কে হবেন নায়ক—স্টিভ স্মিথ, নাকি শামার জোসেফ? ব্রিসবেনে দিবারাত্রির টেস্টের চতুর্থ দিনের খেলা ঘণ্টাখানেক পেরোতে না পেরোতেই এই আলোচনার শুরু। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলার জোসেফ তখন মাত্রই প্রলয়নাচন শুরু করেছেন। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার ‘নতুন’ ওপেনার স্মিথ ধ্যানমগ্ন এক যোগীর মতো নিবিষ্ট চিত্তে ব্যাট করে যাচ্ছেন। আলোচনাটা আরও তুঙ্গে ওঠে রাতের খাবারের বিরতির সময়। জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়া তথা স্মিথের তখন প্রয়োজন ছিল ২৯ রান, আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা জোসেফের লাগে ২ উইকেট।
রাতের খাবারের বিরতি শেষে উইকেটে ফিরে স্মিথ যেন একটু অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। অস্ট্রেলিয়াকে ২০০ রানের ওপারে নিয়ে যেতে তিনি একটা ছয়ও মারলেন আলজারি জোসেফকে। অন্য প্রান্তে নাথান লায়নের উইকেট পড়তে দেখেই হয়তো এই অস্থিরতা ভর করেছিল শান্ত–স্থির স্মিথের। আলজারিকে ছয় মারার পরের ওভারেই বল করতে এলেন টানা বোলিং করে যাওয়া শামার। তাঁর দ্বিতীয় বলে ২ আর চতুর্থ বলে ১ রান নিলেন স্মিথ। হয়তো ভেবেছিলেন ওভারের শেষ দুটি বল সামলে নিতে পারবেন জস হ্যাজলউড।
কিন্তু হ্যাজলউড পারেননি। পঞ্চম বলে হ্যাজলউডের অফ স্টাম্প উড়িয়ে দিয়ে পাখির মতো দুই হাত দুই দিকে মেলে দিয়ে উড়তে চাইলেন শামার। তা তো চাইবেনই, তাঁর ৬৮ রানে ৭ উইকেটেই যে রুদ্ধশ্বাস এই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ৮ রানে হারিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটি যখন জেতে, ধারাভাষ্য কক্ষে ছিলেন কিংবদন্তি ব্রায়ান লারা। লারার সহধারাভাষ্যকার ইয়ান স্মিথ তখন চিৎকার করে বলছেন, ২৭ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট জিতল এক সময়ের পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। হ্যাঁ, ১৯৯৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, শামার জোসেফের তখন জন্মও হয়নি। কিংবদন্তি কার্টলি অ্যামব্রোসের বয়স তখন ৩৪ বছর। ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় অ্যামব্রোসের দুর্দান্ত ফাস্ট বোলিংয়ে ও কোর্টনি ওয়ালশের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সেবারই সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচ জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেঞ্চুরি করেছিলেন ব্রায়ান লারা। এর দুই বছর পর পৃথিবীর আলো দেখেন জোসেফ। সেই জোসেফই ফাস্ট বোলিংয়ের অনন্য এক প্রদর্শনীতে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ২৭ বছর পর টেস্ট ম্যাচে জয় এনে দিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। সেই জোসেফ, আগের দিন ব্যাটিংয়ে মিচেল স্টার্কের ইয়র্কারে ডান পায়ের আঙুলে চোট পাওয়ায় যাঁর বোলিং করারই কথা ছিল না।
টেস্ট শুরুর আগে এমন সমাপ্তি কেউ কল্পনা করেছিলেন কি না সন্দেহ। অ্যাডিলেডে সিরিজের প্রথম টেস্টে তিন দিনের মধ্যে হেরে যাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্রিসবেনে দিবারাত্রির ম্যাচটিতেও সহজেই হেরে যাবে বলে মনে করেছিলেন অনেকেই। প্রথম ইনিংসে ৩১১ রানে অলআউট হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু কেমার রোচ আর আলজারি জোসেফের অসাধারণ বোলিংয়ের পর অস্ট্রেলিয়া তাদের প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে ৯ উইকেটে ২৮৯ রান তুলে। দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৯৩ রানে অলআউট হয়ে গেলে অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্য দাঁড়ায় ২১৬। ২ উইকেটে ৬২ রান তুলে তৃতীয় দিনের খেলা শেষ করা অস্ট্রেলিয়া জয়ের পথেই ছিল।
আজ চতুর্থ দিনেও শুরুটা ভালোই করেছিল অস্ট্রেলিয়া। কোনো উইকেট না হারিয়ে রানটা নিয়ে গিয়েছিল ৯৩–এ। সেই সময় অধিনায়ক ক্রেগ ব্রাফেট বল তুলে দেন শামারের হাতে। প্রথম ওভারে ১০ রান দেওয়ার পর কতটা ফিট তিনি, এই প্রশ্নও জেগেছিল। এই প্রশ্নের উত্তর শামার দিলেন নিজের পরের ওভারে—শেষ দুই বলে গ্রিন ও হেডকে বোল্ড করে দিয়ে। এর মধ্যে হেডকে দুর্দান্ত এক ইয়র্কারে। ওই যে শুরু করলেন, শামার আর থামেননি। রাতের খাওয়ার বিরতির আগে টানা ১০ ওভার বোলিং করেছেন। তুলে নিয়েছেন ৬ উইকেট।
এরপর অস্ট্রেলিয়ার ভরসা হয়ে ছিলেন একমাত্র স্মিথ। দুই জোসেফের দুর্দান্ত বোলিংকে বশ মানানোর চেষ্টা করে সফলও হচ্ছিলেন। ডেভিড ওয়ার্নারের বিদায়ের পর অনেক ‘দেনদরবার’ করে ওপেনার বনে যাওয়া স্মিথ শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ১৪৬ বলে ৯১ রান করে। কিন্তু এমন একটি ইনিংস খেলেও টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনের একটিকে এড়াতে পারেননি। অঘটন কেন, তা বুঝতে সিরিজ শুরুর আগের আলোচনা মনে করিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের তরুণ এই দলকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে দিতে দেখে সাবেক উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান জেফ ডুজনের মনে হয়েছিল, এটা একদল ভেড়াকে কসাইখানায় পাঠানোর মতো হয়ে যাচ্ছে।
ডুজনের কথাটা তখন বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়নি। শামার জোসেফ নামের এক তরুণ যে এই সিরিজে বিশ্ব ক্রিকেটের নতুন এক তারকা হিসেবে আবির্ভূত হবেন, ডুজন তা কীভাবে ভাববেন! কেই–বা তা ভেবেছিলেন!
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ৩১১ ও ১৯৩।
অস্ট্রেলিয়া : ২৮৯/৯ ডিক্লে. ও ৫০.৫ ওভারে ২০৭ (স্মিথ ৯১*, গ্রিন ৪২, স্টার্ক ২১, খাজা ১০, মার্শ ১০, লায়ন ৯; শামার ৭/৬৮, ২/৬২, গ্রিভস ১/৪৬)
ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৮ রানে জয়ী।
সিরিজ: ২ ম্যাচের সিরিজ ১–১ ড্র।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: শামার জোসেফ।
ম্যান অব দ্য সিরিজ : শামার জোসেফ।