সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস। আজ তাঁর ৭৩তম জন্মদিন। ভিভের ক্রিকেটীয় কীর্তি-গাঁথা তো সবারই জানা। তবে মাঠ ও মাঠের বাইরেও বর্ণিল ভিভের জীবনে এমন কিছু ঘটনা আছে, যার বেশির ভাগই হয়তো আপনি জানতেন না।
পুরো নাম আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস। জন্ম ১৯৫২ সালের ৭ মার্চ ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ অ্যান্টিগা ও বারবুডার রাজধানী সেন্ট জোন্সে। তাঁকে অ্যান্টিগার গর্ব মনে করা হয়।
১৯৭৪ সালের নভেম্বরে ভারতের বিপক্ষে বেঙ্গালুরু টেস্ট দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সিতে তাঁর অভিষেক। ভাগবত চন্দ্রশেখর দুই ইনিংসে তাঁকে এক অঙ্কের ঘরে থাকতে আউট করেন। এরপরও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটা জেতে ২৬৭ রানে।
তাঁর সময়ের সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাটসম্যান ছিলেন। প্রায় সব বোলিং আক্রমণের ওপর চড়াও হয়ে নিমেষেই প্রতিপক্ষের সব পরিকল্পনা এলোমেলো করে দিতে পারতেন। ব্যাট করার জন্য তিনি যখনই ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি দিয়ে নামতেন, ফিল্ডারদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যেত। তাঁর ব্যাটিং–ঝলক দেখার জন্য দর্শকেরা আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে যেতেন। তিনি প্রাচীন রোমান গ্ল্যাডিয়েটরের মতো ছিলেন। ডেনিস লিলি–জেফ থমসনকে নিয়ে গড়া অস্ট্রেলিয়ার সেই সময়ের বোলিং আক্রমণসহ বিশ্বের বাকি সব বোলারের ওপর তাণ্ডব চালিয়েছেন।
ক্রিকেটের ওপর সুনির্দিষ্টভাবে রচিত একটি বইয়ের মতোই জীবন্ত হয়ে উঠেছিলেন ভিভ। সাবেক ক্রিকেটার ও বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক ফ্রেড ট্রুম্যানের কল্পিত সব শট ভিভ রিচার্ডসের ব্যাট থেকে ভেসে উঠত। যদিও তাঁকে বর্ণনা করার জন্য অনেক বিশেষণ রয়েছে, তবু তাঁর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে সংখ্যা। কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো, যা তাঁকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করেছে।
• ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৯২ ম্যাচ খেলেছেন, ৫৫.৩৯ গড়ে করেছেন ৭০৯১ রান। সেঞ্চুরি ২২টি, ফিফটি ৩৪টি। এতেই বোঝা যায়, ওই ১২ বছরে কতটা ধারাবাহিক ছিলেন।
• ১৯৭৬ সালে টানা ১২ ম্যাচে ৫০ বা এর বেশি রান করেছেন, যা এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি টানা ফিফটির রেকর্ড।
• সিরিজ খেলেছেন ২৯টি। এর মধ্যে মাত্র ৭ বার তাঁর ব্যাটিং গড় ৩০–এর নিচে ছিল।
• স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ও ওয়াল্টার হ্যামন্ডের পর তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল সবচেয়ে ছিল।
• ১৯৮০–এর দশকে অধিনায়ক হিসেবে জয়ের শতাংশ ছিল সবচেয়ে বেশি—৫৪%।
১৯৮৪ সালের ৩১ মে। ভিভের জীবনে তো বটেই, ক্রিকেট ইতিহাসেই অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিন হয়ে আছে। ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সেদিন অপরাজিত ১৮৯ রান উপহার দিয়েছেন, যা অনেকের চোখেই সর্বকালের সেরা ওয়ানডে ইনিংস। হুক, পুল, কাট, স্লগে ইয়ান বোথাম, বব উইলিস, নিল ফস্টারদের নিয়ে গড়া ইংল্যান্ডদের বোলিং আক্রমণকে স্রেফ গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। মেরেছেন ২১ চার ও ৫ ছক্কা।
সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ১৬৬ রানে ৯ উইকেট হারানোর পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছিল ২৭২ রান। অর্থাৎ দলের প্রায় ৭০ শতাংশ রান তিনি একাই করেন। শেষ ব্যাটসম্যান মাইকেল হোল্ডিংকে নিয়ে সেদিন অবিচ্ছিন্ন ১০৬ রানের জুটি গড়েছিলেন, যা ওয়ানডে ইতিহাসে এখনো দশম উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি। লক্ষ্য তাড়ায় ইংল্যান্ড অলআউট হয় ১৬৮ রানে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটা জেতে ১০৪ রানে। অর্থাৎ ওই ম্যাচে ভিভের একার রানও করতে পারেনি ইংল্যান্ড।
১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা জেতা এই কিংবদন্তি আন্তর্জাতিক ফুটবলও খেলেছেন। ১৯৭৪ সালে অ্যান্টিগার হয়ে ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অংশ নিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স ২২।
