জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেট মানে ব্যাটিং উদ্যান, খেলা হচ্ছে সেখানেই। টেস্টের প্রথম দিনে প্রচণ্ড রোদ সাগরপারের মাঠে ছড়িয়েছে ৩৬ ডিগ্রির গা পোড়ানো তাপমাত্রা। প্রতিপক্ষের নাম দক্ষিণ আফ্রিকা, টসে জিতে তারা আবার নিয়েছে ব্যাটিং। বাংলাদেশ টেস্টটা খেলছে চার বিশেষজ্ঞ বোলার নিয়ে।
প্রথম তিন তথ্যে চমক নেই। চট্টগ্রামের উইকেট কেমন হয়, সেটা ক্রিকেট অনুসারী মাত্রেরই জানা থাকার কথা। এমনও হয়েছে, এখানে টেস্টের দিন যত গেছে উইকেট তত ব্যাটিংবান্ধব হয়েছে। চট্টগ্রামে প্রচণ্ড গরম পড়ছে কয়েক দিন ধরে এবং এটাও আগে থেকেই জানা যে আজ শুরু টেস্টের পাঁচ দিনে আবহাওয়ায় হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা কম।
আর দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংটা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের বোলিং সামর্থ্যের চেয়ে বেশ এগিয়ে। এই দলটা হয়তো নয়, তবে এ মাঠেই ২০০৮ সালের এক টেস্টে ২০৫ রানে জেতা দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ ও নিল ম্যাকেঞ্জি মিলে গড়েছিলেন ৪১৫ রানের ওপেনিং জুটি, ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন দুজনই।
আজ সে রকম কিছু না হলেও প্রথম দিনটা যেখানে গিয়ে শেষ হলো, সেখান থেকেও বড় কিছুর আশা নিশ্চয়ই করছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ২ উইকেটে ৩০৭ রান, সেটাও আলোকস্বল্পতায় ৯ ওভার কম হওয়া দিনে। দিনের শেষ ওভারটা অবশ্য বাংলাদেশ করেছে নতুন বলে। আগামীকাল সকালে যদি বলটাকে ঝলসিয়ে তোলা যায়, এটাই এখন আশা।
বিস্ময়কর হলো, ইতিহাস ও বর্তমান দুটোই প্রতিকূলে রেখে বাংলাদেশ টেস্টটা খেলছে মাত্র চার বিশেষজ্ঞ বোলার নিয়ে। দুই পেসার হাসান মাহমুদ ও নাহিদ রানার সঙ্গে দুই স্পিনার তাইজুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান মিরাজ। প্রচণ্ড গরম আর ব্যাটিং উইকেটে হাতে যথেষ্ট বোলার না রাখাটা ঠিক হলো কি না, প্রথম দিন শেষে নিশ্চয়ই ড্রেসিংরুমে বাড়তি চিন্তার খোরাক হয়েছে প্রশ্নটা।
দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে কোচ ফিল সিমন্স অবশ্য বলেছেন, এসব কিছু বিবেচনায় রেখেই নাকি তাঁরা একাদশ ঠিক করেছিলেন। সে যা–ই হোক, নাজমুল হোসেনের বোলিং ভান্ডারে যে যথেষ্ট অস্ত্র নেই, সেই লক্ষণ দেখা গেছে ইনিংসের ৫৪তম ওভারেই। তৃতীয় স্পিনার হিসেবে মুমিনুলকে আনতে বাধ্য হয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। যদিও মাত্র ৪ ওভারই সাহায্য করতে পেরেছেন মুমিনুল। দুই পেসার করেছেন ১৩ ওভার করে। বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ৩০ ও মিরাজকে হাত ঘোরাতে হয়েছে ২১ ওভার।
এ রকম কন্ডিশনে দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানদের ভুলের অপেক্ষায় বসে থাকা ছাড়া আর উপায় কী বাংলাদেশের! তা দক্ষিণ আফ্রিকা ভুল করলও। কিন্তু সারা দিনে করা তাদের চারটি ভুলের মধ্যে বাংলাদেশের ফিল্ডাররা মাত্র একটিরই সুযোগ নিতে পেরেছেন।
