দিল্লিতে অনুশীলনে নিক পোথাসের সঙ্গে লিটন দাস
দিল্লিতে অনুশীলনে নিক পোথাসের সঙ্গে লিটন দাস

ভারত থেকে উৎপল শুভ্র

বায়ুদূষণের শহরে বাংলাদেশের ‘শেষ’ সুযোগ

দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থা দেখে শ্রীলঙ্কা কি একটু সান্ত্বনা পেতে পারে! এই বিশ্বকাপে এমন ব্যাটিং-তাণ্ডব চালানো দক্ষিণ আফ্রিকাই যদি ৮৩ রানে অলআউট হয়ে যেতে পারে, আমাদের আর দোষ কি! ৫৫ রানে অলআউট তো আমরা হতেই পারি।

শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডও এমন ভাববে বলে মনে হয় না। এরই মধ্যে কোচিং স্টাফ ও নির্বাচকদের কাছে ৫৫ রানে অলআউট হয়ে ভারতের কাছে ৩০২ রানে পরাজয়ের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য বিশ্বকাপ শেষ হওয়া পর্যন্ত যেহেতু অপেক্ষা করা হয়নি, ধরেই নেওয়া যায়, বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কা দলে অনেক ওলট–পালট হতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ দলেও কি তেমন কিছু আসন্ন? কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের অবশ্য বড় একটা ঢাল আছে। বিশ্বকাপের মাত্র সাত মাস আগে দায়িত্ব নিয়েছেন মনে করিয়ে দিয়ে যেটির ব্যবহারও তিনি করে ফেললেন। এই বিশ্বকাপে ব্যর্থতার দায় নিচ্ছেন। যদিও এতে সহযাত্রী করে নিচ্ছেন আরও অনেককেই। বিশ্বকাপের পরই তাঁর আসল কাজ শুরু হবে জানিয়ে প্রকারান্তরে এই দাবিও কি করছেন না, তিনি তো সময়ই পাননি।

প্রথম ম্যাচে জেতার পর টানা ছয় ম্যাচে হার। সেই হারও জেতার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা না জাগিয়ে। এই ব্যর্থতার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না হাথুরু। সম্ভাব্য কিছু কারণ তাঁর সামনে তুলে ধরার পরও একই উত্তর দিয়ে গেলেন। প্রত্যাশার চাপে ভেঙে পড়ার একটা সম্ভাবনার কথা অবশ্য বললেন নিজে থেকেই।

অনুশীলনে মেহেদী হাসানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে

সেটাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এখন তো আর কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশ দলের কাছে এখন কারও খুব একটা প্রত্যাশা আছে বলে মনে হয় না। দেখতে দেখতে বাংলাদেশের বিশ্বকাপেও তো শেষের গান। ম্যাচ বাকি আর দুটি। যার প্রথমটিতে আজ সামনে শ্রীলঙ্কা, আগের ম্যাচেই যাদের ওই ৫৫ রানের কলঙ্ক।

শ্রীলঙ্কা দল মাঠে আসতে আসতে বিরাট কোহলি ওয়ানডে সেঞ্চুরিতে শচীন টেন্ডুলকারকে ছুঁয়ে ফেলেছেন। যে ইডেনে তাঁর প্রথম সেঞ্চুরি, সেই মাঠেই ৪৯তম সেঞ্চুরিতে শৈশব-কৈশোরের নায়কের রেকর্ড ছোঁয়া। শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক কুশল মেন্ডিস আগের ম্যাচের ভরাডুবিতে কাতর হয়ে আছেন বলেই কি না, কোহলির রেকর্ড ছোঁয়া সেঞ্চুরি নিয়ে অদ্ভুত এক প্রতিক্রিয়া জানালেন। কোহলিকে অভিনন্দন জানাবেন কি না, প্রশ্ন করায় বললেন, ‘আমি তাঁকে অভিনন্দন জানাতে যাব কেন?’

৫৫-এর প্রভাব হতে পারে, হতে পারে বায়ুদূষণের বিপজ্জনক মাত্রা পেরিয়ে যাওয়া দিল্লিতে খেলতে বাধ্য হওয়ায় কুশল মেন্ডিসের মেজাজ খুব খারাপ। নইলে কোহলিকে অভিনন্দন জানানোর সামান্য সৌজন্যটুকু কেন ভুলে যাবেন!