১৯৮২–৮৩ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটি বিদ্রোহী দল। সেই দলের হয়ে খেলতে ভিভকে প্রস্তাব দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ড (সিএসএ)। এ জন্য তাঁকে একটি ব্ল্যাঙ্ক চেকও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিদ্রোহী দলের হয়ে খেলতে চাননি বলে ব্ল্যাঙ্ক চেকটি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন।
১৯৭০ ও ১৯৮০–এর দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ একরকম অপ্রতিরোধ্য দল ছিল। সেই দলের স্মরণে ‘ফায়ার ইন ব্যাবিলন’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়, যা ২০১০ সালে মুক্তি পায়। প্রামাণ্যচিত্রের বেশির ভাগ অংশে ভিভ রিচার্ডস ডেনিস লিলি ও জেফ থমসনের গতির মুখোমুখি হওয়ার কথা বলেছেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বকালের সেরা উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান মনে করা হয় জেফ ডুজনকে। ব্যাটিংয়ের সময় ডুজন প্রায়ই ‘দ্য গেমস দ্যাট পিপল প্লে’ গানের সুরে শিষ দিতেন। একবার ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে ব্যাট করার সময় ডুজন শিষ দেওয়া বন্ধ করলেন। ভিভ তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘গান গাওয়া থামালে কেন?’ ডুজনের উত্তর, ‘থমসন এতটাই দ্রুত দৌড়ে এসে বল করেছে যে সময় ছিল না।’
খেলোয়াড়ি জীবন শেষে অনিয়মিতভাবে ধারাভাষ্য দিয়েছেন, কখনো ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে পরামর্শকের ভূমিকাও পালন করেছেন। ২০১২ সালে বিগ ব্যাগ লিগের দল মেলবোর্ন স্টার্সের শুভেচ্ছাদূত হয়েছিলেন। ২০১৩ আইপিএলে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের (বর্তমানে দিল্লি ক্যাপিটালস) পরামর্শক হিসেবে দেখা গেছে তাঁকে। কয়েক মৌসুম পিএসএল দল কোয়েটা গ্ল্যাডিয়েটর্সেও একই ভূমিকা পালন করেছেন। তবে শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটে বেশি দিন কোচিং করাননি।
ক্রিকেটে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে সম্মানসূচক পদবি অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (ওবিই) পান। ১৯৯৯ সালে তাঁর জন্মভূমি অ্যান্টিগা ও বারবুডা তাঁকে নাইট কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব দ্য নেশন উপাধিতে ভূষিত করে। তখন থেকে তাঁর নামের আগে ‘স্যার’ শব্দটি যুক্ত হয়। ২০০৬ সালে তাঁকে অ্যান্টিগার ও বারবুডার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান নাইট অব দ্য অর্ডার অব দ্য ন্যাশনাল হিরো (জাতীয় বীর) উপাধি দেওয়া হয়।
বিখ্যাত ক্রিকেট সাংবাদিক শিল্ড বেরি বলেছেন, ‘ভিভ রিচার্ডের মতো করে কেউ ক্রিজে আসেনি। স্পটলাইট এবং সাউন্ড ইফেক্ট দিয়েও কোনো কোরিওগ্রাফার তাঁর ব্যাটিংয়ে নামার সহজাত ধরন এতটা ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না।’
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০০ সেঞ্চুরি করা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার।
২০০০ সালে ‘ক্রিকেটের বাইবেল’ উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালমেনাকের শতাব্দীর সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন মনোনীত হন। উইজডেনের নিয়োগ দেওয়া ১০০ জন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের জরিপে তাঁর ওপরে আছেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, স্যার গ্যারি সোবার্স, স্যার জ্যাক হবস ও শেন ওয়ার্ন।
১৯৮০–এর দশকে বলিউড অভিনেত্রী নীনা গুপ্তার সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়ান ভিভ। এতে নীনা অন্তঃসত্ত্বা পড়েন এবং এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। নাম রাখা হয় মাসাবা গুপ্তা।
ভিভ তখন বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক। তবে স্ত্রী মিরিয়ামের সঙ্গে তখন তাঁর মনোমালিন্য চলছিল। পরে ভিভ–মিরিয়ামের সম্পর্ক আবার জোড়া লাগে। নীনার সঙ্গেও সম্পর্ক টেকেনি। মাসাবাকে মেয়ের স্বীকৃতি দিলেও নীনাকে বিয়ে করেননি। ২২ গজ আর রুপালি পর্দার স্মরণীয় প্রেমকাহিনি হিসেবে ভিভ-নীনার গল্পটা অমর হয়ে আছে।