সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম

‘ওরা অনেক ক্ষমতাশালী, চাইলেই বাদ দেওয়া যায় না’

এবারের বিশ্বকাপটাকে স্মৃতি থেকে মুছেই ফেলতে চাইবেন বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়েরা। ৯ ম্যাচে মাত্র ২ জয়, এমন বিশ্বকাপ ভুলে যেতে চাওয়াই তো স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশের একজন অন্তত এই বিশ্বকাপটাকে মনে করবেন সব সময়। তিনি কোনো ক্রিকেটার নন। ভারত বিশ্বকাপের পাঁচটি ম্যাচে মাঠে থেকে ম্যাচ পরিচালনা করা আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ।

ক্রিকেটারদের মাঠের পারফরম্যান্স যতটা সমালোচিত, প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার হিসেবে বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং করা শরফুদ্দৌলার পারফরম্যান্স ঠিক ততটাই প্রশংসিত। এর আগে সর্বশেষ দুই এশিয়া কাপে আম্পায়ারিং করে প্রশংসিত হয়েছেন বাংলাদেশের আরও দুই আম্পায়ার মাসুদুর রহমান ও গাজী সোহেল। বড় পর্যায়ে সুযোগ পেলে যে বাংলাদেশের আম্পায়াররাও দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারেন, তার উদাহরণ এই তিন আম্পায়ার।

তবে প্রদীপের নিচেই আছে অন্ধকার। এত দিন ক্লাব ক্রিকেটে আম্পায়ারিং নিয়ে যে সমালোচনা ছিল, এবার সেটার ব্যাপ্তি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও ছড়িয়ে পড়েছে। ক্লাব ক্রিকেটে আম্পায়ারিং নিয়ে অভিযোগটা মূলত পক্ষপাতিত্বের। আর এবারের জাতীয় লিগে বিতর্কটা কিছু আম্পায়ারের এই পর্যায়ের ম্যাচ পরিচালনায় অযোগ্যতার কারণে। বাজে সিদ্ধান্ত তো আছেই, অনেক আম্পায়ারের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে মাঠ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও।

ক্রিকেটারদের অভিযোগ, এই আম্পায়ারদের অনেকেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ম্যাচ পরিচালনার যোগ্য নন। এক ক্রিকেটার তো খেলার মধ্যেই এক আম্পায়ারের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আপনি যেখান থেকে আসছেন, সেই ফার্স্ট ডিভিশনে ফিরে যান। এখানে কেন আসছেন?’

ক্রিকেটারদের অভিযোগ, এই আম্পায়ারদের অনেকেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ম্যাচ পরিচালনার যোগ্য নন। এক ক্রিকেটার তো খেলার মধ্যেই এক আম্পায়ারের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আপনি যেখান থেকে আসছেন, সেই ফার্স্ট ডিভিশনে ফিরে যান। এখানে কেন আসছেন?’ মুখের ওপর এমন কথা শুনে লজ্জার হাসি হাসা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না ওই আম্পায়ারের। আরেক আম্পায়ার নাকি এক বোলারের এলবিডব্লুর আবেদনের জবাবে বলেছেন, ‘আমি তো বলই দেখিনি!’ এমনও শোনা গেছে, বোলাররা আবেদন করার সময় বারবার উইকেটের মাঝের অংশে চলে আসছেন, অথচ আম্পায়ার কিছুই বলছেন না। বোলার, ফিল্ডারদের আবেদনের চাপেও অনেক ভুল সিদ্ধান্ত দেওয়ার অভিযোগ আছে।

দেশের প্রধান প্রথম শ্রেণির আসরে আম্পায়ারিংয়ের এমন নিম্নমান দেখে জাতীয় দলে খেলা এক ক্রিকেটার বলেছেন, ‘দেখেই মনে হয়, তাদের এই পর্যায়ের ম্যাচ পরিচালনা করার সামর্থ্য নেই।’ জাতীয় লিগের এক কোচ বাজে আম্পায়ারিংয়ের অন্য একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও তুলে ধরলেন, ‘নির্বাচকেরা জাতীয় লিগের পারফরম্যান্স দেখে টেস্ট দলের খেলোয়াড় বাছাই করেন। সেই জাতীয় লিগের আম্পায়ারিং যদি এমন হয়, তাহলে টেস্ট ক্রিকেটের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে, ভেবে দেখুন।’

