প্রতিপক্ষের উইকেট না পড়লে স্টাম্পের বেল দুটোর জায়গা অদল–বদল করতেন স্টুয়ার্ট ব্রড
প্রতিপক্ষের উইকেট না পড়লে স্টাম্পের বেল দুটোর জায়গা অদল–বদল করতেন স্টুয়ার্ট ব্রড

১০ বছর আগেই ‘বেল ট্রিক’ শুরু না করার আক্ষেপ ব্রডের

ক্রিকেটে সবকিছুরই প্রমাণ লাগে। চার–ছক্কা থেকে যেকোনো আউট। নিশ্চিত হতে ক্যামেরার ব্যবহারও নতুন কিছু না। তবু মাঠের মধ্যে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা হয় না। বারবার ভিডিও ফুটেজ দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, কীভাবে!

স্টুয়ার্ট ব্রড একজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ক্রিকেটার। কথাটা ইতিবাচক অর্থে বলা। এসব আছে বলেই তো, কাল ব্রড ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলে ফেলার পরও এসব নিয়ে কথা হচ্ছে। এমন কাউকে আর কখনো দেখা যাবে না! আর ব্রড? শেষ টেস্টেও দিয়েছেন বিনোদন। শেষ শটে ছক্কা আর শেষ বলে উইকেট—শুধু এসব ভাবলে ভুল হবে।

ব্রড সে জন্য কারও কারও চোখে হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ক্রিকেটার, তবে কেউ কেউ তাঁকে ‘ব্ল্যাক আর্টের চর্চা করেন’ বলেও অভিযোগ তুলতে পারেন।কেন? ভেবে দেখুন, প্রতিপক্ষের উইকেট পড়ছে না। এ অবস্থায় বোলিংয়ে এসে বল করার আগে নন–স্ট্রাইক প্রান্তের স্টাম্পের বেল দুটোর জায়গা অদল–বদল করলেন এবং তারপর উইকেট পেলেন। সেটাও একবার নয়, এক টেস্টে দু–দুবার! ক্রিকেট–পণ্ডিত থেকে ভাগ্য গণনার পণ্ডিতও এর ব্যাখ্যা দিতে পারবেন না।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন, ঘটনাটা কাল শেষ হওয়া ওভাল টেস্টের। দ্বিতীয় দিনে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে সেই ঘটনাও নিশ্চয়ই মনে আছে? দেড় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে উইকেট ফেলতে পারছিল না ইংল্যান্ড। মারনাস লাবুশেন ৯ রান করতে ৮০–এর বেশি বল খেলে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন ইংল্যান্ডের সামনে এখন ‘চীনের প্রাচীর।’ ঠিক তখনই ‘ম্যাজিক’টা দেখান স্টুয়ার্ট ব্রড। ৪৩তম ওভারে মার্ক উডের চতুর্থ বলের পর লাবুশেন যে প্রান্তে দাঁড়িয়ে, সেখানে গিয়ে স্টাম্পের মাথার ওপর বেলসের জায়গা অদল–বদল করেন ব্রড। লাবুশেন তা দেখে অবাক হয়েছেন, উসমান খাজার দিকে তাকিয়ে হেসেছেন, যেন বোঝাতে চেয়েছিলেন, এসব তুকতাক কুসংস্কারে আর কীই–বা হবে! বেচারা লাবুশেন। উডের পরের বলেই রুটকে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন!

অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসের ঘটনা তো আরও চমকে দেওয়ার মতো। কাল শেষ দিনে জয়ের জন্য তখনো ৯০ রান দরকার অস্ট্রেলিয়ার। ক্রিজে অ্যালেক্স ক্যারির সঙ্গে যোগ দেন ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান টড মার্ফি। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, ইংল্যান্ডের জয় স্রেফ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু দেরি করিয়ে দিচ্ছিল মার্ফি ও ক্যারির ৫৮ বলে ৩৫ রানের জুটি। অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্যও নেমে এসেছিল ৫৫ রানে। অর্থাৎ মার্ফি–ক্যারির দৃঢ়তায় অস্ট্রেলিয়ার সেখান থেকে জয়ের সম্ভাবনাও জেগেছিল। আর সকাল থেকে ভালো বোলিং করেও উইকেট পাননি। অস্ট্রেলিয়ানদের অনেকবার ‘বিট’ করলেও ব্যাটের কানা ছোঁয়াতে পারেননি।

বেল অদল–বদল করার পরের বলেই টফ মার্ফিকে আউট করেছেন স্টুয়ার্ট ব্রড

ইংল্যান্ড অধিনায়ক বেন স্টোকস তখন জুটি ভাঙতে মরিয়া। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় সেশনে ভালো বোলিং করেও উইকেট না পাওয়া ব্রডের হাতে তুলে দেন বল। প্রথমে পাঁচটি বল করলেন, এর মধ্যে শেষ দুই বলেই ‘বিট’ হন ক্যারি। মরিয়া ব্রড এরপর দ্বারস্থ হলেন তাঁর সেই কুসংস্কার–ঝুলির। নন–স্ট্রাইকারের প্রান্তের স্টাম্পের বেলসের জায়গা অদল–বদল করলেন। ব্যস, পরের বলেই উইকেট! যে ব্রড সারা সময় ধরে ব্যাটসম্যানদের ব্যাটের কানার খোঁজ পাননি, সেই একই বোলার ‘বেল ট্রিক’ করে পরের বলেই উইকেট পেলেন, সেটাও ব্যাটের কানা ছুঁয়ে যাওয়া ক্যাচ! এর কোনো ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা হয়?