বায়ুদূষণের দিল্লিতে খেলতে নামলে কী হতে পারে, এ ব্যাপারে শ্রীলঙ্কা দলের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটা এখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য আইসিসির কাছে আবেদন করার খবরটা তাই যথেষ্টই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল। কুশল মেন্ডিস যদিও দাবি করলেন, শ্রীলঙ্কা দল সরাসরি ম্যাচটা অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেনি। ‘বিপজ্জনক’ মাত্রার এই দূষিত বাতাসে খেলার ব্যাপারে আইসিসির অবস্থানটা শুধু জানতে চেয়েছিল। তা আইসিসি কী বলেছে? কী আর বলবে, দিল্লির বাতাস পর্যবেক্ষণ করে যাওয়ার কথা জানানো ছাড়া। কুশল মেন্ডিসের কাছ থেকেই জানা গেল, বাতাস পরিশুদ্ধ করার জন্য মাঠে কী সব যন্ত্রপাতি নাকি বসানো হচ্ছে।

অনুশীলনে মাস্ক পরে বসে শ্রীলঙ্কা অলরাউন্ডার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস

অদ্ভুত এক ক্রিকেট ম্যাচ, যেটির আগে ক্রিকেটীয় সব বিষয়কে আড়ালে ঠেলে দিয়ে বারবার সামনে চলে আসছে বায়ুদূষণ। কত ইতিহাসের সাক্ষী এই দিল্লি। এই উপমহাদেশের কত বাঁকবদলের গল্প লেখা হয়েছে এখানে। শহরটা দেখতেও সুন্দর। সাজানো-গোছানো কিছু কিছু জায়গা তো রীতিমতো অপূর্ব। সেই শহরের বাতাসেই এমন বিষ যে তা বুকে টেনে নেওয়া মানে শুধু সাময়িক অস্বস্তি নয়, দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যাকে আমন্ত্রণ জানানো। অথচ জেনেশুনে সেই শহরেই কিনা নামতে হচ্ছে ওয়ানডের মতো দীর্ঘ এক সময়ের খেলায়। জরুরি অবস্থা চলছে, স্কুল বন্ধ, অথচ ক্রিকেটারদের ঠিকই এর মধ্যে খেলতে হবে। এমনিতেই সমস্যায় জর্জরিত দুই দলকে ব্যাট-প্যাডের সঙ্গে গুছিয়ে রাখতে হচ্ছে ইনহেলারও!

বিশ্বকাপের বৃহত্তর ছবিতে এই ম্যাচের কোনো জায়গাই নেই। এটিকে বলতে পারেন রেলিগেশন জোনের লড়াই। তা বিশ্বকাপে তো এখন একই সঙ্গে দুটি টুর্নামেন্টই চলছে। ওপরে সেমিফাইনালের লড়াই। আর নিচে শেষটা ভালো করার সান্ত্বনা পাওয়ার। শুধুই সান্ত্বনা বলা ঠিক হচ্ছে না। কারণ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার ছাড়পত্র জোগাড় করার একটা ব্যাপারও আছে এখানে। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। নইলে এই ম্যাচগুলোর কোনো মূল্যই থাকত না।

সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জন্য এটি অনেক বড় ম্যাচ। আজ হেরে গেলেও শ্রীলঙ্কার শেষ আটে থাকার সম্ভাবনা একেবারে শেষ হয়ে যাবে না। আর বাংলাদেশ হেরে গেলে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার স্বপ্ন মোটামুটি এখানেই শেষ। অস্ট্রেলিয়া যে ফর্মে আছে, তাতে ১১ নভেম্বর পুনেতে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচটা একটু ভয়ের ব্যাপার হয়েই দাঁড়িয়েছে। এই বিশ্বকাপে দ্বিতীয় জয়ের দেখা পাওয়ার শেষ সুযোগ বোধ হয় আজই।

আগের ম্যাচেই শ্রীলঙ্কার অমন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়াটা অবশ্যই আশা জাগায়। আবার রেকর্ড বলে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে মাঝেমধ্যেই জয় পেলেও তার একটাও বিশ্বকাপে নয়।

আগে কখনো হয়নি বলে এবার হবে না, এমন কোনো কথা নেই। তবে বাংলাদেশ দলের যে অবস্থা, তাতে অমন কিছু আশা করতে অনেক সাহস লাগে। এই দিল্লিতে মুখে মাস্ক না পরে ঘুরে বেড়ানোর মতো সাহস!