উৎপল শুভ্রর লেখা

তাহলে সাকিব ছাড়া আর উপায় কী

ওয়ানডে বিশ্বকাপের ঠিক দুই মাস বাকি। যে ১০টি দেশ খেলবে এই বিশ্বকাপে, তাদের দল গোছানো প্রায় শেষ। ‘প্রায়’ শব্দটা রাখতে হচ্ছে কোনো কোনো দল একটি/দুটি জায়গা নিয়ে একটু সংশয় আছে। যে সংশয় বাংলাদেশেরও আছে। তবে একটা ক্ষেত্রে বিশ্বকাপের বাকি নয় দল থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ একেবারেই অনন্য। বিশ্বকাপের দুই মাস আগে আর কোনো দলকে এমন একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হচ্ছে না, যেটিকে বলা যায় ‘কোটি টাকার প্রশ্ন’। বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করবেন কে?

হঠাৎ চোটে পড়ে বা অন্য কোনো কারণে গুরুত্বপূর্ণ কোনো খেলোয়াড়কে ছিটকে পড়তে আগেও অনেক দেখেছে বিশ্বকাপ। কিন্তু বিশ্বকাপের দুই মাস আগে সর্বশেষ তিন বছরের অধিনায়ককে সরে দাঁড়াতে কি দেখেছে কখনো? না, দেখেনি। তামিম ইকবাল একটা রেকর্ডই করে ফেললেন বটে!

কাছাকাছি একটা উদাহরণ অবশ্য পাওয়া যায়। ২০১৫ বিশ্বকাপের দুই মাসেরও কম বাকি থাকতে ইংল্যান্ড দলের অধিনায়ক বদলে গিয়েছিল। তবে অ্যালিস্টার কুক নিজে অধিনায়কত্ব ছাড়েননি। ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের নতুন যাত্রা শুরুর সারথি হিসেবে এউইন মরগানকে বেছে নিয়ে কুককে দল থেকেই বিদায় করে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের নির্বাচকেরা। সেই বিশ্বকাপে ভরাডুবি হলেও চার বছর পর, ২০১৯ বিশ্বকাপ জিতেছিল ইংল্যান্ড। অধিনায়কের নাম? এউইন মরগান।

বিশ্বকাপের আগে অধিনায়ক বদলের সময়টা মিলে যাওয়ায় ঘটনাটা মনে পড়ল। সময়টা মিলে যাচ্ছে, তবে প্রেক্ষাপট যে আলাদা, তা তো বুঝতেই পারছেন। ইংল্যান্ডের নির্বাচকেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন, অ্যালিস্টার কুককে দিয়ে আর হবে না। ওয়ানডেটা অন্যভাবে খেলা দরকার, যাতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যোগ্য লোক এউইন মরগান। বাংলাদেশের ঘটনা তা নয়। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান এত দিন যা বলে এসেছেন, গতকাল সন্ধ্যায়ও আবার তা বললেন। বিশ্বকাপে তামিম ইকবালকেই অধিনায়ক হিসেবে চেয়েছিল বিসিবি। অন্য কারও কথা কখনো চিন্তাই করা হয়নি।

বিসিবি সভাপতির সঙ্গে কিছুদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে তামিম। ছেড়েছেন ওয়ানডে অধিনায়কত্ব

এখন তা করতে হচ্ছে। যদিও কেউ বলতেই পারেন, এটা তো পুরোনো খবর। গত ৬ জুলাই তামিম ইকবাল যখন নাটকীয়ভাবে অবসর ঘোষণা করলেন, তখনই তো বিশ্বকাপে নতুন অধিনায়ক খোঁজার ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে আরেকজন ওপেনার খোঁজাও। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে পরদিনই অবসরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে ফেলায় অবশ্য দুটি ‘প্রকল্প’ই বাতিল বলে ধরে নিয়েছিলেন সবাই। তামিম যখন অবসর নিচ্ছেন না, তাহলে তিনিই তো অধিনায়ক থাকছেন। তামিম যে ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেবেন—এটা ভাবেননি বলেই দাবি করছেন বিসিবির সভাপতি। যে দাবিকে সত্যি মনে না করার কোনো কারণ নেই। তামিম অবসরের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় একটা লাভ অবশ্য হয়েছে। বিসিবির শুধু নতুন অধিনায়ক বেছে নিলেই চলছে, আরেকজন ওপেনার খুঁজতে হচ্ছে না।

তিন বছর ওয়ানডে দলটা গুছিয়ে নেওয়ার পর বিশ্বকাপের আগে তামিমের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়াটা অবশ্যই অবাক করার মতো। যদিও কারণ হিসেবে যা বলছেন, সেটিকে সত্যি বলে ধরে নিলে অবাক হওয়ার মাত্রাটা একটু কমে। পিঠের নিচের দিকে, কোমরের ঠিক ওপরে যে চোটে আক্রান্ত তিনি, তা তখন যে কেমন আচরণ করবে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। অধিনায়ক এমন অনিশ্চিত থাকলে তা পুরো দলেই প্রভাব ফেলতে বাধ্য। বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দেওয়ার যে স্বপ্ন দেখেন সব ক্রিকেটার, তামিমের তা এভাবে বিসর্জন দেওয়ার কারণটা তাই বোঝাই যায়।