অস্ট্রেলিয়ার শেষ উইকেটটিও নিয়েছেন ব্রড। সেটাও ব্যাটের ছুঁয়ে যাওয়া ক্যাচেই। তাঁর ভক্তরা চাইলে এই প্রশ্নটা তুলতে পারেন—ইংল্যান্ডকে ওভালে জিতিয়েছেন কে? তারপর ব্যাখ্যায় দাবি করতে পারেন, ৮ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও মার্ফি–ক্যারির দৃঢ়তায় অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে ভালোভাবেই টিকে ছিল। সেখান থেকে যেকোনো কিছুই হতে পারত। কিন্তু সেটা হতে দেননি ব্রড। কীভাবে? ওই তো, স্টাম্পের বেলসের জায়গা অদল–বদল করে। বলুন, এর কোনো ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা হয়!

ব্যাখ্যা নেই ব্রডের কাছেও। ওভালে জেতার পর এই ‘বেল ট্রিক’ নিয়ে তাঁর আক্ষেপ, ‘সত্যি বলতে আমি শুধু এই ম্যাচেই বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি। ইশ! যদি এটা ১০ বছর আগে থেকে শুরু করতাম!’ ব্রড আসলে বোঝাতে চেয়েছেন, বেলসের জায়গা অদল–বদল করার কুসংস্কারটি ১০ বছর আগে শুরু করলে নিশ্চয়ই আরও বেশি উইকেটের দেখা পেতেন। তবে ব্রডের এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন কৌশল কিন্তু ধার করা। মনে আছে, অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে লাবুশেনকে ওভাবে আউট করার পর সংবাদমাধ্যমকে কী বলেছিলেন—‘আমি শুনেছি, অস্ট্রেলিয়ানরা এভাবে ভাগ্য পাল্টানোর চেষ্টা করে। নাথান লায়নকে এটা করতে দেখেছি।’

ইংল্যান্ডকে জেতানোর সুখস্মৃতি নিয়ে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়াকে বিদায় বলেছেন স্টুয়ার্ট ব্রড

ব্রড সেদিন আরও একটি ঘটনা জানিয়েছিলেন। লাবুশনকে ফেরানোর আনন্দটা অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার উসমান খাজার সঙ্গে ভাগ করে নিতে তাঁর দিকে হাসিমুখে এগিয়ে গিয়েছিলেন ব্রড। হ্যাঁ, সম্ভবত শুধু ব্রডই এমন করতে পারেন! কিন্তু চোখের সামনে যা ঘটেছে, তা দেখার পর ব্রডকে নিয়ে খাজার মনে সম্ভবত ভয় ঢুকে গিয়েছিল। ইংল্যান্ড কিংবদন্তি জানিয়েছেন, খাজা তাঁকে পইপই করে বলেছেন, ‘আমার (স্টাম্পের) বেলস ছুঁলে কিন্তু সেগুলো আবার জায়গামতো বসিয়ে দেব।’ তবে খাজা কিন্তু পার পাননি। লাবুশেনের পর ৫১.৫ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার হারানো পরের উইকেটটি খাজা!

লায়নকে কেউ এমন কথা বলেছেন কি না, তা জানা যায়নি। ব্রডের মতো অস্ট্রেলিয়ান স্পিনারও একাধিকবার ‘বেল ট্রিক’ করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা সম্ভবত ২০১৯ অ্যাশেজে। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ইংল্যান্ড ২ উইকেটে ১৬৩ রানে ব্যাট করছিল। ক্রিজে ররি বার্নস ও জো রুট। লায়ন গিয়ে নন–স্ট্রাইক প্রান্তে বেলসের জায়গা অদল–বদল করে বসান। বার্নস এরপর ২ রান করে আউট, রুট ৩!

‘বেল ট্রিক’ কৌশল শুধু অস্ট্রেলিয়ানদের বললে ভুল হবে। ইংল্যান্ডের ক্লাব ক্রিকেট কিংবা ভিলেজ ক্রিকেটে এটা বহু আগের কুসংস্কার। ইংলিশরা নিশ্চয়ই এখন আর এই ‘সংস্কার’–এর সঙ্গে ‘কু’ শব্দটা যোগ করতে চাইবে না। ১৬৭ টেস্টে ৬০৪ উইকেট নেওয়া কোনো ক্রিকেটারের পাশে ওই শব্দ যে বেমানান।