দেখেই মনে হয়, তাদের এই পর্যায়ের ম্যাচ পরিচালনা করার সামর্থ্য নেই।

সমস্যা হলো, প্রতিদিনের খেলা শেষে দলগুলোর পক্ষ থেকে দেওয়া ক্যাপ্টেনস রিপোর্টে বেশির ভাগ সময়ই বাজে আম্পায়ারিং নিয়ে কোনো অভিযোগ করা হয় না। কখনো অভিযোগ হলেও হয় দায়সারাভাবে। অধিনায়কের হয়ে দলের কেউ একজন একটা কিছু লিখে দেন, অধিনায়ক অনেক সময় না দেখেই সই করে দেন তাতে।

এবারের জাতীয় লিগের প্রথম পাঁচ রাউন্ডে রিজার্ভ আম্পায়ারসহ মোট ৩৫ জন আম্পায়ার ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। এবারই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে চারজনের। গত দুই বছরের মধ্যে অভিষেক হয়েছে, এমন আম্পায়ার ছিলেন দুজন। আর এবার যাঁদের অভিষেক হয়েছে, তাঁরা গত দুই বছর রিজার্ভ আম্পায়ারের ভূমিকায় ছিলেন।

জাতীয় লিগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, মিরপুরের শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে

তবে এমন নয়, সব ভুল নতুনেরাই করছেন। জাতীয় লিগকে প্রশ্নবিদ্ধ করা বেশির ভাগ ভুল সিদ্ধান্ত আসছে অপেক্ষাকৃত পুরোনো আম্পায়ারদের কাছ থেকে। একসময় ঘরোয়া ক্রিকেটে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন, এমন এক আম্পায়ার জাতীয় লিগে এক ম্যাচে মাঠে নেমেই দিয়েছেন বেশ কয়েকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। সেসবের ভিডিও ক্লিপ ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্রিকেটারদের মুঠোফোনে।

আম্পায়ারদের ম্যাচ বণ্টন করে বাংলাদেশ ক্রিকেট আম্পায়ার্স অ্যান্ড স্কোরার্স অ্যাসোসিয়েশন। জাতীয় লিগের প্রতিটি ম্যাচের জন্য মাঠে থাকা আম্পায়াররা পান ৪০ হাজার টাকা করে। বিসিবির এক কর্মকর্তা সেদিকে ইঙ্গিত করে বাজে আম্পায়ারিংয়ের দায় দিচ্ছেন আম্পায়ার্স অ্যান্ড স্কোরার্স অ্যাসোসিয়েশনকে, ‘জাতীয় লিগে আম্পায়ারিং করে ভালো টাকা পাওয়া যায়। তাই এখানে জায়গা ধরে রাখার জন্য অনেক আম্পায়ার অনেক কিছুই করেন। এই দায় অ্যাসোসিয়েশনকেই নিতে হবে।’

ক্রিকেট আম্পায়ার্স অ্যান্ড স্কোরার্স অ্যাসোসিয়েশন অবশ্য দায়টা নিতে রাজি নয়। উল্টো তাদের অভিযোগ, গত কয়েক বছরে জাতীয় লিগের আম্পায়ার তালিকায় ঢোকা অনেককেই তারা এই পর্যায়ে আম্পায়ারিং করতে দিতে চায়নি। অ্যাসোসিয়েশন চেয়েছিল, এসব আম্পায়ার আরও কয়েক বছর নিচের স্তরের ক্রিকেটে আম্পায়ারিং করে তারপর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আসুক। কিন্তু তাদের সেই পরামর্শ শোনেনি বিসিবি।

বিসিবির আম্পায়ার্স কমিটির প্রধান ইফতেখার আহমেদ অবশ্য আশাবাদী, ‘ভালো আম্পায়ারের সংখ্যা বাড়লে একটা সময় পর পারফরম্যান্সের পার্থক্যেই দুর্বল আম্পায়ারের সংখ্যা কমে আসবে।’ কিন্তু প্রকাশ্যে ভুলের পর ভুল সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর তাঁদের তো এমনিতেই আর প্রথম শ্রেণির ম্যাচ পাওয়ার কথা নয়! এ ব্যাপারে ইফতেখার আহমেদ কোনো মন্তব্য না করলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিসিবির এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ওরা অনেক ক্ষমতাশালী। তাদের চাইলেই বাদ দেওয়া যায় না।’

ক্লাব ক্রিকেটেও পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং হয় ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে। তবে কি সেই ‘ভূত’ই এবার চেপে বসছে জাতীয় লিগেও!