আসলেই কি যায়? তাহলে গত মার্চে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ শেষ হওয়ার রাতে তামিম ইকবাল চট্টগ্রামে তাঁর হোটেল রুমে এই প্রতিবেদককে কেন বলেছিলেন, ‘দেখে নেবেন, বিশ্বকাপে আমি অধিনায়ক থাকব না।’ তিনি নিজে ছেড়ে দেবেন, নাকি বিসিবিই তাঁকে সরিয়ে দেবে—এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেননি। শুধু বলেছিলেন, ‘কীভাবে হবে, জানি না। তবে বিশ্বকাপে আমি অধিনায়ক থাকব না।’ তামিম নিজে যেহেতু কিছু বলেননি, কারণটা তাই শুধু অনুমানই করা যায়। অধিনায়ক হিসেবে প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি বলে একটা দুঃখ ছিল। চোটে জর্জর শরীর, ব্যথায় কাতর—অথচ তাঁর চোট নিয়ে সবার সংশয়!  নিশ্চিতভাবেই তামিমের মনে তা খুব লেগেছিল। হয়তো এ নিয়ে কোচের আচরণেও। 

চোট নিয়ে বিতর্ক হওয়ায় দুঃখ পেয়েছিলেন তামিম

অথচ বছরখানেক আগেও বিশ্বকাপ নিয়ে স্বপ্নের কথা শুনেছি তামিমের মুখে। বিশ্বকাপে গিয়ে ট্রফির দাবি জানাতে চেয়েছিলেন। যে কারণে বলেছিলেন, ‘আমরা যদি ওডিআই লিগে টপ ফোরে শেষ করি, তারপর আমি বা অন্য যেকোনো যদি কেউ ২০২৩ ওয়ার্ল্ড কাপে গিয়ে বলে, “আমরা এখানে ট্রফি জিততে এসেছি”; হোক না হোক, এটা সবাইকে মানতে হবে।’ বাংলাদেশ শেষ করেছিল তিন নম্বরে। তারপরও বিশ্বকাপে টস করতে নামার স্বপ্নটা অবলীলায় বিসর্জন দিয়ে দিলেন তামিম।

তা না হয় দিলেন; কিন্তু বড় একটা পরীক্ষায়ও তো ফেলে দিলেন দলকে। বিসিবিকে বোধ হয় তার চেয়েও বেশি।  বিশ্বকাপে সম্ভাব্য অধিনায়ক হিসেবে দুটি নামই এখন মুখে মুখে ফিরছে। একজন অধিনায়ক হিসেবে পরীক্ষিত। যাঁকে ‘মাঠে ট্যাকটিক্যালি বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক’ মনে করেন তামিম নিজেই। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতে অধিনায়ক বলে কোচ আর সাপোর্ট স্টাফদের সঙ্গে বোঝাপড়ারও সমস্যা নেই। বিশ্বকাপে অধিনায়কত্বও যাঁর জন্য নতুন কিছু নয়। সাকিব আল হাসান তো সেই ২০১১ সালেই তা করে রেখেছেন।

লিটন কুমার দাসের নামটা আসছে তিনি ওয়ানডে দলের সহ-অধিনায়ক বলে। সেটি তো তাঁকে ভবিষ্যৎ অধিনায়ক ভাবা হয়েছে বলেই। সেই ‘ভবিষ্যৎ’ যে এত তাড়াতাড়ি ‘বর্তমান’ হয়ে যেতে চাইবে, তা তো আর কেউ ভাবেনি। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় একটাই—বিশ্বকাপের মতো এত বড় আসরে সাকিবের মতো পোড় খাওয়া পরীক্ষিত অধিনায়ককে বেছে নেবে বিসিবি, নাকি দীর্ঘ মেয়াদের কথা চিন্তা করে লিটনের মতো অধিনায়কত্বে নবীন একজনকে?

বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে লিটন দাস ও সাকিব আল হাসান

খেলার পাতায় সাবেক চার ক্রিকেটার ও ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের লেখা পড়লে দেখবেন, তাঁরাও দ্বিধাবিভক্ত। সেটি দুজনের পক্ষেই যুক্তি আছে বলেই। তবে বিশ্বকাপের মতো মহাচাপের আসরে লিটনকে অধিনায়ক বানিয়ে পাঠানোটা তাঁর প্রতি হয়তো একটু অবিচারই হবে। ব্যাটসম্যান লিটনকে হারিয়ে ফেলার ভয়ও আছে তাতে। সাকিব আল হাসানকে জীবনের শেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিজের ছাপ রেখে যাওয়ার সুযোগ দেওয়াটাই তো মনে হচ্ছে ভালো, কী বলেন?