দুজনই অফ স্পিনার। পরের পরিচয়টাও এক—দলের প্রয়োজনে দুজনই ব্যাটসম্যান। অর্থাৎ ব্যাটিংয়েও কার্যকর। উচ্চতায়ও পার্থক্য নেই বললেই চলে। দুজনের বাড়িই খুলনায়। মিল আছে নামেও—মেহেদী হাসান! পার্থক্য বলতে একজনের নামের আগে ‘শেখ’, আরেকজনের নামের শেষে ‘মিরাজ’। নেপিয়ারে গত পরশু প্রথম টি-টোয়েন্টিতে তাঁদের ঘিরেই তাৎপর্যপূর্ণ এক ঘটনা দেখল বাংলাদেশ ক্রিকেট।
তাৎপর্যপূর্ণ? ভাবতে পারেন, ম্যাকলিন পার্কে গত পরশু প্রথম টি-টোয়েন্টি জিতে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। তাৎপর্য বলে যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা তো এই জয়—কিউইদের বিপক্ষে তাদেরই মাটিতে প্রথম টি-টোয়েন্টি জয়। এর বাইরে আর এমন কীই-বা ঘটেছে, যেটা আলাদা করে বলার মতো তাৎপর্য বহন করে! তা হলো এই ম্যাচে একাদশে ছিলেন না বাংলাদেশ দলের সহ–অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ। দুই মেহেদীরই ক্রিকেটীয় পরিচয় এক বলে ধরে নেওয়া যায়, দুজনের মধ্যে বেছে নেওয়া হয়েছে শেখ মেহেদীকে।
২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সিলেটে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক (টি-টোয়েন্টি) অভিষেক মেহেদীর। ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল এই সংস্করণে অভিষিক্ত মিরাজ এর আগে খেলেছেন মাত্র ৩টি টি–টোয়েন্টি। এই সংখ্যাটা তাৎপর্যবাহী। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে মিরাজের ধূমকেতূর মতো অভিষেক নিশ্চয়ই মনে আছে।
এ নিয়ে যদি কারও মনে কোনো প্রশ্ন জেগে থাকে, ম্যাচ শেষ হওয়ার পর তা মিলিয়ে যাওয়ার কথা। শেখ মেহেদী হাসান যে ম্যাচসেরা! ১৪ রানে ২ উইকেট নেওয়ার পর রান তাড়ায় নেমে ১৬ বলে ১৯ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে মেহেদী তাঁকে নিয়ে ভ্রুকুটি মিলিয়ে দিয়েছেন। বরং জন্ম দিয়েছেন একটি প্রশ্নের—ঠিক কী বুঝে সহ–অধিনায়ক মিরাজকে বসিয়ে মেহেদীকে খেলানো হলো?
দুই স্পিনিং অলরাউন্ডারের দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার পরিসংখ্যানে তাকিয়ে প্রশ্নটির খুব সহজ একটি উত্তর দেওয়া যায়। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেক মিরাজের। এই ৭ বছরে সবচেয়ে ছোট সংস্করণে খেলেছেন মাত্র ২৫ ম্যাচ। আর ২০১৮ সালে অভিষেক হওয়ার পরও মেহেদী খেলে ফেলেছেন ৩৯টি টি-টোয়েন্টি। তাঁর আন্তর্জাতিক অভিষেকও টি-টোয়েন্টি দিয়ে। আর মিরাজের আন্তর্জাতিক অভিষেক টেস্ট দিয়ে। দুজনের শুরু এবং টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সংখ্যায় একটি ব্যাপার সহজেই বোঝা যায়—মেহেদীকে টি-টোয়েন্টির জন্য যতটা কার্যকর ভাবা হয়, মিরাজকে হয়তো ততটা নয়। দুজনের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করলেও এর পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়।