বোলারদের হতাশার দিনে বড় জুটির দিকে এগোচ্ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার দুই ওপেনার এইডেন মার্করাম ও টনি ডি জর্জি। ৩৩ রান করার পর হঠাৎই তাইজুলের হাওয়ায় ওড়ানো এক বলে ডাউন দ্য উইকেটে এসে খেলতে গিয়ে মিড অনে মুমিনুলের হাতে ক্যাচ তুলে দেন মার্করাম (৩৩)।
এর আগে প্রথম সুযোগটা দিয়েছিলেন ডি জর্জি। কিন্তু হাসানের বল তাঁর ব্যাটের কানায় লেগে চলে যায় খুলনায় জাতীয় লিগের ম্যাচ থেকে উড়ে এসে অভিষেক টেস্ট খেলতে নামা উইকেটকিপার মাহিদুল ইসলামের পাশ দিয়ে। তিনে নামা ত্রিস্তান স্টাবসকেও জীবন দিয়েছেন মাহিদুল। ব্যক্তিগত ২৫ রানে তাইজুলের টার্নে পরাস্ত স্টাবসকে স্টাম্পিং করার সুযোগ হাতছাড়া করেন তিনি। ৪১তম ওভারে জর্জি আরেকবার বেঁচে যান আউট হওয়ার হাত থেকে এবং এবারও হাসানের বলে। প্রথম স্লিপে দাঁড়ানো সাদমান ইসলামের ঠিক সামনেই পড়ে ডি জর্জির ব্যাট ছুঁয়ে যাওয়া বলটা।
যে দুই ব্যাটসম্যানকে বাংলাদেশ এই তিন সুযোগ দিল, তাঁরা দুজনই নতুন জীবন উদ্যাপন করেছেন টেস্টে নিজেদের প্রথম সেঞ্চুরি করে। দ্বিতীয় উইকেটে ডি জর্জি–স্টাবসের জুটিটা ২০১ রানের। ১০৬ রান করে শেষ সেশনে তাইজুলের কিছুটা নিচু হয়ে আসা এক বলে স্টাবস বোল্ড হয়ে গেলেও ডি জর্জি খেলেই যাচ্ছিলেন। দিন শেষ ২১১ বলে ১৪১ রান করে এখন আরও বড় কিছুর অপেক্ষায় তিনি।
প্রথম সেশনে ১ উইকেট হারিয়েই ১০৯ রান করে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। মার্করাম উইকেট দিলেও সেটা তাঁর ভুলে। বাংলাদেশের বোলাররা কোনো রকম প্রভাবই বিস্তার করতে পারেননি ব্যাটসম্যানদের ওপর। বিশেষ করে দুই সেঞ্চুরিয়ান তাঁদের হাতে থাকা কোনো শটই খেলতে বাকি রাখেননি। স্পিনারদের বল টার্ন করলেও ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্তিতে ফেলার মতো অতটা নয়। এই সুযোগ সুইপ-রিভার্স সুইপগুলো খুব স্বচ্ছন্দে খেলেছেন ডি জর্জি ও স্টাবস।
সুযোগ পেলে আক্রমণাত্মকও হয়েছেন। জর্জির ইনিংসেই যেমন ১০ বাউন্ডারির সঙ্গে ৩ ছক্কা। ৬ বাউন্ডারির সঙ্গে ৩ ছক্কা স্টাবসেরও। এমনকি জর্জির সঙ্গে ১৮ রানে অপরাজিত ডেভিড বেডিংহামেরও ২৫ বলের ইনিংসে দুই ছক্কা মারা হয়ে গেছে।
দিন শেষে স্টাবস যদিও বলেছেন, বল নরম হয়ে আসায় সারা দিনে মধ্যাহ্নবিরতির পরই কেবল ব্যাটিং করতে একটু সমস্যা হচ্ছিল, দ্বিতীয় সেশনে কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেট পড়েনি একটিও। ততক্ষণে জর্জি পৌঁছে যান তিন অঙ্কে, ৬৫ রানে খেলছিলেন স্টাবস। দুজনের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে তখনই দক্ষিণ আফ্রিকার রান ২০৫। শেষ সেশনে স্টাবসের উইকেটটি হারিয়ে তারা যোগ করেছে আরও ১০২ রান।
দক্ষিণ আফ্রিকা ১ম ইনিংস: ৮১ ওভারে ৩০৭/২
(ডি জর্জি ১৪১*, স্টাবস ১০৬, মার্করাম ৩৩, বেডিংহাম ১৮*; তাইজুল ২/১১০)।
* ১ম দিন শেষে