠ থেকেই শুরু করা যাক। পুরো ফিট না হয়েও সিলেট স্ট্রাইকার্সে মাশরাফি বিন মুর্তজার খেলা নিয়ে মোহাম্মদ আশরাফুলের তোলা প্রশ্নটাকে মাশরাফি নিজেও এড়িয়ে যেতে পারেননি।

এবারের বিপিএলে অনেকটা স্পিনারদের মতো করে বোলিং করছেন মাশরাফি। তাঁর ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তিনি খেলেই যাচ্ছেন

এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ‘সবকিছু ব্যাখ্যা’ করা যায় না বলে মাশরাফি হয়তো দলের অভ্যন্তরীণ কিছুই ইঙ্গিত করেছেন; কিন্তু একটা প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে কোনো দল কখনোই এ রকম অপেশাদার চিন্তা করতে পারে না। মাশরাফির দুই-তিন কদম দৌড়ে করা বোলিং দেশে আশরাফুলের মনে হয়েছে, এভাবে বিপিএলকে ছোট করা হচ্ছে। কারণ, সারা বিশ্ব দেখছে, বিপিএলে এভাবেও খেলা যায়।

এ রকম ঘটনা মাঠের বাইরেও আছে অনেক। বিপিএলের একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির এক খেলোয়াড় নিজেই আবার বিদেশি খেলোয়াড়দের এজেন্ট। কিন্তু নিজ দলে বিদেশি ক্রিকেটার এনে দেওয়ার পর তিনি যখন দেখলেন, ভালো স্পনসর না থাকায় তাঁর আনা খেলোয়াড়দের ঠিকমতো টাকাপয়সা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে; তিনি তখন নিজেই নেমে পড়েন স্পনসর সংগ্রহে! ফ্র্যাঞ্চাইজিতে নামে ভারী খেলোয়াড় থাকলে সেটা স্পনসরদের এমনিতেই আকৃষ্ট করবে। না করলেও টাকা কোত্থেকে আসবে, সেই চিন্তা ফ্র্যাঞ্চাইজিরই করার কথা। কিন্তু নামে ভারী খেলোয়াড়দেরই যখন একটা ফ্র্যাঞ্চাইজিতে নাম লিখিয়ে এভাবে ‘করে খেতে’ হয়, সেই ফ্র্যাঞ্চাইজির কাজটা তাহলে কী?

আগের বিপিএলে এক ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলোয়াড়দের খেলার জন্য দিয়েছিল মাত্র এক সেট জার্সি। এবার অবশ্য দলের অনুশীলনে গিয়ে খেলোয়াড়ের মাঠভাড়া মেটানোর উদাহরণও সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সর্বশেষ যোগ হয়েছে সিলেটে গিয়ে দলের বিদেশি খেলোয়াড়দের চাপে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির হোটেল বদলানোর ঘটনা। সিলেটে দলের থাকার জন্য প্রথমে যে হোটেলটি নেওয়া হয়েছিল, তাতে থাকা যায়, কিন্তু সেখানে থেকে বিপিএল খেলা যায় না। মানসম্মত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় ক্রিকেটাররা স্বাভাবিকভাবেই হোটেলটিতে থাকতে চাননি। পরে ফ্র্যাঞ্চাইজি ঠিকানা গেড়েছে অন্য হোটেলে।

বিপিএল শুরুর আগে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো আলাদাভাবে অনুশীলন করলেও টুর্নামেন্ট শুরু হতেই সেই মিরপুর একাডেমি মাঠে জটলা পাকিয়েছে

বিপিএলের কলেবর আগেই কমিয়ে ফেলা বিসিবির যেন এসব জোড়াতালিতে কিছুই বলার নেই। তারাও যেন ধরেই নিয়েছে, বিপিএল চলবে এভাবেই। বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিকের কথায়ও বাস্তবতা মেনে নেওয়ার আহ্বান, ‘বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিষয় মেনে না নিয়ে উপায় নেই।’ সঙ্গে অবশ্য একটা আশাবাদও আছে তাঁর কথায়, ‘দেশের ক্রিকেটের জন্যও ফ্র্যাঞ্চাইজিদের কিছু করার আছে, নতুন খেলোয়াড় তুলে আনতে পারে তারা। বড় করপোরেট হাউসগুলো বিপিএলে এলে আশা করি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’

বিপিএল সেই অপেক্ষার আয়ুটা পেলেই হয়। নইলে যেসব ফ্র্যাঞ্চাইজির নিজেদের উন্নতিতেই দৃষ্টি নেই, তাদের কাছে দেশের ক্রিকেটের উন্নতিতে ভূমিকা প্রত্যাশা করা তো মিছে আশা।