২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সিলেটে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক (টি-টোয়েন্টি) অভিষেক মেহেদীর। ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল এই সংস্করণে অভিষিক্ত মিরাজ এর আগে খেলেছেন মাত্র ৩টি টি–টোয়েন্টি। এই সংখ্যাটা তাৎপর্যবাহী। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে মিরাজের ধূমকেতূর মতো অভিষেক নিশ্চয়ই মনে আছে। চট্টগ্রাম টেস্টে অভিষেকেই ৭ উইকেট পাওয়ার পর ঢাকা টেস্টে ১২-১৯ উইকেট নিয়ে সিরিজটি নিজের করে নিয়েছিলেন এই অফ স্পিনার। তখন থেকেই মিরাজকে লম্বা সংস্করণের ক্রিকেটার ভাবা হয়েছে। সেটি তাঁর বোলিংয়ের ধরনের সঙ্গেও মানানসই। সে ব্যাখ্যায় পরে আসা যাবে। আগে একটি বিষয় খেয়াল করুন—মেহেদীর আন্তর্জাতিক অভিষেকের আগে মিরাজ ৮টি ওয়ানডে খেলে ফেলেছিলেন। টেস্ট ১২টি। অর্থাৎ টেস্ট ও ওয়ানডে—এ দুটি সংস্করণে মিরাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
নেপিয়ারের ম্যাকলিন পার্কে মিরাজের জায়গায় মেহেদীকে খেলানোর ক্ষেত্রে এই ধরনটা সম্ভবত পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচের আগে নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক মিচেল স্যান্টনার ম্যাকলিন পার্কের ছোট বাউন্ডারি সীমানার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। ব্যাপারটি মাথায় রেখে উত্তরটা মনে মনেই বের করে ফেলা যায়। ছোট বাউন্ডারি সীমানায় মিরাজের ফ্লাইটেড স্পিন ডেলিভারির চেয়ে মেহেদীর একটু জোরের ওপর সোজা সোজা স্পিন বেশি কার্যকর।
এবার মেহেদীর অভিষেকের পরের চিত্রে তাকানো যাক। তাঁর কিন্তু এখনো টেস্ট অভিষেক হয়নি এবং ২০২১ সালের ২০ মার্চ অভিষেকের পর ওয়ানডেতে খেলেছেন ১১ ম্যাচ। টি-টোয়েন্টিতে মেহেদীর অভিষেকের পর মিরাজ এই সংস্করণে খেলেছেন ২২ ম্যাচ—মেহেদীর ৩৯ ম্যাচের তুলনায় যা কম। আবার মেহেদীর আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর মিরাজ ওয়ানডে খেলেছেন ৮৬টি। এটুকু দেখেই তো বোঝা যায়, দুজনের মধ্যে কাকে কোন সংস্করণে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
মিরাজ প্রথাগত অফ স্পিনার। বোলিংয়ে ফ্লাইটের কারুকাজ আছে, তাতে টার্নও পান বেশি। আক্রমণাত্মক বোলার, উইকেট নেওয়াই যাঁর মূল লক্ষ্য। মেহেদীর বোলিংয়ের ধরন একটু আলাদা। বোলার মেহেদীর প্রথম দায়িত্ব হলো রান আটকানো, উইকেট নেওয়ার কাজটা আসে পরে। একটু বেশি গতিতে বল করেন বলে খুব বেশি টার্ন হয়তো পান না, তবে উইকেটে অ্যাঙ্গেলের ব্যবহারে খুব দক্ষ। রান আটকাতে প্রায়ই ডানহাতি ব্যাটসম্যানকে রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে অফ স্টাম্পের বাইরে ইয়র্কার করেন। কিংবা ওভার দ্য উইকেট থেকে পায়ের ওপর জোরে জোরে টানা ইয়র্কারও। পাশাপাশি নতুন বলে ভালো লেংথে স্টাম্প টু স্টাম্প বল করে ব্যাটসম্যানকে আটকে রাখার চেষ্টা করেন। গতি বেশি বলেই মেহেদী নতুন বলে বোলিং করলে তা স্কিড করে। এতে মারতে যাওয়ার আগে ব্যাটসম্যানকে অন্তত একবার ভাবতে হয়। ব্যাটে না পেলেই এলবিডব্লু কিংবা বোল্ডের ঝুঁকি!
নেপিয়ারের ম্যাকলিন পার্কে মিরাজের জায়গায় মেহেদীকে খেলানোর ক্ষেত্রে এই ধরনটা সম্ভবত পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচের আগে নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক মিচেল স্যান্টনার ম্যাকলিন পার্কের ছোট বাউন্ডারি সীমানার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। ব্যাপারটি মাথায় রেখে উত্তরটা মনে মনেই বের করে ফেলা যায়। ছোট বাউন্ডারি সীমানায় মিরাজের ফ্লাইটেড স্পিন ডেলিভারির চেয়ে মেহেদীর একটু জোরের ওপর সোজা সোজা স্পিন বেশি কার্যকর। কারণ, মিরাজের বল টেনে মারার সুযোগ থাকলেও মেহেদীর ক্ষেত্রে তা ঝুঁকিপূর্ণ। আর ম্যাচ যেহেতু টি-টোয়েন্টি, উইকেট নেওয়ার চেয়ে রান আটকানোর গুরুত্বই তো বেশি।
তাঁদের টি-টোয়েন্টি বোলিং পরিসংখ্যানেও একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যায়। মিরাজ তাঁর খেলা ২৫ ম্যাচের মাত্র ৬টিতে পুরো ৪ ওভারের কোটা শেষ করার সুযোগ পেয়েছেন। এই ৬ ম্যাচের মধ্যে ৪টিই এশিয়ার স্পিন–সহায়ক উইকেটে—মিরপুর (১) ও কলম্বো (৩)। দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে মিরাজ বোলিংয়েরই সুযোগ পাননি। এর মধ্যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ কিন্তু ১৭ ওভার বোলিং করেছিল। মেহেদী যে ৩৯টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন, তার ২৪টিতেই পুরো ৪ ওভার বোলিং করেছেন, এতেও তাঁর বোলিংয়ের ওপর অধিনায়কের নির্ভরতা বোঝা যায়।
বোলিংয়ের অন্য সব মানদণ্ডেও টি-টোয়েন্টিতে মেহেদী এগিয়ে। মেহেদীর বোলিং গড় ২৫.৬৫, স্ট্রাইক রেট ২৩.৭। ইকোনমি ৬.৪৭। মিরাজের বোলিং গড় ৩৬.৭৬, স্ট্রাইক রেট ২৬.৭, ইকোনমি ৮.২৪। একটু ব্যাখ্যা করলে যা দাঁড়ায়, তা হলো এই সংস্করণে মেহেদী গড়ে ২৩ বলে উইকেট পেয়েছেন, উইকেটপ্রতি ২৫ রান খরচে। ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন সাড়ে ৬-এরও কম। এই সংস্করণে যা বেশ ভালো। মিরাজের গড়ে ২৭ বলে ১ উইকেট, যা নিতে খরচ প্রায় ৩৭ রান করে। ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন ৮-এর বেশি। এই সংস্করণে বোলার হিসেবে কে বেশি কার্যকর—এ প্রশ্নের উত্তর এখান থেকেই পাওয়া যায়।
তাকানো যাক ব্যাটিংয়ের পরিসংখ্যানে। তার আগে দুজনের ব্যাটিংয়ের বৈশিষ্ট্য একবার মনে করিয়ে দেওয়া ভালো। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে মিরাজ অনেকটাই ‘আ ম্যান ফর অল থিংস’। যেকোনো পজিশন থেকে পরিস্থিতি বুঝে ব্যাট করতে পারেন। লম্বা ইনিংস যে খেলতে পারেন, সেটি তাঁর টেস্ট (১) ও ওয়ানডে (২) শতকেই পরিষ্কার। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে লম্বা ইনিংসের চেয়ে দ্রুত রান তোলা জরুরি। মিরাজ (১১৮.৬৬ স্ট্রাইক রেট) সেখানে মেহেদীর (১০৫.৭০) চেয়ে এগিয়ে থাকলেও শেষ দিকে সাত-আটে নেমে ছোট ছোট ‘ক্যামিও’ খেলতে পারেন।
মিরাজকে সে তুলনায় চোস্ত ব্যাটসম্যান হিসেবেই ভাবা হয় এবং টপ অর্ডারে এখন আর সেই অভাব নেই। ম্যাকলিন পার্কে সম্ভবত সে জন্যই অগ্রাধিকার পেয়েছেন মেহেদী এবং তাঁর ১৬ বলে ১৯ রানের ইনিংসেই বিষয়টি পরিষ্কার।
টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে দুজনই খেলেছেন মাত্র একটি ম্যাচেই। গত বছর এশিয়া কাপে দুবাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মেহেদী ২.২ ওভারে ৩০ রানে নিয়েছিলেন ১ উইকেট। মিরাজ ১ ওভারে ১১ রান দিয়ে উইকেটশূন্য।
আসলে বাংলাদেশ দলে দুজনেরই আলাদা আলাদা ভূমিকা আছে। সহ–অধিনায়ক হয়েও দলে জায়গা না পাওয়ার ব্যাপারটি চমকপ্রদ হলেও তাঁর জায়গায় মেহেদীর সুযোগ পাওয়ায় কিন্তু প্রশ্নের সুযোগ নেই। ম্যাচসেরা মেহেদী নিজেই সে সুযোগ রাখেননি।
টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে দুজনই খেলেছেন মাত্র একটি ম্যাচেই। গত বছর এশিয়া কাপে দুবাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মেহেদী ২.২ ওভারে ৩০ রানে নিয়েছিলেন ১ উইকেট। মিরাজ ১ ওভারে ১১ রান দিয়ে উইকেটশূন্য।